বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৪৯ অপরাহ্ন
Logo
সংবাদ শিরোনাম ::
বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আইসোলেশন মেয়াদ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টা ও বিটার তুলনায় তিন গুণের বেশী পুনঃ সংক্রমন ঘটাতে পারে : গবেষণা প্রতিবেদন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে এক বন্দুকধারী গ্রেফতার শান্তি চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে কলম্বিয়া সফর জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণের সাক্ষাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়ায় লকডাউন করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতে নতুন করে ১০ হাজার ৩০২ জন করোনায় আক্রান্ত নভেম্বর মাসজুড়ে করাঞ্চলে কর মেলার সেবা পাবেন করদাতারা ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারী কার্যবিধি যুগোপযোগী হচ্ছে

স্বপ্নের চোখ

  • আপডেট সময় বুধবার, ১১ অক্টোবর, ২০১৭

# এডঃ লিয়াকত আলী বাবু # পূর্ব ভিটি ঘরের দক্ষিণ পাশটা বেশ খোলামেলা। দক্ষিণ দিকের ঘরের সাথে একটা ছোট্ট বারান্দা লাগানো। বারান্দায় একটা জলচৌকি পাতা আছে। বারান্দার ঐ জলচৌকিতে বসেই জন্মান্ধ রমজান আলী নামাজ-কালাম আদায় করাসহ খাওয়া-দাওয়ার কাজটাও সেরে নেয়। ঐ জলচৌকিতে বসেই রমজান আলী আজ সকাল থেকে মুচকী মুচকী হাসি দিয়ে মাথা নিচু করে রাখছে। দারুণ একটা মজার খবরে রমজান আলী আজ আবেগাপ্লুত। আজ সোমবার। সামনের শুক্রবার বাদ জুম্মা শুভ কাজটির দিনক্ষণ ঠিক হয়ে গেছে। রমজান আলীর মনে হয়েছিলো মেয়েটা হয়তো রাজী হবে না। অন্ধ মানুষের সাথে বিয়েতে রাজী হবে কেন? কিন্তু সর্বশেষ ফুলমতি ওরফে ফুলি জন্মান্ধ রমজান আলীর সাথে বিয়েতে রাজী হয়েছে। জেনে-শুনেই রাজী। অন্ধ মানুষ বলে কি তার বিয়ে হবে না? রমজান আলী অন্ধ হলেও চেহারাটা বেশ দারুণ। গায়ের রঙ ফর্সা এবং লম্বাটে শরীরের গঠনটাও বেশ ভালো। বাইরের থেকে দেখলে বোঝা যায় না যে, সে অন্ধ। চোখের আকার-আকৃতি সবই ঠিক-ঠাক। কিন্তু সে জন্মের থেকেই চোখে দেখতে পায় না। তবে এখন রমজান আলীর আর সমস্যা হয় না। আন্দাজে বেশ স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করতে পারে। হাতের লাঠিটাই তার বড় একটা সহায়। লাঠির সাহায্যেই সে বেশ চলাফেরা করতে পারে। এত সুন্দর একটা ছেলে যে জন্মান্ধ সে কথা কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। কিন্তু বাস্তবে তাই। ওদিকে ফুলমতি ওরফে ফুলিও দেখতে-শুনতে কালো হলেও গঠন-আকৃতিতে দারুণ আকর্ষণ আছে। মাথা ভরা চুল আর মায়া ভরা চোখ যেন তার আজন্মের অহংকার। তার কথা বড়ই শক্ত। তার প্রেমরসিকজন তাকে ছাড়া অন্য আর কোন মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকালে তার মাথা ঠিক থাকবে না। সেই হিসাবে সুচেহারার রমজান আলী অন্ধ হওয়াতে ফুলির কোন আফসোস নাই। পুরুষদের খুব বেশী ভালো চোখ থাকাও নাকি সমস্যা। আসলে পুরুষরা নাকি এদিক-ওদিকে তাকায় বেশী। বিশেষ করে