॥আসজাদ হোসেন আজু॥ রাজবাড়ী জেলার কৃতি সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ট রাজনৈতিক সহচর এডভোকেট আব্দুল ওয়াজেদ চৌধুরী তার আপন গুনাবলীর মাধ্যমে রাজবাড়ী তথা এ অঞ্চলের গণমানুষের নিকট অত্যন্ত আস্থাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রামী এ সিংহ পুরুষ এ অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনো একটি প্রিয় নাম।
রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ উপজেলার কাটাখালী সম্ভ্রান্ত মুসলিম চৌধুরী পরিবারে তিনি জন্ম গ্রহন করেন। তৎকালীন গোয়ালন্দ হাই স্কুল(বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা স্কুল) থেকে ম্যাট্রিক ও কলিকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এ পাশ করার পর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে মাতৃভাষা বাংলার দাবীতে যখন ক্যাম্পাসসহ সারা দেশ উত্তাল সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে ওই আন্দোলনে অন্যতম সংগঠক ও প্রত্যক্ষ অংশ গ্রহন করে আহত হন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিয়ে এ এলাকা থেকে তিনি প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬০ সালে তিনি যশোর জেলা মুনছেফ হিসেবে চাকুরীতে যোগ দেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে চাকুরী ছেড়ে আবার প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে চলে আসেন। ওই সময় রাজবাড়ী জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতির দায়িত্ব পান। ১৯৭১সালে জেলার প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুরে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন এবং সরাসরি স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে শুরু করেন দলকে সংগঠিত করার কাজ। এ ক্ষেত্রেও তিনি আশাতিত ভাবে সফল হন। সাথে সাথে চলে তার আইন পেশা।
অল্প সময়ে এ পেশার মাধ্যমে তিনি জেলায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। নিজ দল এবং দলের বাইরে কারো আইনী সহায়তা দিতে কোন টাকা-পয়সার চিন্তা তিনি করতেন না। অসহায় দরিদ্র মানুষকে তিনি একদম বিনা পয়সায় মামলা চালিয়ে দিতেন। দীর্ঘদিন রাজবাড়ী জেলা বার এসোসিয়েশনের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫-এর ১৫ই আগষ্টের বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসকেরা অনেক লোভনীয় সুবিধার প্রস্তাব দিলেও তিনি কখনো গণতান্ত্রিক সংগ্রামের আন্দোলন থেকে পিছু হটেননি। এমনকি এরশাদ সরকারের মন্ত্রিত্ব পাওয়ার সুযোগ গ্রহন না করে তিনি এক কঠিন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ১৯৭৫ সাল থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তার নেতৃত্বেই রাজবাড়ীতে ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আন্দোলন সফল হয়। এরপর ১৯৯১ সালে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে বিপুল ভোটে রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ এলাকার মানুষ মনেই করত আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় গেলে তিনি মন্ত্রী হবেন। কিন্তু সে সময় সরকারে আসে বিএনপি। সংসদ সদস্য থাকাকালেই ১৯৯২ সালের ৩১শে জুলাই হৃদযন্ত্রের ক্রীড়া বন্ধ হয়ে তিনি ইন্তেকাল করেন।
সেই সাথে রাজবাড়ীবাসী তাদের কোন নেতা মন্ত্রী হওয়ার আশা ফিকে হয়ে যায়। ওয়াজেদ চৌধুরীর মুত্যুর পর তার প্রিয় দল আওয়ামী লীগ ৩য় দফায় ক্ষমতায় আসলেও তার স্মরনে জেলায় উল্লেখযোগ্য কিছুই করা হয়নি। তবে তার জন্মস্থান কাটাখালীতে স্থানীয় জনতা ওয়াজেদ চৌধুরী স্মৃতি সংসদ নামে একটি ক্লাব গড়ে তুলেছে। এই ক্লাবের উদ্যোগে প্রতি বছর ৩১শে জুলাই কাটাখালীতে এলাকাবাসী তার স্মরনে দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করে। আজ তার ২৫তম মৃত্যু বার্ষিকী।
মরহুম ওয়াজেদ চৌধুরীর ছোট ভাই গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা পরিষদের সদস্য হাসান ইমাম চৌধুরী বলেন, তার বড় ভাই দলের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। তার স্মরণে উল্লেখযোগ্য কিছুই করা হয়নি। এটা আমাদের একটা ব্যর্থতা। তবে তিনি জীবদ্দশায় দলমত নির্বিশেষে মানুষের যে সেবা দিয়ে গেছেন তা জেলাবাসী আজও শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করে। লেখক ঃ- সাংবাদিক আসজাদ হোসেন আজু, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী। লেখাটি পুনঃ মুদ্রণ।