ইন্না-আনযালনা-হু ফী-লাইলাতিল ক্বাদর। অর্থাৎ, নিশ্চয় আমি সেটা ক্বাদরের রাতে অবতীর্ণ করেছি।
শানে নুযূল ঃ একদা আল্লাহ্র হাবিব তাজেদারে কায়েনাত দোজাহানের বাদশাহ আহাম্মাদে মুজতবা হযরত মুহাম্মাদ মুস্তাফা (সাঃ) সাহাবা-ই কেরামকে ইরশাদ ফরমালেন, শামসূন ইস্রাঈলী এক হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪মাস যাবত দিনে রোযা রাখতো, রাতে জাগ্রত থেকে ইবাদত করত। তখন একজন সাহাবী আরয করলেন, হুজুর! (সাঃ) আমাদের মধ্যে তার মতো কে-ই বা হতে পারে? কিয়ামতে সেতো আমাদের চেয়ে উত্তম হয়ে যাবে। তখন এ সূরা আল-ক্বাদর অবতীর্ণ হয়েছে। যাতে ইরশাদ হয়েছে, আমি লওহ-ই মাহফুয থেকে প্রথম আসমানের বায়তুল ইযযাত এর দিকে কুরআন শরিফকে ক্বাদর রাতে অবতীর্ণ করেছি। সুতরাং যে মুসলমান এ রাতে ইবাদত করবে সে হাজার মাসের বেশি ইবাদাতের সাওয়াব লাভ করবে।
এ থেকে কয়েকটা বিষয় জানা যায় ঃ
এক- আল্লাহ্র খাস বান্দাদের কাজ আল্লাহ্রই হয়ে থাকে। দেখুন! কুরআন নাযিল করা ফিরিশতাদের কাজ। কিন্তু মহান আল্লাহ্ পাক ইরশাদ ফরমালেন, আমি অবতীর্ণ করেছি।
দুই- যে তারিখে কোন উচ্চমানের কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়, ঐ তারিখ রোজ কিয়ামত পর্যন্ত উত্তমই থেকে যায়। শবে ক্বাদর-এ একবার কুরআন পাক এসেছে। কিন্তু এ রাতটি রোজ কিয়ামত পর্যন্ত উৎকৃষ্ট। সুতরাং হুজুর পাক(সাঃ) এর বিলাদাত শরিফ বা জন্মদিনের রাত, কিংবা শবে মিরাজ ইত্যাদি সর্বদাই উত্তম।
তিন- দিন অপেক্ষা রাত উত্তম। মিরাজ শরিফ রাতে হয়েছে, কুরআনের অবতরণ, ফিরিশতাদের সৃষ্টি, জান্নাতে বাগান লাগানো, হযরত আদম (আঃ) এঁর শরীর মুবারকের উপকরণাদি সংগ্রহ করে একত্রিত করা শবে ক্বাদরেই হয়েছে। {তাফসীরে-ই আযীযী} দোয়া কবুল হবার মুহূর্তটি রাতের শেষ ভাগেই হয়। কিন্তু দিনে শুধু জুম্মায় হয়ে থাকে।
ওয়ামা-আদরা-কা মা লাইলাতুল ক্বাদর। অর্থাৎ এবং আপনি কি জানেন ক্বাদর রাত্রি কি?
লাইলাতুল ক্বাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহ। অর্থাৎ ক্বাদরের রাত হাজার মাস থেকে উত্তম।
হে মুসলমান! তুমি কি জানো, শবে ক্বাদর কেমন রাত? সেই রাতের যথাযথ সংজ্ঞা দেওয়া বা প্রশংসা করা শব্দাবলীর মাধ্যমে সম্ভবপর নয়। অথবা, হে মাহবুব(সাঃ)! আপনি পঞ্চ ইন্দ্রিয় বা চিন্তা-কল্পনা ও অনুমান দ্বারা শবে ক্বাদর সম্পর্কে অবগত হননি। বরং ওহী দ্বারা সেই রাতের মহত্ব ও মর্যাদা জানা গেছে। মোট কথা, এ থেকে এ কথা অনিবার্য হয় না যে, হুজুর রাসূলে খোদা মাহবুব (সাঃ) শবে ক্বাদরের মর্যাদা ও মহত্বগুলো সম্পর্কে অবগত নন। বেশাখ হুজুর পাক(সাঃ) সৃষ্টির শুরু আদি থেকে শেষ পর্যন্ত সবকিছুই অবগত আছেন।
ক্বাদর এর অর্থ হচ্ছে ‘ইযযাত’ ওমা ক্বাদারুল-ল্লাহা হাক্বা ক্বাদরিহি অর্থাৎ আল্লাহ্ মহা সম্মানের যথাযথ মূল্যায়ন মানবজাতি করেনি। অথবা ‘পরিমাণ’ যেমন ইরশাদ হয়েছে ওমা নুনাঝিলুহু ইল্লা বিক্বাদারিম-মা’লুমিন অর্থ তা নির্ধারিত পরিমাণেই অবতীর্ণ করি। অথবা সংকীর্ণ হওয়া যেমন ইরশাদ হয়েছে আম্মা মান ক্বাদারা আলাইহি রিঝকুহু অর্থ কিন্তু যার জীবিকা সংকীর্ণ করা হয়েছে।