মেয়েদেরকে দেখলে আড় চোখে হলেও পুরুষরা একটু তাকাবেই তাকাবে। সেখানে কঠিন শাস্তির ধর্ম বাণীও তাকানো রোধ করতে পারে না। চলতি পথে বউ সাথে থাকলে সবসময়ই স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে। খেয়াল রাখে স্বামীরা এদিক-ওদিক তাকায় কিনা। সেই হিসাবে ফুলির সমস্যা অর্ধেক কম হবে। সে কালো হলেও কোন সমস্যা নাই। স্বামী হবে জন্মান্ধ। কালো-ধলো তার কাছে সবই সমান। বোঝার কোনই উপায় নাই। আর স্বামী বেচারা এদিক-ওদিক তাকাতেও পারবে না কখনো। ফুলির সুখটা সেখানেই। আর রমজান আলীর সুখ হলো ফুলি তার সাথে বিনা শর্তে বিয়েতে রাজী হয়েছে। তার হবু বউয়ের নাম যে ফুলমতি ওরফে ফুলি তা রমজান আলীর কান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। রমজানের চিন্তা হলো সর্বশেষ ফুলি এই অন্ধের সাথে সংসার করবে কি না। যদিও অনেকেই বলে যে, নাই মামার চাইতে কানা মামাও ভালো। আবার এ কথাও শুনা যায় যে, মামা না থাকাও ভালো তবু কানা মামা টেনে নিয়ে বেড়ানো বড়ই একটা ঝামেলার বিষয়। তবে ফুলিদের আর্থিক অবস্থা মোটেই ভালো না বলে রক্ষা হতে পারে। কিন্তু ফুলির চেহারাতে নাকি এক ধরনের বাড়তি আকর্ষণ আছে। তবে এই আকর্ষনটা যদি রমজানকে একবার ওভারটেক করে ফেলে তাহলে ঝামেলা আছে। এইসব সাত-পাঁচ চিন্তা-ভাবনা করে মরজান আলী দিন কাটিয়ে দেয়। শুক্রবার আসতে মাঝখানে আরও তিনদিন বাকী আছে। মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতি। তার পরই শুক্রবার। রমজান আলীর শরীরের মধ্যে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে। বিয়ে মানেই বিশাল একটা ব্যাপার-স্যাপার। কাবিননামা, কবুল আর বাসরঘর। বাসর ঘরে কি কথা দিয়ে শুরু হবে আলাপ ? না থাক, এসব বিষয় নিয়ে আগেই এত চিন্তা-ভাবনা করা উচিত হবে না। দেখা গেল বৃহস্পতিবার না আসতেই ফুলি বেঁকে বসেছে। সে অন্ধ মানুষের সাথে বিয়ে বসতে রাজী হচ্ছে না। মানুষের মন বোঝা বড় দায়। মানুষ খুবই পরিবর্তনশীল মনের প্রাণী। সকালে এক রকম, তো বিকালে আরেক রকম। কোন স্থিতিশীলতা নাই। তারপরও রমজান আলী মন ভাঙ্গতে রাজী না। আজ থেকেই কেন যেন ফুলির প্রতি তার একটা মায়া মায়া ভাব তৈরী হয়ে গেছে মনের মধ্যে। হাজার হোক সে হবে তার জীবন সাথী। আজ বৃহস্পতিবার। সারাদিন মনের মধ্যে নানান চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সকালেই বাড়ীতে নাপিত ডাকিয়ে এনে চুল কাটাসহ হাত-পায়ের নখ কাটানো হয়েছে। মাথায় শ্যাম্পু দিয়ে চুলগুলোকে ঝরঝরে করানো হয়েছে। নতুন জামা-পাজামার সাথে কালো চশমা পরানোর পর রমজানকে একেবারে নায়কের মতো দেখাচ্ছে। সব কাজ বৃহস্পতিবারেই সেরে ফেলা হলো। শুক্রবারের জন্য কোন কাজ বাকী রাখা উচিত হবে না। এরই মধ্যে দুইটা ঘোড়ার গাড়ী এবং একটা পালকী ভাড়া করাসহ বউ সাজানোর সকল সরঞ্জাম কিনে বাক্স ভরা হয়েছে। একটা স্বর্ণের চেন এবং ছোট্ট এক জোড়া কানের দুল কেনা হয়েছে। ছোট-খাটো অনুষ্ঠান হলেও আয়োজনে কোন খুঁত রাখা হয় নাই। রমজানের নিজের ইচ্ছাতেই ঘন লাল রঙের একটা কাপড় কেনা হয়েছে। যদিও কোন রঙ সম্পর্কেই রমজানের ধারনা নাই। মানুষের কাছে শুনে শুনে লাল রঙের উপর তার একটা লোভ জমেছে। সেই কারণেই ঘন লাল রঙের শাড়ী কেনা। আজ বর সাজার ট্রায়াল দেওয়া হলো। আগামীকাল শুক্রবার ফাইনালী সাজতে হবে। বৃহস্পতিবারের রাত। ভাত খাওয়ার পর এশার নামাজ আদায় করে রমজান সকাল সকাল শুয়ে পড়ে। কিন্তু এক অজানা আশংকায় আজ কিছুতেই তার ঘুম আসছে না। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে আছে রমজান। এ কি আর কিছু? বিয়ে বলে কথা। আরেকটা ভয় রমজানের মনের মধ্যে কয়েকদিন ধরেই আনাগোনা করছে। শেষ মুহুর্তে যদি ফুলমতি তার মত পাল্টিয়ে ফেলে? যদি সে অন্ধের সাথে বিয়েতে রাজী না হয়? শেষ মুহুর্তে এমন একটা আকস্মিক দুর্ঘটনাতো ঘটতেও পারে। ধ্যাৎ! আলাই-বালাই। এসব কি কুচিন্তা-ভাবনা? মাঝ রাতে উত্তর পাড়ার বট গাছ থেকে কুড়ালী পাখি ডাক দিলে রমজান বুঝতে পারে রাত এখন দুটো বাজে। কিছুক্ষণ আগে কুড়াল পাখি ডেকে উঠেছে। আগামীকাল এতক্ষণে সে ফুলমতির সাথে থাকবে। রমজান ফুলমতির জন্য কতো কথা যে মনের মধ্যে গুছিয়ে রেখেছে তার কোন হিসাব নাই। পাগল পবনের সাথে সতী বিবির গল্প, আলোমতি প্রেম কুমারের গল্প, সুজন-সখির গল্প। আরও কতো গল্প। ফুলমতির কোলে মাথা রেখে সে মজার মজার গল্প বলে ফুলমতিকে অবাক করে দেবে। ফুলমতি বলবে, ওগো তুমিইতো আমার গত জনমের প্রেমকুমার ছিলে। শুধু তোমার জন্যইতো আমার জন্ম হয়েছে। আমিও বলবো তুমিতো ফুলমতি না, তুমিতো আমার আর জনমের আলোমতি। আমার চোখেতো আলো নাই। আজ থেকে তুমিই আমার চোখের আলো। এই সব চিন্তা করতে করতে রমজান ঘুমিয়ে পড়ে। রমজানের যখন ঘুম ভাঙ্গে তখন ফজরের আজান হ”িচ্ছল। ফজরের আজানের শব্দ ভেসে আসলেই রমজানের ঘুম ভেঙ্গে যায়। আজও তার ব্যতিক্রম হয় নাই। রমজান লাঠি দিয়ে অজুর বদনা খুঁজে কলপাড়ে অজু করতে যায়। আগামীকাল রাতে ফুলমতি নিজের হাতে অজুর বদনা এনে দেবে। রমজান নিজেই একটু মুচকী হাসি দিয়ে নেয়। অন্ধ রমজানের আবার বিয়ে। রমজান আজ ফজরের নামাজের পর ১২ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে নেয়। তারপর কিছুক্ষণ আল্লাহর নামে জিকির করতে থাকে। দুপুরের অনেক আগেই বর যাত্রা করে। অতঃপর রমজানের মনের সকল ভয়-ভীতি দূর হয়ে বিয়ে পড়ানো শেষ হয়। বিবাহ পড়ানোর পরপরই রমজান দুই রাকাত শুকুরানা নামাজ আদায় করে নেয়। এখন সে রীতিমত একজন বিবাহিত পুরুষ।
বিয়ে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে যায়। আকাশে হাল্কা মেঘ। বৃষ্টি আসতে পারে এমন গুঞ্জন শুনে রমজানের মনে সুখের দোলা লাগছিল। বৃষ্টির রাতে বাসর ঘর। ফুলমতি আর রমজান পালকীর মধ্যে চুপচাপ বসে আছে। চার বেহারার পালকী। বেহারারা হুম নারে হুম না শব্দ করতে করতে রমজানদের বাড়ীর বেঁকি বেড়ার কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। বাড়ীর মধ্যে যেতে পুরস্কার চাই। বেহারাদের পুরস্কার দেওয়ার একটা রেওয়াজ আছে। বাড়ীর বউ-ঝি’রা পালকী থেকে বউ নামানোর প্রস্তুতি নিয়ে বাড়ীর মধ্যে অপেক্ষা করছে। পুরস্কার দেবে কে? রমজানের বলতে ইচ্ছে