॥খোন্দকার আব্দুল মতিন॥ আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থা আইএলওর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের শিশু শ্রমিকেরা ৪৭ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। কিছু কাজকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যেমন- মোটর ওয়ার্কশপের মেকানিক, ওয়েলডিং, গ্যাস কারখানা, বেলুন তৈরির কারখানা, লেদ মেশিন, বিড়ি বা তামাক জাতীয় দ্রব্য তৈরির করখানা, স্টেশন বা টার্মিনালের কুলি, টেম্পুূর হেলপার, নির্মাণ শ্রমিক, এমব্রয়ডারি, জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প, চিংড়ি হ্যাচারি, লবণ কারখানা, গৃহকর্ম ইত্যাদি। শিশুশ্রমের কারণে বহু শিশুর সোনালী শৈশব বাধাগ্রস্ত হয়। মেশিনের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয় তাদের জীবন। অথচ শিশুদের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সুপ্ত প্রতিভা। তারা নতুন কুঁড়ির মতো। ফুল হয়ে ফোটার অপেক্ষায় থাকে। এসব ফুলের মতো শিশুরা পৃথিবী জুড়ে বহুদেশে অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত। দারিদ্র্যের কারণে তাদের সংগ্রাম করতে হয়। বেঁচে থাকার জন্য নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আবার ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হতে হয় তাদের।
তবে পৃথিবীতে শিশুদের জন্য সামাজিক দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অঙ্গীকার করা হচ্ছে শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নের জন্য। শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯ সালের নবেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বরে এটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হয়। ইতিহাসে এটি হচ্ছে ব্যাপকভাবে গৃহীত মানবাধিকার চুক্তি। জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৮৭টি দেশ চুক্তিটি অনুমোদন করেছে। প্রথম যেসব দেশ এই চুক্তিটি স্বাক্ষর ও অনুমোদন করে, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম।
এই সনদের ৫৪টি ধারায় সকল শিশুর কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং সকল প্রকার শোষণ, বৈষম্য, অবহেলা এবং নির্যাতন থেকে তাদের রক্ষার বিধান রয়েছে। সনদে স্বীকৃত অধিকারের আওতায় স্বাস্থ্য, শিক্ষা, শিশু ও মাতাপিতার মধ্যকার সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক কর্মকা-, নাগরিক অধিকার, শোষণ এবং আইনের সাথে বিরোধে জড়িত শিশুসহ অনেক বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। লেদ মেশিনের কাজ করতে গিয়ে অসাবধানতাবশত বাম হাত মারাত্মক জখম হয় সুজনের। এ অবস্থায়ই সে দুই তিন দিন ওয়ার্কশপে কাজ করে। পরিস্থিতি খারাপ হলে সুজনকে তার বাবা ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানায় সুজনের হাত কেটে ফেলতে হবে। এক পর্যায়ে তার হাত কেটে ফেলা হয়। কতই বা বয়স হবে সুজনের? ১০ কি ১১ বছর। তার বাড়ি কুড়িগ্রামে। অভাবের কারণে দুই বছর আগে বাবার সাথে ঢাকায় এসে পুরান ঢাকার একটি মটর ওয়ার্কশপে কাজ নেয় সে। বাবা ছেলে পাশাপাশি কারখানায় কাজ করতো। সুজন এখন পঙ্গু। মালিকের কাছ থেকে অল্প কিছু টাকা ক্ষতি পূরণ ছাড়া আর কিছুই পায়নি সে।
দেশে এমন হাজার হাজার শিশু রয়েছে যারা নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। বেঁচে থাকার প্রয়োজনেই এরা নেমেছে কঠিন সংগ্রামে। আমাদের দেশের শিশুনীতি অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু। ১৮ বছরের নিচে শিশুর ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার বিধান না থাকলেও ৬ থেকে ৭ বছরের শিশুকে অহরহ বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে দেখা যায়। শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রধান অন্তরায় শিশুশ্রম। শিশুশ্রম শুধু নির্মম বাস্তবতাই নয় পরবর্তী প্রজন্মের জন্যও ক্ষতিকর। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, দেশের ৩৪ লাখ শিশুশ্রমিকের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে ১২ লাখ ৮০ হাজার শিশু। শিশুশ্রম আইনত দ-নীয় অপরাধ। শিশুরা এমন একটি পরিস্থিতিতে শ্রম দিতে বাধ্য হয়, যেখানে তাদের ও পরিবারের অন্ন-বস্ত্রের চাহিদা মেটানো অনিবার্য হয়ে ওঠে। শিশুশ্রমের পেছনে দারিদ্র্য ছাড়াও আরো কারণ জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে নিরক্ষরতা, পিতা-মাতার অজ্ঞতা, অল্প বয়সেই অর্থ উপার্জন করার লোভ দেখিয়ে সুকৌশলে সংসারের ভার তাদের কাঁধে চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণতা অনেক অভিভাবকের মধ্যে দেখা যায়।
যে বয়সে শিশুর স্কুলে যাবার কথা, খেলাধুলায় মেতে থাকার কথা, হাসি আনন্দে বেড়ে ওঠার কথা, সে বয়সে অনেক শিশুকে ধরতে হয় সংসারের হাল। সংসারে অভাবের কারণে করতে হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার কারণে তারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। অনেকে পঙ্গুত্ব বরণ করছে সারা জীবনের জন্য আবার গৃহপরিচারিকার কাজে নিয়োজিত শিশুরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। বেশি কাজ করানো, সময়মতো খাবার সরবরাহ না করা, গৃহকর্ত্রী কর্তৃক দৈহিক নির্যাতন, আরামদায়ক বাসস্থানের সুযোগ না দেয়া, চিকিৎসা সেবা প্রদান না করা, বিনোদনের সুযোগ না দেয়া ইত্যাদি অনেক গৃহকর্তার কাছে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। শিশুশ্রম রোধে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাও কাজ করে যাচ্ছে। সরকার ইতোমধ্যে জাতীয় শিশুশ্রম নীতি ২০১০ এবং জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ প্রণয়ন করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে বিশ্ব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম বন্ধ করতে চায় জাতিসংঘ। ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম নির্মূল করার বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে এসডিজিতে। সরকার ২০২০ সালের মধ্যে ২ লাখ শিশুকে ঝুঁকিপূর্ণ পেশা থেকে সরিয়ে এনে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে। পথশিশুদের নিরাপদ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ৬টি বড় শহরে শিশুবিকাশ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। সরকারের বাস্তবমুখী পদক্ষেপের ফলে এখন শিশুরা স্কুলমুখী হয়েছে। অনেকে স্কুল সময়ের আগে এবং পরে কাজ করে থাকে। এমন শিশুর সংখ্যাও আমাদের দেশে কম নয়। কর্মজীবী শিশুদের পড়ালেখার বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ায় শিশুদের শিক্ষার হার বেড়েছে। তারা কাজের পাশাপাশি শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে। এতে তারা নিজেদের ভালমন্দ শেখার সুযোগ পাচ্ছে। কাজ করায় ক্ষতি নেই তবে সেটা যেন বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় এবং ঝুঁকিপূর্ণ না হয় সেদিকে নজর রাখতে হবে।