॥বিশ্বজিৎ দে বাবলু॥ আমেরিকায় করোনাভাইসের আগ্রাসী থাবা এখনো অব্যাহত। প্রতিদিনই মানুষের মৃত্যুর হার বাড়ছে। প্রতিদিনই আমাদের পরম আত্মীয় বন্ধু বান্ধব করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছেন বা আইসিইউ ভর্তি হচ্ছেন। কিন্তু হাসপাতাল বা বাসায় গিয়ে ওইসব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থাকা সত্বেও পারছিনা এক অজানা আতঙ্ক, অনাকাঙ্খিত পরিণতির ভয়ের পাশাপাশি লকডাউনের কারণে। এই করোনা আমাদের সমাজ, দেশ, প্রিয়জন, বন্ধু, আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাইকে একের পর এক ধ্বংস করে চলেছে। এই করোনা এখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কতদিন এভাবে চলবে?
আমার কাজের জায়গা মানসিক হাসপাতালের অনেকেই আক্রান্ত ও করোনা ভাইসের আগ্রাসী থাবায় ইতিমধ্যে চিরদিনের জন্য হারিয়েছে অনেক সহকর্মিকে। আমরা যারা এখনও সুস্থ ও স্বাভাবিক অবস্থায় কাজে যাচ্ছি আমরা কেউ কাউকে চিনি না। সবাই মুখোশ ও পিপিই পরে থাকে। কে ডাক্তার, কে নার্স, কে হাউস কিপার, কে ল্যাব টেকনিশিয়ান, কে ফার্মাসিস্ট, কে ইকেজি টেকনিশান, কে ট্রান্সপোর্টার? কারো চেনার কোন উপায় নেই। সবার মুখ ঢাকা। এন-৯৫ মাস্ক। এটা ছাড়া বেঁচে খাকার উপায় নেই। সাড়া দিন পড়ে থাকতে হয়। দম বন্ধ হয়ে আসে তারপরেও পরে থাকি মৃত্যু ভয়ে। কি করে খুলব? খুললেই যে নিশ্চিত আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু। প্রকৃতির বাতাস আলো যেনো আমাদের ধরা ছোয়ার বাইরে। করোনা ঃ যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। কি ভংকর। এর শক্তি অপরিসীম। একে পরাস্ত করার গোলা বারুদ অস্ত্র কেউ এখন পর্যন্ত তৈরি করতে পারে নি। আমরা কি অসহায়। আমাদের এই অসহায় অবস্থাকে আরও ভয়াভয় তরে তুলছে আমেরিকার আমেরিকার হাসপাতালগুলো।
আমেরিকার হাসপাতালগুলো এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর অভিবাসী সমাজের ছিল ব্যাপক আস্থা। অনেক বাঙালিই মনে করতেন, ৯১১ কল করে এ্যাম্বুলেন্স পৌঁছাতে পারা মানে বেঁচে যাওয়া। এবার হৃদরোগ থেকে শুরু করে যত কঠিন রোগই হোক না কেন, নিরাময় হয়েই ফিরতেন বেশিরভাগ রোগী। আমেরিকার হাসপাতালগুলো যে কতটা অরক্ষিত রয়েছে, তা এ বার করোনা ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের এক বন্ধুর অবস্থা খুব খারাপ। থাকেন নিউজার্সিতে। তাঁর স্ত্রী ৯১১ কল করলে এ্যাম্বুলেন্স এসে নিয়ে গিয়েছে। জ্বর কোমার জন্য টাইলানল দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। এবার রোগী বাড়ি ফিরলেন নিজ দায়িত্বে। ৩ দিন পর করোনা টেস্টের রেজাল্ট জানলেন পজেটিভ। ফোনে বলেছেন শ্বাস-প্রশ্বাস কষ্ট হলেই হাসপাতালে যেতে। মৃত্যুর কাছাকাছি না পৌঁছানো পর্যন্ত টেস্ট কিংবা ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা করা হচ্ছে না।
বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই প্রথম দেশ, যেখানে এক দিনে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যায়ও পৃথিবীর সকল দেশকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। প্রতিদিনই দেশটিতে ২হাজারেরও উপরে মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে। আক্রান্তের সংখ্যা ১লক্ষ ছাড়িয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ২০হাজার। নিউইয়র্কের পর করোনায় আক্রান্ত হয়েছে নিউজার্সি। নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি মাঝখানে শুধু একটি নদী। নিউজার্সির অনেকেই নিউইয়র্কে কর্মক্ষেত্রে যোগ দিতে প্রতিদিন যাতায়ত করেন। তাই নিউজার্সির মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় ৪হাজারের বেশি। ৮০ হাজারের উপরে রয়েছে আক্রান্তের সংখ্যা। এই রাজ্যে ৭জন বাংলাদেশির করেনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে।
নিউইয়র্কের হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের শুশ্রূষায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও নার্সদের অবস্থা কতটা করুণ তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। হাসপাতালগুলোর ভলান্টিয়ার সার্ভিসগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে সংগ্রহ করছে নানান সরঞ্জামাদি। মাস্ক, গ্লাভস, প্রটেক্টিভ হেড শিল্ড বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা তৈরি করে ডোনেট করছে হাসপাতালগুলোতে। উহানে পুরো শরীরকে রক্ষা করার জন্য চায়না যে গাউন ব্যবহার করেছে, আজ পর্যন্ত আমেরিকার কোন হাসপাতালে এটি চোখে পড়েনি। প্রশ্ন উঠেছে আমেরিকার করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসায় ব্যর্থতার পাশাপাশি সুরক্ষাকারীদের রক্ষার পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও নেই।
তবে অন্ধকারের মধ্যে একমাত্র আশার আলো নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি তথা যুক্তরাষ্ট্রে নতুন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমছে। সেই আশায় আমরা আমেরিকানবাসী হোম কোয়রান্টিনে বসে দিন গুনছি। লেখক ঃ বিশ্বজিৎ দে বাবলু, স্বাস্থ্যকর্মী ও সাংবাদিক, নিউজার্সি যুক্তরাষ্ট্র।