শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৬ পূর্বাহ্ন
Logo
সংবাদ শিরোনাম ::
বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আইসোলেশন মেয়াদ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টা ও বিটার তুলনায় তিন গুণের বেশী পুনঃ সংক্রমন ঘটাতে পারে : গবেষণা প্রতিবেদন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে এক বন্দুকধারী গ্রেফতার শান্তি চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে কলম্বিয়া সফর জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণের সাক্ষাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়ায় লকডাউন করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতে নতুন করে ১০ হাজার ৩০২ জন করোনায় আক্রান্ত নভেম্বর মাসজুড়ে করাঞ্চলে কর মেলার সেবা পাবেন করদাতারা ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারী কার্যবিধি যুগোপযোগী হচ্ছে

যুদ্ধ জয়ের গল্প ‘৭১-এ যেভাবে মুক্ত হলো রাজবাড়ী’

  • আপডেট সময় রবিবার, ২৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

## মোহাম্মদ গোলাম আলী ##
১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ বাংলার মহান নেতা স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে ছাত্র-শিক্ষক-কৃষক ও মেহনতি মানুষ জেগে উঠে এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে শুরু করে। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর ২ লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৬ই ডিসেম্বর আমরা অর্জন করি স্বাধীনতা। একটি নতুন পতাকা হাতে বিজয়ের গান গেয়ে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। তবে ১৬ই ডিসেম্বর সারা দেশ স্বাধীন হলেও অবাঙ্গালী-বিহারীদের শক্ত অবস্থান থাকার কারণে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে রাজবাড়ী মুক্ত হয় ১৮ই ডিসেম্বর।
আমার কাছে এই ডিসেম্বর মাস বিভিন্ন কারণে অনেক তাৎপর্যমন্ডিত। শুধু ১৬ই ডিসেম্বরই নয়, পুরো ডিসেম্বর মাসটাই আমার জীবনে একটি আর্শীবাদ স্বরূপ। আমার মা আমাকে জন্ম দিয়েছিলেন ১৯৫০ সালের এই ডিসেম্বর মাসেরই ২২ তারিখে ভোর ৫টায়। ডিসেম্বর মাস একটি নতুন অধ্যায়ের মাস, শ্রদ্ধার মাস, স্বপ্নের মাস, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বিশ্ব মানচিত্রে নতুন দেশের আবির্ভাবের মাস। নতুন প্রজন্মের বিজয়ের জয়যাত্রার মাস।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে আমিও নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে বৃদ্ধ মা-বাবা ও স্ত্রীকে উপেক্ষা করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম একাত্তরের সেই নরঘাতক পাক-হানাদার ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে। ২৫শে মার্চের পর থেকে রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন স্থানে অত্যন্ত গোপনভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে কাজ শুরু করি। অবাঙ্গালী এবং রাজাকারদের দৌরাত্ম্য, অত্যাচার, লুট, নারী ধর্ষণ ও যুবকদের ধরে নিয়ে জবাই ইত্যাদি দেখে মনটা আমার দারুণ প্রতিবাদী হয়ে উঠে। তারপর সবাইকে ফেলে একদিন বাড়ীর পাশের কামাল ভাইয়ের সঙ্গে রওনা দেই ভারতের উদ্দেশ্যে গেরিলা ট্রেনিং এবং আধুনিক অস্ত্র সংগ্রহের আশায়। ইতিপূর্বে রাজবাড়ী রেলওয়ের মাঠে ও রাজবাড়ী সরকারী হাই স্কুলের বড় একটি কড়ই গাছের নীচে অবসরপ্রাপ্ত আর্মি সুবেদার বারী মন্ডলের কাছে অনেকের মতো আমিও গণপরিষদ সদস্য কাজী হেদায়েত হোসেনের নেতৃত্বে ট্রেনিং নেই। আমরা রাজবাড়ীবাসী যে যেভাবে পেরেছি স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। আমাদের রাজবাড়ীর অনেক ছাত্র-যুবক, মাঝ বয়সী মানুষ ভারতে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা ট্রেনিং শেষ করে গোলাবারুদ এবং হাতিয়ার নিয়ে যার যার এলাকায় এসে যুদ্ধ করেছে। আমিও আমার এলাকায় গাদা রাইফেল দিয়ে গেরিলা ট্রেনিংয়ের কিছুটা