## এডঃ লিয়াকত আলী বাবু ## সেদিন ছিল শুক্রবার। সপ্তাহের প্রথম ছুটির দিন। শীতের শেষে হঠাৎ বেশ ভালই গরম পড়েছে। সকালে মর্নিং ওয়াক করার সময় বিধ্বস্থ এক লাল পিঁপড়ার সাথে বাল্য বন্ধু টুকটুকি মাছি’র দেখা হয়ে গেল। ওরা ছোটবেলা থেকেই গভীর বন্ধুত্বে জড়ানো। যাকে বলে হরিহর আত্মার ল্যাংটা কালের বাল্য বন্ধু।
লাল পিঁপড়া তার ছোটবেলার বন্ধু টুকটুকি মাছিকে দেখেতো বেজায় খুশি। পিঁপড়া বললো, দোস্ত খুবতো উড়ে উড়ে এটা ওটা খেয়ে বেড়াচ্ছিস, তা বন্ধুর খবর-টবর একটু আধটু রাখতে হয় না?
মাছির উত্তর ঃ দোস্ত আমিইতো বাঁচি না, তা তোর খবর নেব কিভাবে বল দেখি?
পিঁপড়ার পাল্টা প্রশ্ন ঃ কেনরে দোস্ত তোর আবার কি হয়েছে?
আর বলিস না পিঁপড়া ভাই, বেশ কিছুদিন ধরে পেটের অসুখ চলছিল, তারপর ইদানিং আবার গ্যাসের খুব উৎকট সমস্যা শুরু হয়েছে। হার্টের অবস্থাও ভাল না। হার্টে মাঝে মধ্যেই ড্রপ বিট দেয়। শরীর খুবই দুর্বল। ডায়বেটিসের আশঙ্কাও হচ্ছে।
পিঁপড়াও মনের দুঃখে বললো ঃ সত্যি যা বলেছিস না মাছি ভাই। আমার শরীরেরও কিন্তু ঐ একই অবস্থা। সারাদিন গায়ে জ্বর থাকে, সারা শরীরেও অসম্ভব রকমের বিষ-ব্যাথা, তার সাথে আবার সব সময় বমি বমি ভাব হয়। মনে হয় এখনই বমি হয়ে যাবে।
মাছি বলল ঃ তা ভাই ডাক্তার-টাক্তার দেখাসনি এতদিন? আসলে কিছু মনে করিস না পিঁপড়া ভাই। তুই আজ কাল যেভাবে গুড়-চিনি খাওয়া শুরু করেছিস তাতে তোর যে কোন সময় ডায়াবেটিস বা হাই ব্লাড প্রেসার-ট্রেসার হয়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি যে কোন একজন ভাল ডাক্তারকে দেখা।
আরে মাছি ভাই, কোন ডাক্তারকে দেখাব বলতো?
অধিকাংশ ডাক্তারদের দেখলাম তারা নিজেরাই বেশ অসুস্থ্য। সেদিন সকাল বেলা একজন বড় ডিগ্রীধারী ডাক্তার সাহেবকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বড় হাসপাতালের দিকে নিয়ে যেতে দেখলাম। শুনলাম হলদে রঙের পাকা আম খেয়ে নাকি বেহুঁশ হয়ে পড়েছেন। আচ্ছা মাছি ভাই বলতো দেখি ইদানিং এত সব রোগ বালাই হওয়ার কারণ কি?
মাছি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো কারণ মনে হয় খাবার-টাবারের মধ্যে কোন সমস্যা হচ্ছে। চারিদিকেইতো ভেজালের কারখানা। সেদিন উড়তে উড়তে এক দোকানদারের সামনে রাখা পাকা আঙ্গুর ফলের উপর গিয়ে বসেছিলাম। কেবলমাত্র একটা আঙ্গুরে কয়েকটি চোষন দিয়েছি। হঠাৎ বমি বমি ভাব শুরু হয়ে গেল। শরীরের মধ্যে ঝিন্ ঝিন্ করতে লাগলো। মনে হলো হাত-পা সব অবশ হয়ে আসছে। আঙ্গুর ফলের গন্ধটাও কেমন যেন একটু বিদঘুটে মনে হচ্ছিল। এক উড়াল দিয়ে পাশের একটি আম গাছের মুকুলের উপর গিয়ে বসলাম। ওমা একি! হঠাৎ গা’ হাত-পায়ে অসম্ভব রমকের জ্বালা-পোড়া শুরু হয়ে গেল। এরই মধ্যে দু’বার বমিও করে ফেললাম। আরেক উড়াল দিয়ে একটি গর্তের পাশে গিয়ে বসলাম। গর্তের পানিটুকু বেশ স্বচ্ছ বলেই মনে হচ্ছিল। মনে হলো একটু গোসল করে ফেলি। অবশেষে গোসল করার জন্য গর্তের পানিতে নেমে পড়লাম। গর্তের যে যায়গায় নেমে গোসল করছিলাম সেখানকার কিছুটা পানি নীল রঙের হয়ে গেল। তখন বুঝলাম আরে সর্বনাশ আম গাছেতো বিষ দেওয়া হয়েছে। আর আঙ্গুরে দেওয়া ছিল বোধ হয় হাই পাওয়ারের ফরমালিন। ফরমালিনের কথা মনে হতেই আবারও কিছুটা বমি হয়ে গেল। তারপর অনেকক্ষণ ধরে কুলি করতে থাকলাম।
