সোমবার, ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২০ অপরাহ্ন
Logo
সংবাদ শিরোনাম ::
বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আইসোলেশন মেয়াদ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টা ও বিটার তুলনায় তিন গুণের বেশী পুনঃ সংক্রমন ঘটাতে পারে : গবেষণা প্রতিবেদন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে এক বন্দুকধারী গ্রেফতার শান্তি চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে কলম্বিয়া সফর জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণের সাক্ষাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়ায় লকডাউন করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতে নতুন করে ১০ হাজার ৩০২ জন করোনায় আক্রান্ত নভেম্বর মাসজুড়ে করাঞ্চলে কর মেলার সেবা পাবেন করদাতারা ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারী কার্যবিধি যুগোপযোগী হচ্ছে

মাদকাসক্তি ও তরুণ সমাজ

  • আপডেট সময় শনিবার, ২ জুন, ২০১৮

॥মুহাম্মদ ফয়সুল আলম ॥ বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা-সবকিছুতেই বাংলাদেশের উন্নয়ন চোখে পড়ার মতো। এদেশে রয়েছে বিপুল সংখ্যক কর্মক্ষম জনশক্তি। এ কর্মক্ষম মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড আহরণে বাংলাদেশ বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে আমরা বর্তমানে মাদকাসক্তি নামক মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন। মাদকাসক্তি সামাজিক ব্যাধিরূপে বিস্তার লাভ করেছে। মাদকাসক্তের হার দিন দিন বাড়ছে। দেশের যুবসমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন। আশার কথা মাদকাসক্তি সমস্যার সমাধানকল্পে সরকারের রয়েছে যথেষ্ট আন্তরিকতা।
মাদকদ্রব্য এমন একটি রাসায়নিক দ্রব্য যা গ্রহণে মানুষের স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক অবস্থার ওপর প্রভাব পড়ে এবং আসক্তির সৃষ্টি হয়। মাদকদ্রব্য বেদনানাশক ও তন্দ্রাচ্ছন্নতা তৈরি করে। এটি মেজাজ পরিবর্তন, মানসিক আচ্ছন্নতা, রক্তচাপ পরিবর্তন ইত্যাদির ওপর প্রভাব বিস্তার করে। মাদকদ্রব্য গ্রহণ করলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং নেশাদ্রব্যের ওপর নির্ভরশীলতা সৃষ্টির পাশাপাশি দ্রব্যটি গ্রহণের আকাক্সক্ষা বাড়ায়।
ল্যাটিন আমেরিকার পর ভয়াবহ মাদক উৎপাদনকারী দুটি জনপদের একটি আফগানিস্তান, অন্যটি মিয়ানমার। মিয়ানমার বাংলাদেশের প্রতিবেশী, আফগানিস্তানও দূরে নয়। এর বাইরে সীমান্ত এলাকাগুলোর কাছাকাছি ফেনসিডিলসহ নানা ধরনের মাদক উৎপাদনকারী কারখানা থাকায় মাদকের বড়ো ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। এ কারণে আমাদের সচেতনতার প্রয়োজন রয়েছে অনেক বেশি।
মাদকদ্র্রব্যের নির্দিষ্ট সংখ্যা বা নাম বলা কঠিন। মানুষ নেশার জন্য যা ব্যবহার করে তাই মাদকদ্রব্য বা নেশাদ্রব্য। সেটি হতে পারে ইনজেকশন, ধূমপান বা যে-কোনো মাধ্যম। বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে হেরোইন, কোকেন, ইয়াবা, আফিম, মারিজুয়ানা, গাজা, ফেনসিডিল, বিয়ার, কেটামিন, বিভিন্ন রকমের ঘুমের ঔষধ ও জুতায় লাগানোর আঠা ইত্যাদি। অনেকে বিভিন্ন ধরনের এনার্জি ড্রিংকসের সাথে ঘুমের ঔষধ মিশিয়েও নেশা করে থাকে। আশির দশকের শুরুতে হেরোইন ও শেষের দিকে ফেনসিডিলের মাধ্যমে আমাদের দেশে মাদকাসক্তি দ্রুত বিস্তার লাভ করে।
সাম্প্রতিককালে মাদকদ্রব্য জব্দের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়- দেশে হেরোইন ও গাঁজার অপব্যবহার স্থিতিশীল রয়েছে। কোডিনিমিশ্রিত ফেনসিডিলের অপব্যবহার কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। মিথাইল এডফিটামিন দিয়ে তৈরি ইয়াবার অপব্যবহার ও জড়িতদের আটক ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের কড়া নজরদারি এবং কঠোর অবস্থানের কারণে এসব মাদকের ব্যবহার অনেক কমে আসলেও সস্তা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় ইয়াবার বিস্তার বেড়েছে।
মাদক গ্রহণের ফলে মানসিক, স্বাস্থ্যের ওপর খুব প্রভাব পড়ে। মাদক গ্রহণকারীরা একাধিক ব্যক্তি একই সিরিঞ্জ ব্যবহার করার ফলে এইডস হওয়ার আশংকা থাকে। আবার হেপাটাইটিস, ফুসফুসে ক্যান্সার, স্ট্রোক, হৃদরোগ, জন্ডিস, মস্তিস্ক ও মেরুদন্ডের রোগ হতে পারে।
মাদকের ব্যবহার থেকে অভ্যাস, অভ্যাস থেকে আসক্তি। বাংলদেশের মাদক পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- দেশে মাদকাসক্তের মধ্যে ৮৪ ভাগ পুরুষ, ১৬ ভাগ নারী। সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি থেকে শুরু করে নারী ও শিশু কিশোররাও মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, দেশজুড়ে প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ নানাভাবে মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। আর মাদক সেবনের ক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষিতের সংখ্যা প্রায় ১৫ শতাংশ।