কৌশল রপ্ত করেছিলাম, তবুও বৃহত্তর সংগ্রামে মুক্তি বাহিনীতে সক্রিয়ভাবে যোগদানের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হই ছোট একটি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে। এ গ্রাম সে গ্রাম ঘুরে বেলগাছী কালুখালী রতনদিয়া হয়ে অবশেষে পাংশা থানার বাহাদুরপুর ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রামে উপস্থিত হই তৎকালীন রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি মোসলেম মৃধার বাড়ীতে। তখন ঠিক সন্ধ্যা। তার এক ছেলে মোঃ খবির উদ্দিন মৃধা একজন মুুক্তিযোদ্ধা। আমার সঙ্গী কামাল ভাইয়ের বড় বোনের দেবর। সেই সুবাদেই আমাদের প্রথম এখানে আসা। আমরা খবর পাই, ক’দিন পূর্বে পাংশা অঞ্চলের কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা ভারত থেকে ট্রেনিং এবং গোলাবারুদ নিয়ে এখানে এসেছেন। আমার উৎসাহ-উদ্দীপনা বেড়ে গেল। যেভাবেই হোক তাদের সঙ্গে আমরা দেখা করবো। আমরা দু’জনে নাম-ঠিকানা লিখে পাঠিয়ে দিলাম। তারপর অপেক্ষা করতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর ক’জন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র উঁচিয়ে আমাদের ঘরে ঢুকে পড়ে। আমরা দু’জন দাঁড়িয়ে সালাম বিনিময় করি। একজনের মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল, সে মুখের কাপড় সরিয়ে ফেলে। এ-কি! দোস্ত তুমি? উভয়ে উভয়ের বুকে জড়িয়ে ধরলাম। সে আর কেউ নয়, আমারই সহপাঠী মোঃ জিল্লুল হাকিম। বর্তমানে রাজবাড়ী-২ (পাংশা-বালিয়াকান্দি-কালুখালী) আসনের এমপি মোঃ জিল্লুল হাকিম। তার কাছ থেকে অনেক গল্প শুনলাম। আমিও রাজবাড়ীর অবাঙ্গালীদের অত্যাচারের কথা বললাম। রাজাকার, মিলিশিয়া, পাক-হানাদারদের অত্যাচারের সেই বিভৎস কাহিনীর বর্ণনা দিলাম। তারপর আমরা ভারতে যাবার জন্য কোন পথের কি অবস্থা জানতে চাইলাম। জিল্লু বললো, দোস্ত, তোমাদের এখন ভারতে যাওয়া ঠিক হবে না, বর্ডার সীল করে দিয়েছে। ভারত-পাক সেনারা প্রায় মুখোমুখি অবস্থান করছে। আমরা খুব ঝুঁকি নিয়ে এসেছি। তোমরা যে পথেই যাও, কোনোটাই নিরাপদ নয়, বরং তোমরা দু’জনে এখানে থেকে আমাদের সাথে যুদ্ধ করো। কারণ, ভারত থেকে ট্রেনিং করা মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা আমাদের ইউনিটে খুবই কম। তোমাদের মতো বন্ধু আমাদের দরকার। প্রয়োজনীয় ট্রেনিং আমরা তোমাদের দিয়ে দিব। তোমরা আমাদের সঙ্গে থেকে যাও। এরপর আমাদের আর ভারত যাওয়া হলো না। দলপতি(কমান্ডার) জিল্লুল হাকিমের কথা মতো আমরা বাহাদুরপুরে থেকে গেলাম। জিল্লু বললো, মুক্তিযোদ্ধা বাড়লেই আমাদের শক্তি বৃদ্ধি পাবে। শত্রু পক্ষের হাতিয়ার ছিনিয়ে আমাদের অস্ত্রভান্ডার সমৃদ্ধ করবো। দোস্ত, তোমরা আমাদের সঙ্গে থাকলে রাজবাড়ী খুব তাড়াতাড়ি শত্রুমুক্ত করব ইনশাল্লাহ্। তারপর আর ভারতে যাওয়া হলো না।
আমরা বাহাদুরপুর গ্রাম থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনিং সমাপ্ত করে জিল্লুর নেতৃত্বে কিছুদিন পাংশা শহরে রেলস্টেশন সংলগ্ন একটি পরিত্যাক্ত হিন্দু মারোয়ারীর দোতলা বাড়ীতে অস্থায়ী ক্যাম্প করি। আমরা রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া রেলপথের দু’দিকের রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে পাংশা মুক্ত করি। এর ক’দিন পর কালুখালীর রতনদিয়া হাই স্কুলে অবস্থান নেই। তার ক’দিন পর বেলগাছী হয়ে সূর্যনগরের হোসেন খন্দকারের বাড়ীতে অবস্থান নিয়ে, পরদিন রাজবাড়ী থানার অস্ত্রভান্ডার লুট হওয়ার খবর পেয়ে আমরা ৬/৭জন মুক্তিযোদ্ধা হাতিয়ারসহ রাজবাড়ী থানায় আসি। সেখানে এসে দেখতে পাই ওসি সাহেব পুলিশ কনস্টেবলদের সঙ্গে নিয়ে মাটিপাড়ার দিকে চলে গেছেন। থানার পাশে দেখলাম ডাঃ উজির অনেকগুলো বন্দুক এবং কয়েকটি রাইফেল(থ্রি নট থ্রি) একসঙ্গে বেঁধে রিক্সায় করে নিয়ে যাচ্ছে। আরো অনেককে দেখলাম, সবাই খালি হাতে থানায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি এই ফাঁকে আমার সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের