## মোঃ তৌহিদুল ইসলাম ## নিরক্ষরতা জাতির জন্য একটি বড় অভিশাপ। সত্তর দশক অবধি বাংলাদেশে নিরক্ষরতার হার ৮০% এর কাছাকাছি ছিল। বিদ্যালয় গমনোপযোগী বয়সী শিশুদের ৫০ শতাংশের মত শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হত। মেয়ে শিশুদের ভর্তির হার ছিল খুবই কম। যত শিশু ভর্তি হত তার একটা বিরাট অংশ পাঁচ বছর প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করার আগেই বিভিন্ন শ্রেণীতে বিদ্যালয় ত্যাগ করত। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিবর্তন ও উন্নয়নে নিরক্ষরতার এই উচ্চ হার দ্রুত হ্রাস করা অত্যন্ত জরুরী বলে বিবেচিত হতে থাকে।
নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর করার জন্য যেমন বিদ্যালয় গমনোপযোগী শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয় ভর্তি করা দরকার তেমনি তাদের ঝরে পড়া রোধ করা জরুরী। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বর্তমানে প্রায় শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও ৫ বছর মেয়াদী শিক্ষা সমাপনের পূর্বেই প্রায় শতকরা ২০ ভাগ শিশু বিভিন্ন শ্রেণীতে ঝরে পড়ে। যা প্রাথমিক শিক্ষায় একটা বড় ধরনের অপচয়। বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়া রোধ করতে না পারলে জাতিকে শিক্ষিত করা সম্ভব হবে না।
বিদ্যালয় ত্যাগ করার নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কারণ অন্যতম। পিতামাতার নিরক্ষরতা শিশুকে ঝরে পড়ার পেছনে একটি অভিপাশের মত কাজ করে। নিরক্ষর পরিবার থেকে আসা শিশুরা শিক্ষাগত দিক থেকে শুধু অসুবিধাগ্রস্তই নয়, তারা আর্থিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও পশ্চাদপদ হওয়ায় লেখাপড়ার প্রেরণা ও উৎসাহের অভাব থাকে। এছাড়াও পঠন-পাঠনে সহায়তা করার পরিবেশ তাদের পরিবার ও বাড়ীতে একেবারেই নেই। ফলে শিক্ষা জীবনের প্রথমেই পড়াশুনায় অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে থাকে। এই পিছিয়ে পড়া তাদের নিরুৎসাহের কারণ হয়।ফলশ্র“ততে তারা বিদ্যালয়ে থেকে চলে যায় অর্থাৎ ঝরে পড়ে। অনেক পিতামাতা দারিদ্র্যের কারণে বিদ্যালয়ে না পাঠিয়ে তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োগ করে।
এছাড়া রয়েছে বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও অবস্থাগত কারণ। বিদ্যালয়ে শিক্ষার পরিবেশের অভাব, শিক্ষকের আন্তরিকতা ও ভালবাসার অভাব, শিখন পরিবেশ আর্কষনীয় না হওয়া, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনিয়মিত উপস্থিতি, অভিভাবকদের বাসস্থানের পরিবর্তন, বন্যা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দীর্ঘদিন বিদ্যালয় বন্ধ থাকা, বিদ্যালয়ের দূরত্ব ও প্রাকৃতিক বাঁধা, এ সব কারণে শিশুরা নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জন না করার ফলে ঝরে পড়ে ।
শিক্ষার্থী ঝরে পড় রোধের জন্য শিক্ষকগণকে অভিভাবকদের প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। তাদের বুঝাতে হবে শিক্ষার অভাবে তাদের সন্তানরা কিভাবে পদে পদে শোষনের শিকার হয়। তাদের বুঝাতে হবে লেখাপড়া কিভাবে তাদের সন্তানদের সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্যে করতে পারে। অভিভাবকগণ যদি বুঝে শিক্ষা সন্তানদের জীবনে কিভাবে আর্থিক স্বচ্ছলতা আনবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত করবে তাহলে তারা সন্তানদের নিয়মিত বিদ্যালয়ে পাঠাতে আগ্রহী হবে। এ কাজে শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তা, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি অভিভাবকদের সাথে মতবিনিময় করলে দ্রুত ফল পাওয়া যাবে।
দারিদ্র পীড়িত ও নিরক্ষর পরিবার থেকে আগত শিক্ষার্থীদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্কুলের পরিবেশ আকর্ষনীয় ও আনন্দময় করে তুলতে হবে, যেন শিশুরা বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহী হয়। শিক্ষার্থীদের জন্য খেলাধূলার ব্যবস্থা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড জোরদার করতে হবে।
শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকের মমত্ববোধ ও সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে। শারীরিক ও মানসিক শাস্তি সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। যথাযথ উপকরণের সাহায্যে আন্তরিকতার সাথে পাঠদান করতে হবে, যেন শিশু সহজেই পাঠের প্রতি আকৃষ্ট হয়। শিশুর সৃজনশীল চিন্তা ও দক্ষতা প্রসারের জন্য ফলপ্রসু শিক্ষাদান পদ্ধতি কার্যকরী ভূমিকা পালন করবে।
শিশুদের স্ব-স্ব শ্রেণীর নির্ধারিত যোগ্যতা অর্জনে পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে আন্তরিকতার সাথে শিক্ষকের পাঠদান অত্যন্ত জরুরী। এতে শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বাড়বে, ভীতি দূর হবে এবং ঝরে পড়া উল্লেখযোগ্য হারে কমবে বলে আশা করা যায়। লেখক ঃ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, রাজবাড়ী।