রবীন্দ্রনাথ বিচারের বাণী কেন নীরবে নিভৃতে কাঁদে সে প্রশ্ন তুলেছিলেন ‘প্রশ্ন’ কবিতায়। তার পর আট দশকেরও বেশি সময় চলে গেছে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা নেই। পাকিস্তানের নিষ্ঠুর শাসন নেই। ত্রিশ লাখ মানুষের বুকের রক্ত দিয়ে আমরা বাংলাদেশ অর্জন করেছি। কিন্তু এখনও যে হৃদয়হীন মানুষের অভাব নেই। গাজীপুরের শ্রীপুরের জনপদে হালিমা বেগমকে সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে তাই বিচারহীনতার প্রশ্ন রাখতে হয়। তার স্বামী হযরত আলী ও আট বছরের পালিত কন্যা আয়েশা খাতুন গত শনিবার ট্রেনের নিচে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছেন। কেন এ আত্মহত্যাথ সেটাই তিনি অঝোরে কেঁদে কেঁদে ব্যক্ত করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকের সামনে। তিনি অভিযোগ করেন, তাদের সামান্য একখ- জমির ওপর একটি কুচক্রী মহলের কুদৃষ্টি পড়েছিল। তাদের মেয়েকে লাঞ্ছিত করা হয়েছে। গরু চুরি হয়েছে। এ ঘটনা শুনে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, অন্যায়ের প্রতিকার পাননি হযরত আলী। সম্মানে আঘাত লেগেছিল। মানসিকভাবে তিনি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কাছে হযরত আলী গিয়েছেন অন্যায়-অপমানের প্রতিকার চাইতে। এ কারণেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন তিনি। কে নেবে এই মৃত্যুর দায়? এ করুণ মৃত্যুর কাহিনী জেনে পাষাণ হৃদয়ও গলে যাওয়ার কথা। কিন্তু বুধবার সমকালের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘মামলার এজাহারে মূল অভিযোগই নেই।’ আয়েশা খাতুন তার স্বামী ও মেয়ের আত্মহত্যার জন্য কয়েক ব্যক্তির প্ররোচনাকে দায়ী করেছিলেন এজাহারে। অভিযুক্তদের নামও উল্লেখ করেছেন তিনি। তাদের মধ্যে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিরা পলাতক। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্থানীয় সমাজপতিরা যদি সময়মতো হযরত আলীর অভিযোগ আমলে নিত, তাহলে এ করুণ মৃত্যু হয়তো এড়ানো যেত। কিন্তু হযরত আলী যে গরিব! তার স্ত্রী যে এক সময় শ্রীপুর থানায় রাঁধুনির কাজ করে সংসার চালাতেন! তাদের অভিযোগ আমলে নিতে চায়নি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনাটি গণমাধ্যমে এসেছে। বাবা-মেয়ের আত্মাহুতির ঘটনা মানুষের বিবেককে নাড়া দিয়েছে। এ গুরুতর অন্যায়ের প্রতিকার হবে, দোষীরা কঠোর শাস্তি পাবেথ এটাই স্থানীয় জনগণের দাবি। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন প্রতিটি মানুষেরও একই দাবি। শক্তিমানের দাপট-দৌরাত্ম্য আমরা দেখতে চাই না। হযরত আলী ও তার শিশুকন্যার মৃত্যুর জন্য দায়ীদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান এ পথে যথাযথ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে। হালিমা তার প্রিয় স্বামী ও কন্যাকে ফেরত পাবেন না; কিন্তু অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত হলে একটু শান্তি হয়তো তিনি পাবেন।