থানায় রেখে শুধু প্যান্টের পকেটে ২টা গ্রেনেড নিয়ে বেড়াডাঙ্গায় নিজ বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা দেই। বাড়ীতে এসে দেখতে পাই, আমার আব্বা বাড়ীতে একা জানালা খুলে রাস্তার দিকে চেয়ে আছেন। আমাকে দেখামাত্রই খুব দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। অনেক প্রশ্ন করলেন। আমি একে একে সব প্রশ্নের উত্তর দিলাম। আব্বাকে বাড়ীর মধ্যে নিয়ে গেলাম। মা-স্ত্রী এবং অন্যদের কথা জিজ্ঞাসা করলে আব্বা বললেন, তারা সবাই পাঁচুরিয়ার এক বাড়ীতে আছে। তোমার কথা মনে হলেই তোমার মা শুধু কাঁদতে থাকে। বিহারী আর রাজাকাররা মিলে গ্রামে গ্রামে ঢুকে হিন্দু-মুসলিমদের বাড়ী লুট করছে, মানুষ ধরে নিয়ে আর ফেরত দিচ্ছে না। তিনি আমার ডান হাতটি শক্ত করে ধরে রাখলেন। আমি হাত ছাড়াতে চাচ্ছি, কিন্তু ছাড়াতে পারছিনা। আমি বুঝতে পারছি আব্বা আমাকে আর হারাতে চান না, চোখের আড়াল হতে দিতে চান না। আমি বুঝতে পারলাম আব্বা আমার হাতটা শক্ত করে ধরার কারণটা কি? আব্বাকে বললাম, আব্বা হাতটা ছাড়েন, আমাকে এখনই যেতে হবে। একজনের সাইকেল নিয়ে তাকে থানায় বসিয়ে রেখে এসেছি। তাছাড়া আপনি এখান থেকে গ্রামে মায়ের কাছে চলে যান। বিহারী আর মিলিটারী রাজবাড়ী বাজার এলাকায় অবস্থান করছে, যখন-তখন গ্রামে ঢুকে পড়তে পারে। আব্বা আমাকে তার কাছে রাখা পিতলের তৈরী ফালাটা দেখিয়ে বললেন, আমার কাছেও অস্ত্র আছে! আব্বাকে বাড়ীতে এইভাবে একা ফেলে আমি কিছুতেই চলে যেতে পারিনা। বিহারী এবং মিলিশিয়াদের বর্তমান অবস্থা আব্বাকে বোঝানোর পর আব্বা ঘরে তালা দিয়ে আমার সঙ্গে বাড়ী থেকে বের হলেন। আমি তাকে দাদশী-কামালপুর যাওয়ার কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়ে পুনরায় রাজবাড়ী থানায় ফিরে আসি। সারাটা শহর থম্থম্ খাঁ খাঁ করছে! এর মধ্যে লক্ষ্য করলাম, রানার আলম একটা সাব-মেশিনগান(এসএমজি) হাতে নিয়ে প্রধান সড়ক দিয়ে হেঁটে(পিছন ফিরে) পৌরসভার দিকে আসছে। আমার সঙ্গে দেখা হলো- কথা বিনিময় হলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আপনি পিছন ফিরে দৌড়াচ্ছেন কেন? সে বললো, রাজবাড়ী বাজারে বিহারী আর মিলিশিয়া এসে ভরে গেছে। তুমি তাড়াতাড়ি এখান থেকে পালাও। কথাগুলো শুনতে শুনতে আমি সাইকেল চালিয়ে রাজবাড়ী থানায় এসে পৌঁছালাম। মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুদের সাথে দেখা করে তাদের কাছে সব ঘটনা খুলে বলি। খুব তাড়াতাড়ি থানা থেকে বেরিয়ে পড়ি। থানা থেকে কিছুদুর এগোতেই (পৌরসভার পাশে শেখর মেম্বারের বাড়ীর সামনে) দেখি রানার আলম তার এসএমজি কাঁধের উপর রেখে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি আমার সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। মূহুর্তের মধ্যেই এক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গেল। আলম তার অস্ত্রটি কাঁধ থেকে নামিয়ে আমাদের দিকে তাক করতেই আমি চিৎকার করে উঠি এবং সঙ্গে সঙ্গে ফলডাউন করি(শুয়ে পড়ি)। ততক্ষণে তার হাতের অস্ত্রটির মধ্য থেকে বেরিয়ে এলো একঝাঁক গুলি! আমরা হতবাক হলাম! আলম কী মুক্তিযোদ্ধা না রাজাকার? মুক্তিযোদ্ধা হলে কি করে আরেক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি গুলি করে? আমরা দ্রুত রাস্তা এবং খাদের মধ্যে দিয়ে গড়াতে গড়াতে নারায়ণ চক্রবর্তীর আম বাগান এবং পুকুরের ধার দিয়ে মাঠের মধ্যে চলে যাই। একটি জায়গা দেখে বসে পড়ি। আলোচনা শুরু করি। সিদ্ধান্ত নেই যে করেই হোক এর প্রতিশোধ আমরা বেঁচে থাকলে নেবই। তারপর আমরা বাগমারা হয়ে সূর্যনগর গ্রামে হোসেন চেয়ারম্যানের বাড়ী চলে যাই। ঠিক দুপুরের পর আমরা সবাই মিলে চরনারায়ণপুর স্কুলে গনি ডাক্তারের বাড়ীর কাছে উপস্থিত হই। সেখানে দেখা হয় মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার লালী ভাইয়ের সঙ্গে। অত্যন্ত সোহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে আমরা কয়েক ঘন্টা সময় কাটাই। লালী ভাইদের খাবারের অংশ থেকে তারা