॥স্টাফ রিপোর্টার॥ যুবকদের বিশেষ করে নেতা-কর্মীদেরকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করার আহবান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখার দৃঢ় সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, অনিয়মকারীদের কোন ছাড় হবে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দিন-রাত দেশের মানুষের জন্য পরিশ্রম করে যাচ্ছি। চলার পথে কেউ যদি বিপথে যায় এবং সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, মাদক ও দুর্নীতিতে জড়ায়, সে যেই হোক আমি তাদের ছাড়ব না। তাদের প্রতি আমার কোন সহানুভূতি থাকবে না।’
শেখ হাসিনা গতকাল ২৩শে নভেম্বর সকালে রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের উদ্বোধনী পর্বে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
তিনি বলেন, এই দেশ জাতির পিতা শুধু স্বাধীন করেই যান নাই। এর আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য তিনি বুকের রক্তও দিয়ে গেছেন। সেকথা সবাইকে স্মরণ রাখার আহবান জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, ‘এই দেশ কখনো ব্যর্থ হতে পারে না, এদেশকে আমরা সফল করে তুলেছি এবং সেই সফলতার পতাকা নিয়েই আমরা সামনে এগিয়ে যাব এবং একদিন স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বে যে মর্যাদা পেয়েছিল সেই মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পাবে এবং জাতির পিতার স্বপ্ন আমরা পূরন করবো।’
এদেশের জনগণের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে সেজন্য তাঁর সরকার শতবর্ষ মেয়াদী ‘ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০’ বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আদর্শ নিয়ে চলতে হবে। আদর্শের মধ্যদিয়েই একটি সংগঠন যেমন গড়ে ওঠে তেমনি দেশকেও কিছু দেওয়া যায়। সেই কথাটাই সবসময় মাথায় রাখতে হবে।’
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন। সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহবায়ক চয়ন ইসলাম অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।
যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মোঃ হারুনুর রশিদ এবং সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য মুজিবুর রহমান চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এডভোকেট বেলাল হোসেন শোক প্রস্তাব পাঠ করেন।
এরআগে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন এবং বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে যুবলীগের সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের উদ্বোধন করেন।
অনুষ্ঠানের শুরুতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জাতীয় চারনেতা, মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ ১৫ই আগস্টের সকল শহীদ, ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলাসহ সকল গণআন্দোলনের শহীদ এবং ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেস থেকে এ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের শাহাদত বরণকারী নেতা-কর্মীদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
সারারদশের ৭৭টি সাংগঠনিক জেলা থেকে ২৮ হাজারেরও বেশি কাউন্সিলর যুবলীগের এই ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন।
বিকালে তাঁরা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ(আইইবি) মিলনায়তনে কাউন্সিল অধিবেশনে নতুন নেতা নির্বাচন করবেন। সর্বশেষ ২০১২ সালের ১৪ই জুলাই যুবলীগের ৬ষ্ট জাতীয় কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী যুবলীগ বাংলাদেশের প্রথম যুব সংগঠন যা ১৯৭২ সালের ১১ই নভেম্বর জাতির পিতার নির্দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন ১৯৭৫ এর ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে হত্যাকান্ডের শিকার বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে দৈনিক বাংলার বানী সম্পাদক শেখ ফজলুল হক মনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যুবলীগ সংগঠনের যেন কোনরকম বদনাম না হয়। তাঁরা যেন সম্মান নিয়ে চলতে পারে এবং আদর্শ নিয়ে চলে দেশের কল্যাণে কাজ করতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই এই সংগঠনটাকে গড়ে তুলতে হবে। আর সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, এই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে। কোন উড়ে এসে জুড়ে বসা এবং ক্ষমতার উচ্ছিষ্টভোগীদের মাধ্যমে এই সংগঠন গড়ে ওঠে নাই।
তিনি বলেন, ‘এ সংগঠন গড়ে উঠেছে নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করবার লক্ষ্য নিয়ে। সেই সাথে সাথে আওয়ামী লীগের প্রতিটি সহযোগী সংগঠনও এদেশের মানুষের কল্যাণ ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং স্বাধীনতার সুফল প্রত্যেকটি মানুষের ঘরে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে।’
‘সেই আদর্শ থেকে কখনও যদি কেউ বিচ্যুত হয়ে যায় তাহলে সেদেশকে কিছু দিতে পারে না।’ ৭৫ এর ১৫ই আগস্টের পর ক্ষমতা দখলকারীরাও মানুষের কল্যাণে কিছু করতে পারে নি। তারা নিজস্ব বিত্তবৈভব অর্জনে ব্যস্ত থেকেছে’, যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাতির পিতা এদেশকে স্বাধীন করে গেছেন কাজেই কারো কাছে হাত পেতে চলবো না, মাথা উঁচু করে চলবো। কারো কাছে ধার করে ঘি খাবো না, নিজেদের নূন ভাত খাবো তাও ভাল কিন্তু নিজেদের অর্থায়নে নিজেরা চলবো, মর্যাদা নিয়ে চলবো।’
ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে দেশের কল্যাণে কতটুকু কাজ করতে পারলাম সেই মনভাব নিয়েই সকলকে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার আদর্শ নিয়ে আমরা যদি সংগঠন গড়তে পারি তাহলে এই বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেভাবেই এগিয়ে যাবে।’