করছে, সে নিজের হাতে বেহারাদের পুরস্কার দিতে চায়। কিন্তু আজ সে বর সেজেছে। কথা বলা নিষেধ। বেহারাদের দাবী মিটছে না। উহ্ ফুলমতির বসে থাকতে কতই না কষ্ট হচ্ছে। পালকীর মধ্যে দুইজনই মাথা নিচু করে বসে আছে। অবশেষে বেহারাদের দাবী মিটিয়ে বর-বউ’কে নামানো হয়েছে। রমজান এখন তার সেই সুপরিচিত জলচৌকির উপর বসে আছে। এটা তার আজন্মের পরিচিত আস্তানা। এই মুহুর্তে শত রকমের কল্পনা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। কি কথা বলে পরিচিত হতে হবে? কার আগে কথা বলতে হয়? রমজান এখন ঘোরের মধ্যে আছে। অবশেষে প্রায় মাঝ রাতে রমজানকে তার বড় ভাবী টানতে টানতে বাসর ঘরে নিয়ে যায়। ফুলমতিকে কি পরে আনবে? না কি ফুলমতি আগেই বাসর ঘরে বসে আছে? অন্ধ হলেও রমজান মানুষের উপস্থিতি ঠিকই অনুমান করতে পারে। বিছানায় ফুলমতি বসে আছে। বড় ভাবী বাইরের থেকে শব্দ করে দরজা টান দিয়ে চলে যাওয়ার সময় একটা অনুশব্দের হাসি দিয়ে গেল। রমজান ঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে লাঠি না থাকাতে একটু সমস্যা হচ্ছে। হঠাৎ একটা নরম হাত এসে রমজানের ডান হাতটা চেপে ধরে। তারপর ধীরে ধীরে রমজানকে বিছানার উপর নিয়ে বসিয়ে দেয়। রমজানের দু’চোখ বেয়ে বাঁধ ভাঙ্গা লোনা পানি গড়িয়ে পড়ে। জীবনের অনেক কষ্টের মাঝে আজকের এই মুহুর্তটা তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহুর্ত। বাইরে বৃষ্টি নামছে। বৃষ্টির পানির সাথে রমজানের চোখের পানি মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আতরের সাথে স্নো-পাউডারের ঘ্রান মিশে বাসর ঘরের মধ্যে একটা অন্য রকম পরিবেশ। এই মুহুর্তে রমজানের অন্তঃর্দৃষ্টি খুলে গেছে। সে আজ তার অন্তঃর্দৃষ্টি দিয়ে ফুলমতিকে দেখতে পাচ্ছে। মেয়েরা কি এতটাই সুন্দর হয়? এখনই হৃদয়ের নিটোল নিভাঁজে জমিয়ে রাখা সব কথাগুলো ফুলমতিকে বলে দিতে ইচ্ছে করছে। হাজার রাতের মধ্যে আজকের রাতটা রঙিন স্বপ্নের একটা রাত। যদিও রঙ সম্পর্কে রমজানের কোন ধারনাই নেই। আজ দুটি মানব মানবী এক আত্মায় মিশে একাকার হয়ে গেল। আজ কোন সংকোচ নেই, কোন দ্বিধা নেই, নেই কোন কষ্টের কঠোরতা। আজ শুধু আনন্দ আর সুখের সমুদ্রে সাঁতার কাটা। যে সাঁতারের কোন শেষ নেই। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল রঙিন স্বপ্নভরা সোনালী ভালবাসার দিনগুলো। কিভাবে যে রঙিন সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে রমজান-ফুলমতির একটা বছর কেটে গেলো তা ওরা নিজেরাও বুঝে উঠতে পারে নাই। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হলো সেই দিন, যে দিন রমজান আলী একটা রঙিন স্বপ্ন দেখে বসলো। সেদিনটা ছিল রবিবার। রমজান আলী ফজরের নামাজ আদায় করে চিরচেনা সেই জলচৌকিটার উপর বসে মুচকী মুচকী হাসি দিয়ে মুখ ঢাকছিল। মুচকী হাসির বিষয়টা ফুলমতির চোখ এড়াতে পারে নাই। এত সকালে হাসির কি হলো? লুকিয়ে লুকিয়ে হাসছে কেন সে? রমজানকে আজ খুবই উৎফুল্ল লাগছে। ফুলমতি সকালের বাসী কাজ সারতে সারতে বিষন্ন হয়ে ভাবতে থাকে ঘটনাটা