এবং গ্রামবাসীরা আমাদেরকে খাওয়ান। আমাদের দলপতি জিল্লু ও দলপতি ডাঃ লালী ভাই একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেয়, আমাদের ইউনিট ধুঞ্চি সিলিমপুর প্রাইমারী স্কুলে ক্যাম্প করে আজকে রাতেই ত্রিমুখী আক্রমন করে নিউ কলোনীর বিহারী-মিলিশিয়াদের দূর্গ চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিব! এইভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে পড়ি। লালী ভাই উড়াকান্দা বাজার এলাকায় অবস্থান নেওয়ার জন্য রওনা দেন, আর আমরা রওনা দেই ধুঞ্চি সিলিমপুর প্রাইমারী স্কুলের উদ্দেশ্যে। এখানে একটি ঘটনার কথা না বললেই নয়, আমাদের ধুঞ্চি যাওয়ার পথে প্রথমেই হেদায়েত মওলা লাল ভাই, বাচ্চু ভাই, আজিজ ভাইসহ আরো অনেকে আমাদেরকে অগ্রীম শুভেচ্ছা ও সাদর আমন্ত্রণ জানানোর জন্য চরনারায়ণপুর প্রাইমারী স্কুল পর্যন্ত আমাদের এগিয়ে আনতে যান। ঠিক সন্ধ্যার পূর্বেই আমরা ধুঞ্চি সিলিমপুর প্রাইমারী স্কুলে এসে পৌঁছাই। সেদিন ছিল ১৫ই ডিসেম্বর। আমাদের আসার কথা শুনে গ্রামের যুবক-বৃদ্ধ এবং মা-বোনেরা ছুটে আসে আমাদেরকে একনজর দেখার জন্য। লাঠি-ঢাল-ফালা-সরকি-দা ইত্যাদি সবার হাতে হাতে। কারো হাতই খালি দেখলাম না। সবাই আনন্দে উল্লাস করতে থাকে। এতদিনে তারা যেন প্রাণ ফিরে পেলো। তারা চারদিক থেকে আমাদেরকে বেষ্টনী দিয়ে রাখলো। আমরাও তাদেরকে শান্তনা দিচ্ছি, ভয় নাই আজ রাতের মধ্যেই সম্পূর্ণ বিহারী কলোনী(নিউ কলোনী), আটাশ কলোনী, বাজারের কিছু অংশ আমরা ঘিরে তাদের অবরোধ করে রাখবো ইনশাল্লাহ্। গ্রামে আর বিহারী ঢুকে কারো বাড়ী থেকে যুবক ছেলেদের ধরে নিয়ে যেতে পারবে না। মা-বোনের ইজ্জত নিতে পারবে না, বাড়ী-ঘর লুট করতে পারবে না, আগুন দিতেও পারবে না। ধুঞ্চি গ্রামবাসী আমাদের কথা দিলো তারা সবসময় আমাদের পাশে থাকবে। রাতে বিভিন্ন বাড়ী থেকে যে যা পারছে আমাদের মুক্তি-ভাইদের জন্য খাবার আনছে। মোফাজ্জেল হক(চাল ব্যবসায়ী), নিয়ামত আলী, আবুল হোসেন, রোস্তম মিয়া (হোটেল ডিলাক্সের মালিক), মনা ভাই, লাল ভাই, মুসা ভাইসহ আরো অনেকেই আমাদের সহযোগিতা এবং খাবার-পানি যা লাগে সব সরবরাহ করেন। রাতে আমরা ক’জন মুক্তিযোদ্ধা জিল্লুল হাকিম, সাবু ভাই, কাজী মাহাবুব ভাই, বাবুল ভাই, মালেক ভাই, লুলু ভাই, আমি(গোলাম আলী), কামাল ভাই, লাল ভাইসহ আরো ক’জন মিলে স্কুলের একটি ক্লাসরুমে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করি। সেখানে পজিশন নেওয়ার জন্য আমি একটি নক্সা প্রস্তুত করি দলপতির নির্দেশে। আমি তিনটি জায়গা বেছে নেই-একটি জায়গা কাজী হেদায়েত হোসেনের শ্বশুর বাড়ীর কাছে, একটি মাহফিল ঘর বা ধুঞ্চি খানকা শরীফের পাশে ছনের পালান, আর একটি জায়গা হলো আটাশ কলোনীর কাছে আবুল হোসেনের বাড়ীর দক্ষিণ দিকে পোদ্দারের পুকুর চালার পাশে ছোট্ট একটা কালভার্টের কাছে অনেকগুলো তালগাছের ঝোপের আড়ালে। আমরা এক একটি গ্রুপে ভাগ হয়ে ত্রিমুখী আক্রমণ করার একটি পরিকল্পনা করি। ১০জন করে মুক্তিযোদ্ধা প্রতিটি গ্রুপে ভাগ করে দেয়া হয়। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীরা আমাদের স্কুলের ক্যাম্পটির চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখে। রাতের খাবার খেয়ে আমরা পাহাড়া দেই, গ্রামে যেন কোন বিহারী ঢুকতে না পারে। আমাদের দলপতির নির্দেশ ছিল ঠিক ভোর যখন ৪টা বাজবে, তখন তিন দিক থেকে একসঙ্গে ফায়ার শুরু করব। ওরা যেন কোনভাবেই বুঝতে না পারে ঠিক কতজন মুক্তিযোদ্ধা ওদের চারপাশ ঘিরে ফেলেছে। মাঝে মাঝে থেকে থেকে ফায়ার করতে হবে। পাশাপাশি সকাল হবার সাথে সাথে গ্রামবাসীরা একত্রিত হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের পিছনে গিয়ে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলা মুক্ত কর, বিহারী-রাজাকার খতম কর ইত্যাদি সব শ্লোগান দিতে বলা হলো। অবশেষে তাই করা হলো।