আমাদের দেশে মাদকাসক্তদের বিষয়ে সরকারিভাবে নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা হয়, দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্ত রয়েছে। মাদকাসক্তের মধ্যে ৫০ শতাংশই বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িত। বিভিন্ন সামাজিক গবেষণায় দেখা গেছে, নেশার প্রয়োজনে টাকা জোগাড় করতে এমন কোনো কাজ নেই যা মাদকাসক্তরা করে না। নিজের রক্ত বিক্রি করা থেকে শুরু করে চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই, সন্ত্রাসসহ নানারকম অপরাধের সাথে জড়িত থাকে এরা। ফলে সামাজিক অস্থিরতাও বাড়ছে দিনদিন।
মাদকের নেশা এখন নগরীর প্রাণকেন্দ্র থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামেও বিস্তার লাভ করেছে। আমাদের দেশে কিশোর সন্ত্রাসীদের ক্রমবর্ধমান দাপটের যে তথ্য সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার অন্যতম কারণ মাদক। দেশের সর্বত্র স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্ত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম। মাঝে মাঝেই পত্রিকায় দেখা যায়- নেশাগ্রস্ত যুবকের গুলিতে জোড়া খুন, মাদকাসক্ত মেয়ের মা-বাবা খুন; ইয়াবা সেবনে বাধা দেওয়ায় খুন হলেন মা-বাবা, মাদকাসক্ত ছেলের হাত থেকে বাঁচতে মা ছেলেকে খুন করলেন। মাদকাসক্তরা স্বাভাবিক বিবেক বুদ্ধি, মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের ৮০ শতাংশই যুবক। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিবেচনায় নিঃসন্দেহে পরিসংখ্যান ইতিবাচক নয়। আমাদের দেশে নারী মাদকাসক্তদের সংখ্যাও বাড়ছে।
বিভিন্ন গবেষণা বলছে, নারী আসক্তদের মধ্যে ৯০ শতাংশর বয়স ১৫ থেকে ৩৫, বাকিদের বয়স ৪৫ এর মধ্যে। এসব মাদকাসক্তদের মাধ্যমে তাদের সন্তানরাও মাদকের প্রতি আকৃষ্ট হতে পারে, যা পারিবারিক অশান্তি সৃষ্টি করবে।
মাদকের বিস্তার রোধে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ রয়েছে। প্রায় প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ধরা পড়ছে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংগঠনের উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে মাদকবিরোধী অভিযান। নানা রকমের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সবাইকে একযোগে মাদকের বিরুদ্ধে এগিয়ে আসতে হবে।
দেশজুড়ে এই মুহূর্তে মাদক বিরোধী অভিযান চলছে। এ পর্যন্ত মাদক ব্যবসা সংশ্লিষ্ট প্রায় ৮হাজার লোক গ্রেফতার হয়েছে, এ সংক্রান্ত মামলা হয়েছে প্রায় ৫হাজার।
পরিবার হচ্ছে নৈতিক শিক্ষার প্রথম ও শক্তিশালী ধাপ। কিন্তু আর্থ-সামাজিক নানা কারণে আমাদের দেশে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ছে। মা-বাবা সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত সময় দিচ্ছেন না বা দিতে পারছেন না। সন্তানদের সক্ষমতার কথা বিবেচনা না করে অসম প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দেওয়ায় অনেক সময় তারা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। নিজেরা অথবা বন্ধুদের মাধ্যমে মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়ছে সহজে। তাই পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করতে হবে, সন্তানদের পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে, তারা কাদের সাথে মিশছে সে বিষয়ে খোঁজ রাখতে হবে।
মাদকাসক্তি প্রতিরোধের সর্বাপেক্ষা কার্যকর উপায় হচ্ছে মাদকদ্রব্য ও মাদকাসক্তির অনুপ্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করা। মাদক ব্যবসার সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা, বেকারদের কর্মসংস্থান ও স্কুল কলেজের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি মাদকাসক্তির কুফল সম্পর্কে শিক্ষা প্রদান এবং মাদকাসক্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা জরুরী।
সর্বোপরি, মাদকাসক্তি একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক সমস্যা। সচেতনতা বৃদ্ধির সাথে সাথে সামাজিক আন্দোলন জোরদারের মাধ্যমে এটির নির্মূল করতে হবে। আসুন, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা সবাই সচেতন হই, দলমত, ধর্ম- বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এক হয়ে কাজ করি। -পিআইডি প্রবন্ধ।

নিউজটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
error: আপনি নিউজ চুরি করছেন, চুরি করতে পারবেন না !!!!!!