কি। সাত সকালের এই হাসির রহস্যটা আজ তার উদ্ঘাটন করতেই হবে। সকাল গড়িয়ে দুপুর এবং দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেলেও সকাল বেলার গোপন হাসির কারণটা এখনো জানা হয়ে উঠেনি। রাতে বিছানায় গিয়ে স্বামীর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সকালের গোপন হাসির রহস্যটা জানতে চাইতেই রমজান একটু শব্দ করে হেসে উঠে। ছিঃ ছিঃ তুমি শব্দ করে হাসছো কেন? পাশের ঘরে ভাবীরা কি মনে করবে বলোতো? আরে পাগলী হাসা-হাসিতে কেউ কান পাতে না। কান পাতে হলো—-। ফুলমতি হাত দিয়ে রমজানের মুখ চেপে ধরে। রমজান আস্তে করে মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে বলতে থাকে-শোন ফুল, গতকাল রাত্রে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। রমজানের কথা শুনে ফুলমতি চমকে উঠে! স্বপ্ন দেখেছে মানে? জন্মান্ধ স্বপ্ন দেখলো কিভাবে? এতো ভারী দুশ্চিন্তার বিষয়! তা কি স্বপ্ন দেখলে গো? বলো না একটু তোমার স্বপ্নের কথা। রমজান আরেকবার একটু হেসে নিয়ে বলে তাহলে শোন-গতকাল ভোর রাতের দিকে স্বপ্নে দেখি ঠিক তোমার মতো, না না ঠিক তোমার মতো না তোমার খালাতো বোন রহিমার মতো, ঐ যে বিয়ের মধ্যে আমাদের বাড়ীতে এসেছিলো। স্বপ্নে দেখি যে সেই রহিমা আমাদের বাড়ীর সামনের নদীর পাড় দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের বাড়ীর দিকে আসছে। পড়নে ঘন সবুজ রঙের লাল পেড়ে শাড়ী, কপালে নীল রঙের টিপ, ঠোঁটে খয়েরেী রঙের লিপস্টিক দেখতে কি যে দারুণ লাগছিলো না। স্বপ্নটা দেখেতে দেখতে ভোরের আজানের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। জানো স্বপ্নের সেই দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে এখনো ভাসছে। ফুলমতি হতভম্ব হয়ে পড়ে। ফুলমতির মুখে কোন ভাষা নেই। রমজান জানতে চাইলো, ফুল কি ঘুমিয়ে পড়েছো? ফুল জেগে থাকলেও নিশ্চুপ থাকে। রমজান বলে আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ো। ফুলমতি ভাবতে থাকে জন্মান্ধ স্বামী তার স্বপ্ন দেখলো কিভাবে? তাও আবার রঙিন স্বপ্ন? রহিমার চেহারার সাথে ফুলমতির চেহারার পার্থক্য বুঝলো কিভাবে? ফুলমতি কিছুতেই ভেবে পায় না। তাহলে তার স্বামী রমজান কি অল্প অল্প দেখেতে পারে? মাথা খারাপ হয়ে যেতে থাকে ফুলমতির। যে দুঃখে অন্ধকে বিয়ে করেছে, সেই দুঃখ কি তার রয়েই গেল? তাহলে কি তার অন্ধ স্বামীও পরনারীর দিকে তাকাতে পারে? পরনারীর সৌন্দর্য আর রূপ-মাধুর্য দেখতে পায়? তাই যদি দেখতে পায় তাহলে ফুলমতি যে ভীষণ কালো সেটাও নিশ্চয়ই দেখতে পায়? তাহলেতো এর একটা বিহিত করা দরকার। পরের দিনই ফুলমতি বেড়ানোর কথা বলে বাপের বাড়ী চলে যায়। সেখানে জটু খাঁ নামের একজন বড়মাপের কবিরাজ আছে। বড়ই ধন্বন্তরী কবিরাজ। সে নাকি সব সমস্যারই সমাধান দিতে পারে। পরের দিন খুব ভোর বেলা উঠে ফুলমতি চলে যায় সেই জটু কবিরাজের বাড়ী। জটু কবিরাজ তাকে নতুন একটা সম্পূর্ণ কালো রঙের মাটির কলসী কিনে আনতে বলে। ঐ মাটির কলসী পদ্মবিলের জলে এক ডুবে ভরে আনতে হবে। তারপর