আমাদের ১ম ইউনিটের বা দলের লিডার বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী মাহবুব ভাই (সদ্য প্রয়াত আর্কিটেক ইঞ্জিয়ার) বিচক্ষণতার সাথে মাহফিল ঘর বা ধুঞ্চি খানকা শরীফ মসজিদের পাশে অবস্থান নিয়ে ধীরে ধীরে নিউ কলোনীর উত্তর পাশে বিনোদপুর নতুনপাড়া রাস্তার দিকে এগোতে থাকে। পালানের(মাঠ) ছন গাছের ঝোঁপ-ঝাড়ের মধ্য দিয়ে ১০জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল নিউ কলোনীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। চারদিক থম্থম্ করছে, কালো অন্ধকার রাত। কিছু পথ এগোতেই সামনে রাস্তা, তারপর কয়েকটি বাড়ী এবং গভীর খাল, তারপর নিউ কলোনীর উত্তর দিকের প্রথম কোয়াটার। মাহাবুব ভাই আমাদের দল থেকে সামনের দিকে একটু বেশী এগিয়ে গেছেন। ঠিক রাস্তার কাছাকাছি এগোতেই রাস্তার ওপার থেকে রাতের নিস্তব্ধতা ভেদ করে আচমকা অনেকগুলো চাইনিজ রাইফেল থেকে গুলি বেরিয়ে আসে। আমাদের পক্ষ থেকেও শুরু হয় পাল্টা আক্রমন। ওদের (বিহারী-মিলিশিয়া) আক্রমনের ধারাগুলো ছিল এলোমেলো। বিনোদপুর নতুনপাড়ার রাস্তার পাড় ঘেঁষে শুধু বাংকার আর বাংকার! এসব বাংকারগুলো এতোটাই সুরক্ষিত যে মাটি গর্ত করে তার উপর চালা দিয়ে, তারপর মাটি দিয়ে ঘাস লাগিয়ে গাছের ডালপালা দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। একদম কাছ থেকে দেখেও কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই, এখানে বাংকার আছে। এক বাংকার থেকে অন্য বাংকারে অনায়াসেই যাওয়া যায়। বাংকারের মধ্যে খাবার এবং শোয়ার ব্যবস্থাও আছে। শুকুর আলী স্থানীয় সাহসী এক মুক্তিযোদ্ধা। সে আমাদের সামনে মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। হাতে তার ধারালো একটা সোল। সেই সোল দিয়ে ঝোঁপ-ঝাড় পরিষ্কার করতে করতে বীরদর্পে এগিয়ে যাচ্ছিল। রাতের মৃদু মৃদু আওয়াজ আর মুক্তিযোদ্ধাদের ফিস্ফিস্ কথা বলার আওয়াজগুলো একত্রিত হয়ে ভয়ঙ্কর কিছু ওদের সামনে তেড়ে আসছে এই ভয়ে ওরা(বিহারী) হঠাৎ করে এলোপাথারিভাবে চাইনিজ আর থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে গুলি ছুড়তে থাকে। সেগুলো ঘন জঙ্গলে বাঁশ বাগানের গায়ে এসে ফট-ফটাস্ করে শব্দ হচ্ছে। ঠিক তখনই একটা অঘটন ঘটে গেল। হঠাৎ শুকুর চিৎকার করে লাফিয়ে উঠে মাটিতে লুটয়ে পড়লো। আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই লাল লাল রক্তে তার শরীরটা ভিজে গেল। তাকে ধরাধরি করে খুব দ্রুত সরিয়ে নেয়া হলো। এর কিছুক্ষণ পরই সে শাহাদতবরণ করলো।
সকাল হওয়ার আগেই নির্ভীক সাহসী মুক্তিযোদ্ধা কাজী মাহবুব ভাই ছট্ফট্ করতে করতে ক্রমেই সামনের দিকে (নিউ কলোনীর দিকে) এগোতে থাকে। পিছন থেকে আমরা তাকে বারবার সাবধানে এগোতে বললেও সে কোন কথাই কানে তুলছে না, শুধুই এগিয়ে যাচ্ছে। চিরশত্রু পাক-দোসর ও হানাদারদের দূর্গ চুর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে। রাস্তার চারদিকে শুধু বাংকার আর বাংকার। মাহবুব ভাই রাস্তা পার হয়ে নিউ কলোনীর ১ম কোয়াটারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সামনেই বড় একটা খাল, সেখানে কোন পানি নাই। সেই খালে নামতেই উপস্থিত হলো ভয়ংকর বিপদ। মাহাবুব ভাইকে লক্ষ্য করে ওরা হঠাৎ শুরু করলো ফায়ার! চাইনিজ রাইফেলের কয়েকটি গুলি বেরিয়ে এলো। আমরা ক’জন সতর্কভাবে তার পিছনে পিছনে এগিয়ে যাচ্ছি। আমরা দূর থেকে লক্ষ্য করলাম মাহাবুব ভাই চিৎ হয়ে হঠাৎ পড়ে গেল মরা মানুষের মতো! আমরা চিৎকার করে উঠলাম, জয় বাংলা বলে শ্লোগান দিয়ে আকাশ ভারী করে তুললাম! মাহাবুব ভাই কি আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেল নাকি ? হালকা কুয়াশা ভেজা পূর্ব দিগন্তের রবি শশী তখনো তার রবি কিরণ আকাশে মেলে ধরেনি। তারপর সব চুপচাপ। নিস্তব্দ হয়ে গেল। দূর থেকে মাহাবুব ভাইকে লক্ষ্য করলাম, কিছুক্ষণ পর তিনি আস্তে আস্তে বুকের মধ্যে থেকে এসএলআরটি বের করে মাথাটা ঘুরিয়ে কাঁধের সঙ্গে ঠেকিয়ে দূরে একটা বাংকারকে লক্ষ্য করে মরা মানুয়ের মতো কাত হয়ে পড়ে রইলো। খালের উপরে নিউ কলোনীর(উত্তর দিকে) ১ম কোয়াটার। তার কিছ দূরে একটা উঁচু ভিটার উপরে গাছের ডাল-পালা দিয়ে ঢাকা, কোনভাবেই বোঝার উপায় নেই যে, সেটা একটা