এ রাতকে শবে ক্বাদর এ জন্যই বলা হয় যে, এটা সম্মানিত রাত। অথবা এ রাতে গোটা বছর ঘটিতব্য ঘটনাবলীর ‘তালিকাসমূহ’ ও পরিমাণনামা ফেরেশতাদের মধ্যে বন্টন করে দেওয়া হয়। আর সব ধরনের ফেরেশতাকে তাদের কাজের পরিমাণ জানিয়ে দেওয়া হয়। অথবা এ রাতে ফেরেশতাগণ এতো বেশি সংখ্যায় অবতীর্ণ হন যে, গোটা ভূপৃষ্ঠ সংকীর্ণ হয়ে যায়, সংকুলান হয় না।
খুব বেশি সম্ভব, এ রাতটি হলো- ২৭তম রাত। কেননা, এখানে লাইলাতুল ক্বাদর তিন জায়গায় (তিন বার) ইরশাদ হয়েছে। আর, লাইলাতুল ক্বাদর এর মধ্যে নয়টা বর্ণ আছে।{৯ীব=২৭}। তাছাড়া এ সূরায় ত্রিশটা শব্দ(পদ) রয়েছে। তন্মধ্যে (ঐ রাত নির্দেশক সর্বনাম) হিয়া হচ্ছে ২৭তম পদ। হিয়া মানে পূর্ণ ক্বাদর রাত্রি, মাগরিব থেকে ফজর পর্যন্ত।
এ রাতটি ঐ হাজার রাত থেকে শর্তহীনভাবে উত্তম, যেগুলোর মধ্যে একটি রাতও ‘শবে ক্বাদর’ নেই। সুতরাং এ আয়াতের বিরুদ্ধে কোন আপত্তি নেই। যেহেতু হুজুর পাক (সাঃ) শামসূন ইস্রাঈলীর কাহিনীর মধ্যে হাজার মাসের উল্লেখ করেছিলেন, সেহেতু মহান আল্লাহ্ পাকও ঐ গুলোর(হাজার মাস) কথাই উল্লেখ করেছেন। শতাব্দী ও বছরসমূহ উল্লেখ করেননি। এখানে হাজার মাস মানে ‘দীর্ঘকাল’। আরবিতে হাজারের বেশি সংখ্যা নেই। এ কারণে হাজার ইরশাদ হয়েছে।
স্মর্তব্য যে খাইরুন মানে হয় তো ঐ রাতের নৈকট্য ও মহা-মর্যাদা বুঝায়, অথবা এ অর্থই বুঝায় যে, ঐ রাতের ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদত অপেক্ষা বেশি সাওয়াবের কারণ হয় এ আয়াত থেকে দু’টি বিষয় সম্পর্কে জানা যায় ঃ এক, বুযর্গ জিনিসগুলোর সাথে সম্পর্ক বড়ই উপকারী হয়। কারণ, শবে ক্বাদরের এ ফযিলত কোরআনের সাথে সম্পর্কের কারণেই। ‘আসহাব-ই-কাহাফ’ এর কুকুরও ঐ সব বুযর্গের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে স্থায়ী জীবন ও সম্মান লাভ করেন।
দুই, সমস্ত আসমানী কিতাব অপেক্ষা আল-কুরআন শ্রেষ্ঠ। কেননা, তাওরাত ও ইঞ্জিল অবতরণের তারিখটা এ মহত্ব পায়নি।
তানাযযালুল মালা-ইকাতু ওয়ার রু-হু ফী-হা বিইযনি। অর্থাৎ, এতে ফেরেশতাগণ ও জিব্রাঈল অবতীর্ণ হয়ে থাকে স্বীয় রবের আদেশে প্রত্যেক কাজের জন্য।
অর্থাৎ শবে ক্বাদরে সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত সমস্ত নৈকট্যধন্য ফেরেশতা হয় তো সিদরা হয় অবতীর্ণ হন। অথবা ইবাদাত পরায়ণ অগণিত ফেরেশতা ও রুহুল আমীন হযরত জিব্রাঈল, কিংবা রুহুল্লাহ হযরত ঈসা(আঃ) অথবা রুহ-ই-মুহাম্মাদী (সাঃ) কিংবা ফেরেশতাদের খাস রুহানী দলসমূহ অথবা ঐ ‘রূহ’ নামক ফেরেশতা, যার অগণিত জিহ্বা রয়েছে, যেগুলো দিয়ে বিভিন্ন ভাষায় আল্লাহ্র প্রশংসা করেন, আর এই রাতে সমস্ত মুখ দিয়ে মু’মিনদের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করেন, ভূপৃষ্ঠের