## মোহাম্মদ আলী সরকার ## স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা বিশেষ কোনো দিবস আসলে মন আমাদের এক ধরনের আবেগ, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের চারপাশ যেন লাল সবুজ রংয়ের বন্যায় ভেসে যায়। রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, শপিংকমপ্লেক্স, বাড়ির ছাদ- সব জায়গায় শোভা পায় জাতীয় পতাকা। কেউ কেউ নিজের গাড়িতেও পতাকা ওড়ান। পতাকা নিয়ে এমন উন্মাদনা দেশের প্রতি ভালোবাসারই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু দিবস শেষেও এ পতাকা দিনের পর দিন অবহেলায়, অনাদরে যখন জীর্ন, বিবর্ণ হয়েও উড়তে থাকে তখন সত্যিই কষ্ট হয়। অথচ ১৯৭২ সালে প্রণীত (২০১০ সালে সংশোধিত) “জাতীয় পতাকা বিধিমালা”য় জাতীয় পতাকা যথাযথভাবে ব্যবহারের বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। এ নির্দেশনা মেনে চলা প্রতিটি নাগরিকের অবশ্য কর্তব্য।
বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪(১) অনুযায়ী “প্রজাতন্ত্রের জাতীয় পতাকা হইতেছে সবুজ ক্ষেত্রের উপর স্থাপিত রক্তবর্ণের একটি ভরাট বৃত্ত।” অন্যদিকে পতাকা বিধিতে বলা হয়েছে, পতাকার রং হবে গাঢ় সবুজ এবং সবুজের ভিতরে একটি লালবৃত্ত থাকবে। জাতীয় পতাকার মাপ হবে ১র্০ীর্৬ দৈর্ঘ্য ও প্রস্থের আয়তাকার ক্ষেত্রের গাঢ় সবুজ রঙের মাঝে লাল বৃত্ত। বৃত্তটি দৈর্ঘ্যরে এক-পঞ্চমাংশ ব্যাসার্ধ বিশিষ্ট হবে। ভবনের আয়তন অনুযায়ী পতাকা ব্যবহারের তিন ধরনের মাপ হচ্ছে ১র্০ীর্৬, র্৫ীর্৩ এবং ২.র্৫ী১.র্৫। গাড়িতে ব্যবহারের জন্য মাপ হচ্ছে বড়ো গাড়ির জন্য ১র্৫র্ ীর্৯র্ এবং ছোটো গাড়ির জন্য ১র্০র্ ীর্৬র্ ।
যেহেতু জাতীয় পতাকা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব নির্দেশ করে সেহেতু সকল সরকারী ভবন, অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ভবনে সকল কর্ম দিবসে পতাকা উত্তোলনের বিধান রয়েছে। এছাড়া ঈদ-এ মিলাদুন্নবী, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস ও সরকার ঘোষিত অন্য যে-কোনো দিবসে বাংলাদেশের সরকারী, বেসরকারী ভবন ও বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন এবং কনস্যুলার অফিসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া শহিদ দিবস ও জাতীয় শোক দিবসে বা সরকার ঘোষিত অন্যান্য দিবসে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখার বিধান করা হয়েছে।
পতাকা বিধি অনুসারে সাধারণ মানুষ গাড়িতে পতাকা ব্যবহার করতে পারে না। শুধু রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মোটরগাড়ি, নৌযানে ও বিমানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের অধিকারী। তাছাড়া আইনানুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার, কেবিনেট মন্ত্রী, কেবিনেট মন্ত্রীর পদমর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তি, চিফ হুইপ, সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা, প্রধান বিচারপতি, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন বা কনস্যুলার মিশনের প্রধান তাঁদের মোটরগাড়ি ও নৌযানে পতাকা উত্তোলনের অধিকারী। প্রতিমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদা প্রাপ্ত ব্যক্তিরা এবং উপমন্ত্রী রাজধানীর বাইরে ভ্রমণকালে কিংবা বহির্বিশ্বে মোটরগাড়ি অথবা জলযানে পতাকা ব্যবহার করার অধিকারী হবেন। সংশ্লিষ্ট মর্যাদাবান ব্যক্তি মোটর গাড়ি অথবা জলযানে থাকলেই কেবল পতাকা উত্তোলিত হবে। মোটরগাড়ি, নৌযান, উড়োজাহাজ ও বিশেষ অনুষ্ঠান ব্যতীত অন্যান্য সময় পতাকা সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উত্তোলিত থাকবে এবং সূর্যাস্তের পর কোনো মতেই পতাকা উড্ডীন অবস্থায় থাকবে না।
জাতীয় পতাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে সাধারণ কিছু নির্দেশাবলী রয়েছে। সকল ক্ষেত্রে জাতীয় পতাকাকে যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে; বিদেশি পতাকা বা রঙিন পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনকালে বাংলাদেশের পতাকাকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য স্থান সংরক্ষিত থাকবে; যে ক্ষেত্রে শুধু দুটি ভিন্ন পতাকা থাকবে, সে ক্ষেত্রে ভবনের ডানপাশে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করতে হবে এবং দুয়ের অধিক পতাকার সঙ্গে উত্তোলনকালে পতাকার সংখ্যা বিজোড় হলে বাংলাদের পতাকা ঠিক মধ্যে থাকবে। তবে জোড় সংখ্যক পতাকার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা কেন্দ্র থেকে ডানদিকের প্রথমে উত্তোলন করতে হবে। অন্য কোনো দেশের পতাকার সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পতাকা প্রথম উত্তোলিত হবে এবং সর্বশেষে নামানো হবে। দুই বা ততোধিক দেশের পতাকা হলে ভিন্ন ভিন্ন দন্ডে উত্তোলন করতে হবে এবং পতাকাগুলোর পরিমাপ প্রায় একই হবে; বাংলাদেশের পতাকার উপরে অন্য কোনো পতাকা বা রঙিন পতাকা ওড়ানো যাবে না।
মিছিলে পতাকা বহনের ক্ষেত্রে, পতাকা মিছিলের কেন্দ্রে অথবা মিছিলের অগ্রগমন পথের ডানদিকে বহন করতে হবে; জাতীয় পতাকার ওপর কোনো কিছু লেখা বা মুদ্রিত করা যাবে না অথবা কোনো অনুষ্ঠান বা উপলক্ষে কোনো চিহ্ন অঙ্কন করা যাবে না; জাতীয় পতাকাকে পোশাক হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না এবং গায়ে জড়িয়ে রাখা যাবে না। তবে পূর্ণ সামরিক মর্যাদা বা পূর্ণ আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো ব্যক্তিকে সমাধিস্থ করা হলে তাঁর শবযাত্রায় জাতীয় পতাকা আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
কোনো কিছু গ্রহণ, ধারণ বা বিলি করার জন্য পতাকাকে ব্যবহার করা যাবে না; পতাকা এমনভাবে উত্তোলন, প্রদর্শন বা মজুদ করা যাবে না, যাতে এটি সহজেই ছিঁড়ে যেতে পারে, মাটি লাগতে পারে বা নষ্ট হতে পারে; অনুমতি ছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জাতীয় পতাকাকে ট্রেডমার্ক, ডিজাইন বা পেটেন্ট হিসেবে ব্যবহার করাও অপরাধ। কোনো দেয়ালে দন্ড বিহীন পতাকা প্রদর্শিত হলে তা দেয়ালের সমতলে এবং রাস্তায় প্রদর্শিত হলে উলম্বভাবে দেখাতে হবে। গণ মিলনায়তন কিংবা সভায় পতাকা প্রদর্শন করা হলে বক্তার পেছনে ও ঊর্ধ্বে স্থাপন করতে হবে। কবরের ওপরে স্থাপন করার সময় পতাকাটি কবরে নামানো যাবে না কিংবা মাটি স্পর্শ করবে না। জাতীয় পতাকা কোনো অবস্থায়ই সমতল বা সমান্তরালভাবে বহন করা যাবে না এবং উত্তোলনের সময় সুষ্ঠু ও দ্রুতলয়ে উত্তোলন করতে হবে এবং সসম্মানে অবনমিত করতে হবে। কোনো কারণে পতাকার অবস্থা ব্যবহার যোগ্য না হলে তা মর্যাদাপূর্ণভাবে সমাধিস্থ করতে হবে।
সামনে আসছে ১৫ই আগস্ট, জাতীয় শোক দিবস। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদত বার্ষিকী স্মরণে সারাদেশে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত থাকবে। পতাকা অর্ধনমিত রাখার সময় মনে রাখতে হবে অর্ধনমিত অবস্থায় উত্তোলনের প্রাক্কালে পতাকাটি পুরোপুরি উত্তোলন করে অর্ধনমিত অবস্থানে আনতে হবে এবং নামানোর প্রাক্কালে পতাকাটি শীর্ষে উত্তোলন করে নামাতে হবে।
জাতীয় পতাকা ব্যবহারের এসব বিধি ভঙ্গ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং কেউ ভঙ্গ করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। তাই শুধু বিশেষ দিবসে নয়, সব সময়ের জন্যই আমাদের পতাকা বিধি অনুযায়ী পতাকা টানাতে হবে। আমাদের দেশ, আমাদের পতাকাকে আমরা ভালোবাসি- এতে কোনো সন্দেহ নেই। পতাকা বিধি মেনে চলে এ ভালোবাসার সঠিক বহিঃপ্রকাশ আমরা দেখাবো- এ অঙ্গীকার হোক আমাদের সকলের। -পিআইডি প্রবন্ধ।