সুরক্ষিত বাংকার! তার মধ্য থেকে দেখা গেল চাইনিজ রাইফেল হাতে একজন হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে এলো। মূহুর্তের মধ্যে মাহাবুব ভাইয়ের এসএলআরটি থেকে শুরু হলো ফায়ার। চাইনিজ রাইফেল হাতে যে লোকটি বাংকার থেকে বের হচ্ছিল তার মাথাটি ব্লাস্ট হয়ে সশব্দে ফেটে গেল। চারদিকে থমথমে ভাব। একটু পরে আর একজন ঐ একইভাবে বের হচ্ছিল, ঠিক তখনই আবার মাহাবুব ভাইয়ের ফায়ার। এই লোকটির মাথাও পূর্বের লোকটির মতো ব্লাস্ট হয়ে গেল। তার কিছুক্ষণ পর আরেকজন অত্যন্ত সর্তক দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাইফেলটি তাক করে যেই আমাদের দিকে ফায়ার করবে, তখনই মাহাবুব ভাইয়ের হাতের এসএলআরটি আবারও গর্জে উঠলো। এবারও লক্ষ্যভেদ হলো মাথার খুলিতে। পর পর এইভাবে ৩ জন বিহারীর মাথার খুলি উড়ে গেল এভাবে। মাহাবুব ভাই তখনও নিশ্চুপ-নিথরভাবে কাত হয়ে শুয়ে আছে, কোন নড়াচড়া করছে না। আহত, মৃত না জীবিত কোন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না দূর থেকে। কিন্তু আমরা এটুকু বুঝতে পারছি যে মাহাবুব ভাই সত্যিই একজন বীর সেনানী। অনেকক্ষণ তিনি ওইভাবেই শুয়ে থাকলেন, তারপর জয় বাংলা বলে উঠে বসলেন। আমরা সবাই জয় বাংলা বলতে বলতে তাকে জড়িয়ে ধরলাম। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। ততক্ষণে পূর্ব আকাশে নতুন এক আলোর ঝলকানি গাছপালার পাতার ফাঁকে ফাঁকে যেন বিজয়ের আলো উঁকি দিচ্ছে। চারদিক মানুষের বিভিন্ন শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে। এরপর খুব দ্রুত আমরা ১ম কোয়াটারের পাশে গর্ত করে বাংকার তৈরী শুরু করে দিলাম। আমাদের কাছে ১টা এলএমজি ছিল। সেটা ব্যবহার করতেন মুক্তিযোদ্ধা সাবু ভাই। আমাদের গ্রুপে ওই একটা এলএমজিসহ ৬টি এসএলআর, ১৫টি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, বেশ কিছু গ্রেনেড এবং কয়েকশ রাউন্ড গুলি ছিল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সকল মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীরা জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুু, বিহারী-রাজাকার-মিলিশিয়াদের খতম করো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো ইত্যাদি শ্লোগান দিতে লাগলো। চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে যেতে লাগলো। সেটা স্বচোক্ষে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। ইতিমধ্যেই ধুঞ্চি গ্রামবাসীর গণজোয়ারে ভেসে মুখরিত হয়ে ওঠে সারাটা গ্রাম। এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর। কে দেবে তাদের খাবার ? এই কথা ভাবতে ভাবতেই আমাদের সামনে গামলা ভরা সুঘ্রানের খিচুিড় দেখে আমরা লাফিয়ে উঠলাম, ভুলে গেলাম সামনে আমাদের শত্রুদের অবস্থানের কথা। আমরা সবাই অনেক খেলাম। তারপর বিশ্রাম নিলাম, ঘাসের পর শুয়ে পড়লাম। হঠাৎ কোয়াটারের ছাদ ও বটগাছের উপর থেকে শুরু হলো ফায়ার। আমরা দ্রুত গা ঝাড়া দিয়ে রাইফেল হাতে পজিশন নিলাম। দেখতে পেলাম ভাজনচালার পুকুরপাড় ও বাজার পাঠশালার পিছন দিক থেকে মিলিশিয়া পোষাক পড়া অর্ধ শতাধিক পাক দোসর আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। বাংকার থেকে সাবু ভাই ও আমি প্রথমে তাদেরকে দেখতে পাই। সঙ্গে সঙ্গে সাবু ভাই তার এলএমজি থেকে পর পর কয়েকটি ফায়ার করলেন। তখন ওরা দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে নিউ কলোনীর পাশে মসজিদের দিকে চলে গেলো।