এতক্ষণ ধরে পিঁপড়া বাল্যবন্ধু মাছির কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিল। পরে পিঁপড়া বললো তবে শোন দোস্ত, সেদিন গুড় খাওয়ার জন্য সবেমাত্র কটা মোল্লার দোকান ঘরে ঢুকেছি। হঠাৎ দেখি কটা মোল্লা গরম পানির মধ্যে চিনি গুলায়ে তার সাথে ময়দা মিশিয়ে গুড়ের কুলার মধ্যে ঢেলে দিল। তারপর একটা বড় লাঠি দিয়ে গুড় ঘুটতে শুরু করে দিল। তার পরের দৃশ্য আরও খারাপ। কটা মোল্লা পকেট থেকে গুড়ের রঙের মত কিছু ওষুধ বের করে কুলার মধ্যে ঢেলে দিল। সম্ভবতঃ গুড়ের সেন্টের কোন হাই পাওয়ারের কেমিক্যাল। অবাক বিষয়ই বটে! চিনির মধ্যে গুড় দিলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু এখন দেখছি গুড়ের মধ্যে চিনি ঢুকাচ্ছে। দিন-দুনিয়া কি উল্টে-পাল্টে যাচ্ছি নাকি? কটা মোল্লা একজন সুন্নতি লেবাসধারী পরহেজগার হাজী মানুষ। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে। কিন্তু রাতের আঁধারে একি কাজ করছে কটা মোল্লা? এ কাজ কি কোন মানুষ করতে পারে? কোন অবলা পশুও এমন কাজ করতে পারে না। পিঁপড়ার কথা শুনে মাছি আর হাসি চেপে রাখতে পারলো না। হা হা করে হেসে দিল।
মাছি পিঁপড়াকে বললে¬া, দোস্ত তুই কি মানুষের কথা বলছিস?
মানুষ পারে না হেন অপকর্ম পৃথিবীতে আছে নাকি আবার ?
জানিস মানুষ হলো সেই প্রাণি যারা নিজেরা মরার জন্য নিজেরাই অ্যাটম বোমা বানায়। পৃথিবীতে মানুষ মারার জন্য যত অস্ত্র তৈরী হচ্ছে সব অস্ত্রই ঐসকল বে-আক্কেল মানুষরা মানুষ মারার জন্য বানাচ্ছে। এ পৃথিবীর মানুষ হত্যা করার জন্য কোন পশু-পাখিতো আর অস্ত্রপাতি বানায় না।
মাছি বললো আসলেই দোস্ত যা বলেছিস, সে কথার আর কোন উত্তর নেই।
সেদিন গিয়েছিলাম বিস্কুট আর পাউরুটি বানানোর একটি বড় কারখানাতে। আসলে সে এক কারখানাই বটে। এক আজব কারখানা। আমরা মশা-মাছিরা জাতি হিসাবে মানুষের কাছে খুবই ঘৃণার পাত্র, এ কথা ঠিক। কিন্তু মানুষদের যা করতে দেখলাম তাতে মনে হলো কিছু কিছু মানুষ আছে যারা ইতরের চাইতেও নিকৃষ্ট প্রকৃতির। পোকা পড়া দুর্গন্ধময় আটার মধ্যে পচা ডিম আর ময়লা ধরা চিনি মিশিয়ে ময়লা পানি দিয়ে যা বানাচ্ছে তাতে আমারই মুখ দিতে ভীষণ ঘৃণা হচ্ছিল।
মাছির মুখের কথা মুখে থাকতেই পিঁপড়া বললো-দোস্ত তবে শোন ঃ মানুষ কত জ্ঞানী আর কত চালাক প্রাণি তাকি তুই জানিস? মানুষই একমাত্র প্রাণি যারা জ্ঞান খাটিয়ে চালাকীর মাধ্যমে অবলীলাক্রমে নিজেদের ক্ষতি নিজেরাই করতে পারে।
ধর দোস্ত যে ব্যবসায়ী ফলের মধ্যে মারাত্মক বিষাক্ত ফরমালিন মিশিয়ে দিয়ে বিক্রি করলো। আর তার নিজের বাসার জন্য নিয়ে গেল ফরমালিন ছাড়া ফল। বেআক্কেল ব্যবসায়ী হয়তো ভাবলো তার সন্তানরাতো ফরমালিন ছাড়া ফলই খায়। কিন্তু তার ছেলে মেয়েরা যখন অন্য বাড়ীতে দাওয়াত খেতে গিয়ে তারই বিক্রি করা ফরমালিন মেশানো ফল খেয়ে আসে তখন ঐ ব্যবসায়ী ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না যে তারই হাত দিয়ে বিষ মেশানো ফল তারই সন্তানরা খেয়ে এসেছে।
এবার বুঝে দেখ দোস্ত মানুষ কত বড় বলদ প্রাণি!