উপর, বিশেষ করে, মসজিদগুলোতে ও আবিদ মু’মিনদের ঘরগুলোতে অবতীর্ণ হতে থাকেন। (রূহ ইত্যাদি)। তাও এজন্য যে, আজ সিদাতুল মুন্তাহার পরিবর্তে ভূ-পৃষ্ঠের উপর মুসলমানদের সাথে তারা ইবাদত করবেন এবং মুসলমানদের দোয়ার সাথে ‘আমীন’ বলবেন। তাছাড়া, নেক্কার মু’মিনগণ এসব ফেরেশতার ‘ফয়য’ লাভ করবেন। এমনকি ফেরেশতাগণও রাতের বরকত হাসিল করে থাকেন। (তাফসীর-ই-আযীয) এ আয়াত থেকে কয়েকটা মাসআলা প্রতিমান হয় ঃ
এক, যমীন (পৃথিবী) আসমান অপেক্ষা উত্তম। এ কারণে আল্লাহ্র নৈকট্যধন্য ফেরেশতাগণ এ রাতে আল্লাহ্র বিশেষ নৈকট্য লাভের জন্য ভূ-পৃষ্ঠে এসে থাকেন। দেখুন! হযরত জিব্রাঈল(আঃ) দো’আ সমূহ প্রার্থনার জন্য হাযির হতেন। ( কানযুল ঈমান ও নূরুল ইরফান ১৬৬৩ পৃষ্ঠা)
দুই, বুযর্গদের সান্নিধ্যে যেই দো’আ ও ইবাদাত করা হয় তা বেশি কবুল হয়। কারণ, এসব ফেরেশতা নবীগণ ও ওলীগণের কবরসমূহের নিকটে ইবাদত করার জন্য এখানে আসেন। বনী ইস্রাঈল সম্প্রদায় যখন তওবা করতে চাইল, তখন নির্দেশ হলো- ‘বায়তুল মুকাদ্দাস’ শহরে সেজদা করতে করতে প্রবেশ করো ! সেখনে গিয়ে তাওবা করো। কবুল হবে। (সূরা বাকারা)
তিন, শবে ক্বাদর ইত্যাদির মতো বরকতময় সময়গুলোর বরকতরাজি পৃথিবীতে বেশি প্রকাশ পায়, যা অর্জন করার জন্য ফেরেশতাগণ এখানে আসেন।
চার, কিছু সংখ্যক ফেরেশতা শুধু আসমানের উপর থাকেন, আর কিছু সংখ্যক থাকেন শুধু পৃথিবীতে। আর কিছু ফেরেশতা আসমান ও যমীনে দিনে এবং রাতে আসা-যাওয়া করেন। কিছু ফেরেশতা এমনও রয়েছেন যে, যারা শুধু শবে ক্বাদরে পৃথিবীতে আসেন।
পাঁচ, যদিও ‘শবে ক্বাদর’ পুরোটাই উত্তম, কিন্তু এর শেষ ভাগ বেশি উত্তম। কারণ, তখন সমস্ত ফেরেশতা জমায়েত হয়ে যান। এর পূর্বে তো অবতীর্ণই হতে থাকেন।
ছয়, যদিও হযরত ঈসা(আঃ) চতুর্থ আসমানে, আর ‘রূহ-ই-মুহাম্মাদী (সাঃ)’ আলা-ই-ইল্লীয়্যীন’ এর মধ্যে অবস্থানরত, তবুও সেখান থেকে সমগ্র বিশ্বকে প্রত্যক্ষ করছেন, কিন্তু বরকতময় সময়গুলোতে বিশেষতঃ শবে ক্বাদরে ভূ-পৃষ্ঠে আলোকদীপ্ত হয়েই সমগ্র দুনিয়ার অবস্থা অবলোকন ও পরিদর্শন করেন। যেমন- ‘রূহ’ এর চতুর্থ ও পঞ্চম তাফসীর থেকে বুঝা গেলো।
সালা-ম। হিয়া হাত্তা- মাত্বলা’ইল ফাজর। অর্থাৎ, ওটা শান্তি-ভোর উদয় হওয়া পর্যন্ত।
ক্বাদরের পুরো রাতটিই শয়তানদের অনিষ্ট এবং বিপদাপদ ও আল্লাহ্র শাস্তি থেকে নিরাপদ। কিন্তু অন্যান্য রাতে এমনটি হয় না। সেগুলোর প্রথমভাগে জিন ও শয়তানদের ছড়াছড়ি, মাঝখানে নিদ্রা ও অলসতা এবং শেষভাগেই রহমত হয়।
এ থেকে বোঝা গেলো যে, বুযর্গদের পদাঙ্কের বরকতে আযাব থেকে নিরাপত্তা ও শয়তানদের অপসারণ ঘটে। শবে ক্বাদরে ফেরেশতা ও পবিত্র রূহগুলোর বরকতে নিরাপত্তা লাভ করে। এ সবই ভোর উদিত হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। লেখক ঃ আঞ্জুমান-ই-ক্বাদরীয়া মাদ্রাসাতু সাবি-ইল-হাসান দাখিল মাদ্রাাসা, দৌলতদিয়া, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী।