অনেকের হাতেই অর্থ আছে, তাঁরা বিনিয়োগও করতে চান। কিন্তু ঘাটে ঘাটে নাকানি-চুবানির ভয়ে তাঁরা সে পথে পা বাড়ান না। অনেকে জমানো অর্থ নানা উপায়ে বিদেশে পাচার করেন এবং উন্নত দেশে নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চান। অনেকে আবার ব্যাংকে স্থায়ী আমানত, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে টাকা খাটিয়ে বিড়ম্বনামুক্ত থাকতে চান। যাঁরা এসব ঝক্কি-ঝামেলা মাথায় নিয়ে বিনিয়োগ করতে যান, তাঁদের অবস্থা কী হয়? ব্যবসায়ীরা সে অভিজ্ঞতাই তুলে ধরেছেন গত বুধবার সচিবালয়ে বিনিয়োগপ্রক্রিয়া সহজ করাসংক্রান্ত এক সভায়। জমিপ্রাপ্তি, নিবন্ধন, বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুমতিপত্র সংগ্রহ, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া, ব্যাংকঋণ পাওয়া, যন্ত্রপাতি আমদানিÑপ্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে ঘুষ, দুর্নীতিসহ নানা রকম ভোগান্তি। সব শেষ করে একজন উদ্যোক্তাকে উৎপাদনে যেতে যে সময় লাগে তত দিনে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণ সুদসহ বিরাট বোঝা হয়ে তাঁর মাথায় চেপে বসে। সেখানেই শেষ নয়, ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও বহু রকমের ভোগান্তি পোহাতে হয়। অমুক পরিদর্শন, তমুক পরিদর্শন, ভ্যাট-ট্যাক্স তো আছেই। ঘুষ না দিলে শুরু হয়ে যায় লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। আর ব্যবসায়ে যদি আমদানি-রপ্তানি থাকে, তাহলে তো কথাই নেই। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো, বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি দপ্তরকে নিয়মিত ম্যানেজ করে চলতে হবে। এসব করার ফলে ব্যবসায়ের যে পরিবেশ তৈরি হয়, তা কোনোভাবেই নতুন বিনিয়োগকে উৎসাহিত করে না। বিনিয়োগের মন্দাও কাটে না।
বিশ্বব্যাংকের ‘কস্ট অব ডুয়িং বিজনেস’ প্রতিবেদন অনুযায়ী ব্যবসা শুরুর পরিবেশের দিক থেকে ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬তম। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান ছাড়া বাকি সবার নিচে বাংলাদেশ। সরকারি কর্মকর্তারা অবশ্য এ প্রতিবেদনকে মানতে চান না। বুধবারের সভায় বাণিজ্যমন্ত্রীও বলেছেন, বাংলাদেশের অবস্থান এত নিচে হতে পারে না। তবে তিনি স্বীকার করেন ব্যবসা শুরুর ক্ষেত্রে সমস্যা বা জটিলতা অনেক আছেÑসেগুলো আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। ব্যবসা শুরু ও পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যাগুলো নিয়ে আগেও অনেক আলোচনা হয়েছে। ওয়ানস্টপ সার্ভিস চালু করা, অনলাইন সেবা বাড়ানোসহ সমস্যা সমাধানের অনেক রকম আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে। কোনো অগ্রগতি নেই তা-ও বলা যাবে না। তবে সেই অগ্রগতি এত নগণ্য যে সামগ্রিক পরিবেশ উন্নয়নে তা কোনো প্রভাব ফেলতে পারছে না। আর সে কারণেই মন্ত্রী নিজেও স্বীকার করেছেন যে এখানে অনেকে ব্যবসা শুরু করার আগেই এসব কারণে ঋণখেলাপিতে পরিণত হচ্ছেন।
আমরা ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার স্বপ্ন দেখছি। কিন্তু বর্তমান বিনিয়োগ পরিস্থিতি আমাদের সেই লক্ষ্য পূরণ সম্পর্কে সন্দিহান করে তুলছে। কাক্সিক্ষত বিনিয়োগ ছাড়া লক্ষ্য পূরণ সম্ভবও নয়। সে ক্ষেত্রে সরকারকে বিনিয়োগ পরিস্থিতির উন্নয়নে আরো আন্তরিক হতে হবে। বিনিয়োগের বাধাগুলো চিহ্নিত করে তা দ্রুত দূর করতে হবে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও ঘুষ-দুর্নীতিকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।