আসলে মানুষ কোন আক্কেলে যে নিজেদের খাবারের মধ্যে নিজেরা বিষ মেশায় তা কিছুতেই পশু প্রাণিদের মাথায় ঢোকে না।
কয়দিন আগে পিঁপড়া ও মাছির এক বন্ধু মশা বলছিল যে ওরা নাকি এখন সুদখোর, ঘুষখোর এবং দুর্নীতিবাজদের রক্ত খায় না। ঐ সকল বাজে লোকদের রক্ত খেতে নাকি মশাদের খুবই ঘৃণা লাগে। মশারা বলে যে সুদখোর, ঘুষখোর এবং দুর্নীতিবাজদের রক্তে নাকি মরা ইতরের গন্ধ পাওয়া যায়। হতে পারে মশাদের কথাই হয়তো ঠিক।
মশারাওতো ভাল-মন্দ কিছুটা বোঝে, নাকি বলিস?
কারণ একজন সীমিত আয়ের চাকুরীজীবী যখন বিলাসবহুল গাড়ী-বাড়ীর মালিক হয় তখন তার বউ বাচ্চারাও বোঝে যে তার ঘুষখোর স্বামী পরকালে হাবিয়া দোজখের লাকড়ি হবে।
এ ব্যাপারে পশু পাখীদেরও হয়তো লজ্জা-টজ্জা বলে কিছু একটা আছে নাকি বলিস?
কিন্তু মানুষের আবার টাকা-পয়সা এবং সীমাহীন সহায় সম্পদ গড়ার ব্যাপারে লজ্জা-শরমের কোন বালাই নাই।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, লজ্জা-শরম একেবারে সাবান-সোডা দিয়ে পরিষ্কার করে ফেলা।
ঐ যে ওরা কথায় কথায় বলে যে সার্ফ এক্সেল আছে না?
যাক, সেদিন পিঁপড়া আর মাছি মিলে নদীর ধার দিয়ে ফুরফুরে বাতাসে ঘুরাফেরা এবং উড়াউড়ি করছিল।
বাজারের মাছে ইদানিং ওরা একদম বসতে পারে না।
ফরমালিনের গন্ধে দম বন্ধ হয়ে আসে।
তাই পিঁপড়া আর মাছি দুই বন্ধু মিলে নদীর ধার গিয়ে তাজা মাছের স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করছিল।
এ দিকে ফজের আলী খুব ভোরে বাড়ীর পাশের নদীতে গিয়ে খেও জাল দিয়ে মাছ ধরার চেষ্টা করছে। বহুদিন তার খেও জালে বড় মাছ ধরা পড়ে না।
আসলে নদীর মাছের স্বাদই আলাদা। যে সকল পোষা মাছ বাজারে আনা হয় তার সব মাছেই মাত্রাতিরিক্ত ফরমালিন দেওয়া থাকে। ফজের আলী খেও জাল টানতে গিয়ে হঠাৎ চমকে উঠে। দেখে বিশাল এক কাতল মাছ তার জালে আটকা পড়েছে।
খুশিতে ফজের আলীর চোখ ছানা বড়া।
জালের মধ্যে কাতল। আহা! টাটকা কাতলের ঝোল, সোতো টাক-রোনান্ডোর গোল।
কাতলকে জালের মধ্যে রেখেই ফজের আলী জিজ্ঞাসা করলো ঃ এখন কি অবস্থা হে কাতল ভাই? কাতলও হেসে দিয়ে বললো ঃ ফজের ভাই এত খুশির কিছু নাই।
খুব যে একটা লাভ করতে পার নাই। আমি আজ আটকা পড়েছি জালে, আর তুমি আজীবন আটকে আছো ভেজালে।
গল্পটা শুনে পিঁপড়া আর মাছি হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করতে লাগলো। পিঁপড়া বললো মানুষের সেকি আদিক্ষ্যেতা। খাবারের উপর একটু মাছি বসলে যেন ওদের মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায়।
কিন্তু প্রতিদিন যে নিজেরাই সরাসরি বিষ মিশিয়ে খাবার খাচ্ছে তাতে কোন দোষ নেই। যত দোষ নন্দ ঘোষ।
মানে যত দোষ মশা মাছি আর পিঁপড়া ঘোষদের উপর চাপানো হয়। এখন মানুষের মনের মধ্যে ভেজাল, প্রেম-ভালবাসায় ভেজাল, খাবার-দাবারে ভেজাল, বাড়ী-ঘর নির্মাণে ভেজাল, কথায় ভেজাল, ভাষণ-বক্তব্যে ভেজাল, এমনকি রাজনীতিতেও ভেজাল। কাতল মাছ জালে আটকে গেছে এ কথা ঠিক, কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ যে আজ কি পরিমাণ ভেজালের মধ্যে আটকে আছে তার আর কোন সীমা-পরিসীমা নাই। লেখক ঃ রাজনীতিবিদ ও মুক্ত কলামিষ্ট।