বিকাল হওয়ার আগেই আমাদের গোলাবারুদ বা রসদ প্রায় শেষ হয়ে এলো। তখন কমান্ডার জিল্লুর সাথে আলাপ করে মালেক ভাই একজনকে সঙ্গে নিয়ে সাইকেলযোগে মাটিপাড়ার দিকে রওনা হন। কৌশল হিসেবে বাবুল ভাই, লুলু ভাই, মাহাবুব ভাই, কামাল ভাইসহ আমরা মাঝে মাঝে কোয়াটারের মধ্যে বোতল-পেট্রোল-তেল-খোয়া ও পাটের দড়ি দিয়ে কৃত্রিম ‘বোতল-বোমা’ বানিয়ে আগুন লাগিয়ে নিক্ষেপ করতে থাকি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। এরপর ওদের গোলাগুলির শব্দ বেড়ে গেল। আমরা থেকে থেকে ফায়ার করছি। কারণ আমাদের কাছে আর মাত্র অল্পকিছু গুলি আছে। এরই মধ্যে মালেক ভাই গোলাবারুদসহ যশোরের কমান্ডার কামরুজ্জামান ভাই ও তার সঙ্গীয় ইপিআরের কিছু সদস্যকে নিয়ে আমাদের সাথে যোদ দিলেন। তারা আমাদেরকে কিছু গোলাবারুদ দিলেন। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যেভাবেই হোক আমরা রাতে এখানেই থাকব এবং জোরালো আক্রমন চালাবো। আমরা যদি পিছু হটে এলাকা ত্যাগ করি তাহলে ওরা বিনোদপুর-ধুঞ্চি-কলেজপাড়া জ্বালিয়ে পুড়িয়ে তছনছ করে দেবে, নিরীহ মানুষগুলোকে পাখির মতো গুলি করে মারবে। আমাদের উপস্থিতি ওদের কাছে ভয়ঙ্কর মনে হওয়ায় মরণ কামড় দিয়ে সারা রাত এলোমেলোভাবে ফায়ার করতে লাগল। ভোরে ওদের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হলো। আর কোন শব্দ নেই। আমরা আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা কোয়াটারগুলো সার্চ করতে থাকি এবং কয়েকটির কাঠের দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করে বেশ ক’জন পুরুষ সদস্যকে(মহিলা ও শিশুদের বাদে) বের করে তাদেরই গর্ত করা বাংকারের মধ্যে ফেলে গুলি করা হয়। প্রত্যেক বিহারী মিলিশিয়াদের কাছে চাইনিজ থ্রি নট থ্রি রাইফেল ছিল একাধিক এবং ঐ সব বাসার মধ্যে গ্রাম-শহর থেকে আনা লুটের মালামালে ভরপুর ছিল। এমনকি গ্রাম থেকে কত নিরীহ মানুষের গরু, ছাগল, থালা-বাসন, সাইকেলসহ বাজার থেকে আনা সিগারেট, বিস্কুট, চিনি, চাউল, ডাউল, আটা আরো কতো কি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা বিহারীদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। তাদের অবস্থান গাছে, বাসার ছাদে পানির ট্যাংকে, মসজিদের ভিতর বহু বিহারী মিলিশিয়া অবস্থান করছিল অস্ত্র হাতে। তাদের গুলিতে আমাদের বেশ ক’জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হয় এবং একজন শহীদ হন।
এরপর মালেক ভাই, জিল্লু, সাবু ভাই, বাবুল ভাই, লুলু ভাই, কাজী মাহাবুব ভাইসহ আরো কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে নিউ কলোনী মসজিদটি সম্পূর্ণ ঘিরে ফেলি। দেখা যায় ঐ মসজিদের মধ্যে বেশ কিছু বিহারী ও মিলিশিয়া রাইফেল, বন্দুক, চাইনিজ রাইফেল নিয়ে আত্মগোপন করে ওঁৎ পেতে আছে। আমরা তাদেরকে আত্মসমর্পনের সুযোগ দেই। তারা সেই সুযোগ গ্রহণ না করে পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। তারপর ওদের প্রতিরোধ মোকাবেলা করে আমরা অনেকক্ষণ চেষ্টার পর তাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে আনি। তাদের হাতিয়ারগুলো নিয়ে তাদেরকে বন্দী করি। আমরা দুই দিন এক রাত যুদ্ধ করে নিউ কলোনীর পাক দোসরদের খতম করে মুক্ত করি। আমরা নিউ কলোনী (প্রায় দশ হাজার বিহারীদের আবাসস্থল) বিহারী ও মিলিশিয়াদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের সুরক্ষিত দূর্গ ভেঙ্গে চুরমার করে দেয়ার পর মুজিব বাহিনীর কয়েকজন যোদ্ধা সেখানে এসে ঢুকে পড়ে। ততক্ষণে অবশ্য যুদ্ধ শেষ। অনেক বিহারী-মিলিশিয়া তাদের অবস্থান ত্যাগ করে পূর্বের রাতেই ফরিদপুর-কুষ্টিয়ার পথে রওনা দেয়। এভাবেই রাজবাড়ীর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল মুক্ত হয়। পরাজিত হয় পাক-দোসর হানাদার বাহিনীর শত্রুরা।
অপরদিকে রাজবাড়ীর অন্য প্রান্তে (পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল) আমাদের আরো বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন। রাজবাড়ীর লোকসেড এলাকার যুদ্ধে পাংশা-মাছপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মতিন ভাইয়ের (পরবর্তীকালে রাজবাড়ী-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া) ইউনিট সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তারা বিহারীদের সুরক্ষিত ঘাঁটি ভেঙ্গে চুরমার করে লক্ষ্মীকোল, নূরপুর, বিনোদপুর, রাজার বাড়ী এলাকা শত্রুমুক্ত করে। মতিন ভাইয়ের সঙ্গী ৩জন মুক্তিযোদ্ধা (রফিক, শফিক ও সাদি) ওই যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন। অন্য একটি প্রান্ত থেকে (বেড়াডাঙ্গা-চককেষ্টপুর) থেকে লোকসেড অভিমুখে বিহারী মিলিশিয়াদের শক্ত ঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমন করার সময় বীর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ইলিয়াছ ভাই বিহারীদের গুলিতে গুরুতর আহত হন। তার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি বুলেট বিদ্ধ হয়। খুব দ্রুত মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীরা তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে চিকিসার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে সরকারীভাবে রাশিয়ায় নিয়ে চিকিৎসা করানোর পর তিনি সুস্থ্য হয়ে দেশে ফিরে আসেন। এছাড়া রাজবাড়ী-ফরিদপুর মহাসড়কের আলাদীপুর এলাকার একটি ব্রীজ উড়িয়ে দেয়ার অপারেশনের সময় সেখানে পাক আর্মি ও রাজাকারদের সঙ্গে যুদ্ধে বীর মুক্তিযোদ্ধা আঃ আজিজ খুশি গুরুতর আহত হন এবং পরে শাহাদতবরণ করেন। এই ভাবে নাম জানা-অজানা অনেক সাধারণ মানুষ ভারত ফেরত মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের সঙ্গে থেকে তাদেরকে আশ্রয়, খাবার, পথ দেখানো, শত্রু ঘাঁটি চিনিয়ে দেয়া, ছদ্মবেশে অতর্কিতভাবে শত্রুর ঘাঁটিতে গ্রেনেড বা বোমা নিক্ষেপ ইত্যাদি কাজে সার্বিক সহযোগিতা করেন। এমন নজির বাংলাদেশের ঘরে ঘরে, প্রায় সব গ্রামাঞ্চলেই আছে। তারা কি আজ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন বা কখনো পাবেন ?
দুঃখ লাগে আজ এখনো অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা তাদের স্বীকৃতি, সম্মান ও আত্মত্যাগের সম্মানটুকু পায় নাই। যাদের বাড়ী স্বাধীন হওয়ার পর তল্লাশী করে লুটের মালামাল উদ্ধার করলাম, তারাই আজ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা! লুটেরা রাজাকার হয়েও আমাদের কিছু লিডারদের সহযোগিতায় তারা আজ প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। সরকারের সম্পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক সহযোগিতা সব তারাই পাচ্ছে। এভাবে ‘প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া’ দ্বিধাদ্বন্দ্বে অথবা কারো কারো ব্যক্তিগত পছন্দের তালিকায় রেখে অথবা বাদ দিয়ে নিজেকে মহান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারের স্বীকৃতি-পত্র গেজেটভূক্ত করে রেখেছেন। বড়পুল এলাকার একজন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ইন্ডিয়ান কোন ক্যাম্পে ট্রেনিং না নিয়ে, কোন এলাকায় যুদ্ধ না করে রাজবাড়ী মুক্ত হওয়ার ক’দিন পর কোনভাবে একটা হাতিয়ার যোগাড় করে কাঁধে ঝুঁলিয়ে লাফালাফি করলেই কি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়? মৃত্যুর পর সরকারী গার্ড অব অনার হয়তো তারা পাবে কিন্তু মুক্তিকামী দেশপ্রমিক মানুষ (মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন এই এলাকার মানুষ যারা আজও বেঁচে আছেন) জানে ঐ ব্যক্তিটির কথা ও তার দাপটের কথা। তাদের পরিবারের সবাই আজ মুক্তিযোদ্ধা! আমরা জানতে চাই, ঐ পরিবারের প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যাটি কত? এই প্রশ্নটা রেখে গেলাম রাজবাড়ীর দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিপ্রেমিক ভাইদের কাছে? বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, মা-বোনদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে যারা আজও বেঁচে আছেন দুঃখ দারিদ্রের কষাঘাতে অথবা বিশাল সম্পদের বৈভবে ৭১’এর পর থেকে এই দেশে, এই রাজবাড়ীতে। তারা কি কোনদিন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের এই সোনার বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের লালিত স্বপ্নের নাগরদোলায় চড়তে পারবে? রবীন্দ্র-নজরুল, জীবনানন্দ-লালন, জসিম উদ্দীন, সামসুর রাহমান, জয়নুল আবেদীনের দেশে মাথা উঁচু করে বলতে পারবে-‘আমরা মুক্তিযুদ্ধের সৈনিক ছিলাম?’

নিউজটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
error: আপনি নিউজ চুরি করছেন, চুরি করতে পারবেন না !!!!!!