একেবারে আনকোড়া নতুন কাপড় পরে পদ্মবিলের পাড়ে ভিজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে পদ্মবিলের পানার কাছে যা চাইতে হবে তা গোপনে জটু কবিরাজ ফুলমতিকে শিখিয়ে দেয়। ফুলমতি তার ভাইকে দিয়ে কাশিনাথপুরের পালপাড়ার জ্যোতিষ পালের বাড়ী থেকে মধ্যম সাইজের একটি নতুন কালো রঙের মাটির কলসী কিনে আনায়। তারপর ফুলমতি একখানা সবুজ রঙের লাল পাড়ের নতুন কাপড় যোগাড় করে আনে। কেউ যেন বুঝতে না পারে সেই জন্য ঐ নতুন কলসীতে মুড়ি ভর্তি করে ফুলমতি নৌকায় চড়ে শ্বশুর বাড়ীতে চলে আসে। খুব সকালে নতুন কাপড় পড়ে কলসী নিয়ে পদ্মবিলে যেতে হবে। পদ্মবিলের পানার কাছে নিজের চাওয়া শেষ হলে কলসীটা এক আছাড়ে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে ভিজা কাপড়ে বাড়ী চলে আসতে হবে। পথে কারোর সাথে কোন কথা বলা যাবে না। কথা বললেই সব সাধনা শেষ। আগামীকাল মঙ্গলবার। এ কাজ নাকি শনি-মঙ্গলবারে ফলে ভালো। খুব ভোরে কিছুটা রাত থাকতেই উঠতে হবে। কেউ জানতে পারলে সমস্যা হতে পারে। রাত্রে স্বামীর সাথে হাসি-খুশির অনেক কথা হলো। যদিও রমজানের রাতের চাওয়া পূরণ করা হলো না। কারণ যদি ছুঁৎ লেগে যায়। যদি সাধনা বিফলে যায়। ভোর চারটা বাজে। রাতের আঁধার আছে। ফুলমতি বিছানা থেকে উঠে কাপড় বদলাতে থাকে। রমজান উল্টো দিকে মুখ করে ঘুমিয়ে আছে। ফুল কি কাপড় বদলাচ্ছো নাকি? ফুলমতির পিলে চমকে উঠে। অন্ধ রমজান এ কি বলে!! একেতো জন্মান্ধ তারপর ঘরের মধ্যে বেশ অন্ধকার। কাপড় বদলানো দেখছে কিভাবে? এতো দেখছি বিস্ময়কর ব্যাপার। ফুলমতি স্বাভাবিক থাকে। আরে না কাপড় গুছাচ্ছি। নতুন কাপড় তাই না ফুল ? রমজানের কথা শুনে ফুলমতির জ্ঞান হারানোর মত অবস্থা। এসব কি বলছে রমজান? তুমি নতুন কাপড় বুঝলে কিভাবে? আরে বোকা নতুন কাপড় থেকে একটা ঘ্রান বের হয়। ঘ্রান থেকেই বোঝা যায় এটা নতুন কাপড়। তা আব্বা কিনে দিছে নাকি? ফুলমতি হুম বলে নিশ্চুপ থাকে। তা এতো সকালে আবার নতুন কাপড় পরতিছো ক্যান? এবার ফুলমতি বেশ ঘাবড়ে যায়। সব জেনে ফেলেছে না কি? তাহলেতো একেবারে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তার থেকে বরং কথা না বাড়ানোই ভালো। ফুলমতি রমজানের কথার কোন উত্তর না দিয়ে মাটির কলসীটা কাঁখে নিয়ে পদ্মবিলের দিকে ছুটতে থাকে। কাজটা সূর্য উঠার আগেই সেরে ফেলতে হবে। ফুলমতি কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে দ্রুত পদ্মবিলের কাছে পৌঁছ যায়। পদ্মবিলের যে পাশে শ্যাওলা বেশী সেই পাশে নামতে হবে। ফুলমতি পদ্ম বিলের উত্তর পাশ দিয়ে নেমে পড়ে। নামতে নামতে সোজা গলা পানিতে চলে যায়। তারপর এক ডুব দিয়ে বহু কষ্টে কলসী ভরে ফেলে। তারপর ফুলমতি ভিজা কাপড়ে উপরে উঠে আসে। কলসীটা বাম কাঁখে রেখে গলায় ভেজা কাপড় জড়িয়ে বলে উঠে-হে পদ্মবিলের পানা, আমার স্বামীর স্বপ্নের চোখ কেমনে হবে কানা ? লেখক ঃ আইনজীবী ও কলামিষ্ট।

 

নিউজটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
error: আপনি নিউজ চুরি করছেন, চুরি করতে পারবেন না !!!!!!