আর যেন কেউ বাংলাদেশের মানুষের ওপর শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন করতে না পারে। তৃণমূল পর্যায় থেকে যেন মানুষের আর্থসামাজিক উন্নতি হয়, সেই জন্য একেবারে গ্রামের মাঠ পর্যায় থেকে তাঁর সরকার সকল আর্থসামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কাজ করে অনেকে টাকা বানাতে পারে। এই টাকা দিয়ে হয়তো জৌলুস করতে পারে, চাকচিক্য বাড়াতে পারে, আন্তর্জাতিক বড় বড় ব্র্যান্ডের জিনিস পরতে পারে, কিন্তু তাতে সম্মান পাওয়া যায় না।’
তিনি বলেন,‘ এতে হয়তো নিজের ভোগের ভেতর দিয়ে একটা আত্মতুষ্টি পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু দেশের মানুষের কাছে মর্যাদা পাওয়া যায় না। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।’
দেশ গড়ার জন্য যুব সমাজের মেধা ও মননকে কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী যুবলীগের প্রত্যেকটি নেতা-কর্মীকে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীমূলক লেখা ‘কারাগারের রোজ নামচা’ এবং ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ মনোযোগ দিয়ে পাঠ করে লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে ওঠে কীভাবে দেশ ও মানুষের জন্য কাজ করা যায়, তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘মানুষের কল্যাণে কী করতে পারলাম সেই চিন্তা যাদের মাথায় থাকে তারা রাজনীতিতে সফল হতে পারেন।’
দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে যুব সমাজকে বিশেষভাবে সম্পৃক্ত করার প্রচেষ্টা নিয়ে তাঁর সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের যুবশক্তিই পারে দেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ করে দিতে। সে জন্য যুব সমাজের প্রশিক্ষণ এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি।’
প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচার বিরোধী গণআন্দোলনে রাজপথে শহীদ নূর হোসেন, বাবুল, ফাত্তাহ এবং শুক্রাবাদের মিলনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘প্রত্যেকটি আন্দোলন-সংগ্রামে আমি দেখেছি যুবলীগ অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছে। আবার মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এই যুবকরাই জাতির পিতার আহবানে সাড়া দিয়ে অস্ত্র তুলে নিয়ে নিজের বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘কাজেই সেই যুবসমাজকে আমরা চাই একটা আদর্শ হিসেবে। নিজেদের তাঁরা গড়ে তুলবে।’
প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিগত প্রায় ১০ বছরে বাংলাদেশে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘আমাদের ওপরে অনেকে বদনাম দিতে চেয়েছিল। কিন্তু পারেনি কারণ সততার শক্তি হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা।’
তিনি এ সময় নাম উল্লেখ না করে ড. ইউনুস এবং সংশ্লিদের পদ্মা সেতুর বিদেশী সাহায্য বন্ধের চক্রান্তের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ করে বলেন, ‘আমাদের দেশেরই কিছু স্বনামধন্য লোক যাদের একসময় ব্যবসা দিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠতে আমিই সাহায্য করেছি। তারা সে সময় আন্তর্জাতিক সম্মাননা নিয়ে আসলো অথচ দেখা গেল বয়স হয়েছে কিন্তু একটা ব্যাংকের এমডি’র পদ ছাড়তে পারে না।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘এদিকে নোবেল প্রাইজ পায় কিন্তু একটি ব্যাংকের এমডি’র পদ ছাড়ে না।’
তিনি বলেন, ‘সেই পদ কেন বয়সের কারণে ছাড়তে হলো সেই প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পদ্মা সেতু বন্ধে আমেরিকা গিয়ে ধর্ণা দিল এবং তারা আমাদের ওপর দোষ দিল দুর্নীতির।’
প্রধানমন্ত্রী সে সময় চ্যালেঞ্জ নিলে ওয়াল্ড ব্যাংক দুর্নীতি প্রমানে ব্যর্থ হয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তারা যখন দুর্নীতি খুঁজতে গেছে তখন খালেদা জিয়া তারেক রহমান এবং কোকো’র দুর্নীতিই বেরিয়েছে, আরো অনেকেরটা বেরিয়েছে। কিন্তু তারা আমাদের কোন দুর্নীতি পায়নি। বরং আমাদের ঘোষণা অনুযায়ী আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করে যাচ্ছি।’
দক্ষিণ আফ্র্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারাগারে থাকার ঘটনার সাদৃশ্য খুঁজে বেড়ানো বিএনপি নেতৃবৃন্দের কঠোর সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যিনি বিএনপি নেত্রী, যিনি এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করেন, দুর্নীতির দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কারাগারে। তার তুলনা করে নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গে। তার তুলনা করে কার সঙ্গে? আমি তো মনে করি, এটা করে নেলসন ম্যান্ডেলাকে অপমান করা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘নেলসন ম্যান্ডেলা তার জাতির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করে কারাগারে ছিলেন। দুর্নীতি করে কারাগারে যাননি।’
খালেদা জিয়া ক্ষমতায় থাকার সময়ে তাঁকে হত্যার প্রচেষ্টায় আইভী রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২২জন নেতাকর্মীকে গ্রেনেড হামলা করে হত্যা এবং একাধিকবার হত্যা প্রচেষ্টার ও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করায় বিএনপির সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ আমরা যে মহাজোট গড়ে তুলি, আমরা বিপুল ভোটে জয় লাভ করি। সে সময় বিএনপি জামায়াত জোট, তারা কী পেয়েছিল? তারা মাত্র ২৯টি সিট পেয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘২০০৮-এর নির্বাচন নিয়ে তো কেউ কথা বলেনি। বিএনপি যদি এতই জনপ্রিয় সংগঠন হয়ে থাকতো, তাহলে মাত্র ২৯টি সিট পেয়েছিল কেন? তারা মাত্র ২৯টি সিট পেয়েছিল এ কথাটা অনেকে ভুলে যায়।’