## সফিউল আযম ## জঙ্গীবাদ এখন বৈশ্বিক সমস্যা। একসময় আল কায়েদা এবং তালেবান নামে ২টি জঙ্গী সংগঠনের বিশ্বব্যাপী পরিচিতি ছিল। বর্তমানে বিশ্বে ছোট-বড় সর্বমোট জঙ্গী সংগঠনের সংখ্যা প্রায় ৫হাজার।
বাংলাদেশে জঙ্গী কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯২ সালে আফগান ফেরত মুজাহিদদের মাধ্যমে। বিভিন্ন গবেষণায় এসেছে, তাদের অনুসৃত পথে দেশে শতাধিক জঙ্গী সংগঠন রয়েছে, যাদের নেতৃত্বে রয়েছে আফগান ফেরত মুজাহিদদের মধ্য থেকে কেউ না কেউ। মূলতঃ বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ব্যানারে পূর্বসুরীদের ‘সশস্ত্র বিপ্লব’ এর মাধ্যমে কথিত ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের নামে অরাজকতা সৃষ্টিতে মাঠে নেমেছিল তারা।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী ‘সন্ত্রাস দমন আইন, ২০০৯’ পাস করে। পরবর্তীতে বিশ্ব জুড়ে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের ধরন পাল্টানোর ফলে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অর্থায়ন প্রতিরোধে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সংস্থা এশিয়া প্যাসিফিক গ্রুপ(এপিজি) ও ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্সের (এফএটিএফ) মানদন্ড অনুসরণ করে ২০১২ সালে এবং পরবর্তীতে ২০১৩ সালের ১১ই জুন জাতীয় সংসদে সন্ত্রাস বিরোধী(সংশোধন) বিল-২০১৩ পাস হয়। সংশোধিত আইনে মূলতঃ সন্ত্রাসী ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক ইন্টারনেট ভিত্তিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার, আল কায়েদার সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অস্ত্র বিক্রি ও ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা এবং জঙ্গীবাদে অর্থায়নের বিষয়টি গুরুত্ব পায়।
জঙ্গী দমনে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। বিভিন্ন দেশের সরকার বাংলাদেশকে জঙ্গী দমনের রোল মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করছে। ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ত্রাসবাদের বিপক্ষে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাংলাদেশের। সরকারের অগ্রাধিকার হিসেবে গোয়েন্দা কার্যক্রম ও জঙ্গীদের বিরুদ্ধে চিরুনী অভিযান এই সফলতার অন্যতম কারণ। জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করা, বড় অংকের আর্থিক পুরষ্কার ও রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রযুক্তি নির্ভর করে তাদের কর্মদক্ষতা বাড়ানোর পদক্ষেপগুলো জঙ্গী দমনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
জঙ্গী-সন্ত্রাসবাদ নির্মূলে গঠিত কাউন্টার টেররিজম এন্ড সাইবার ক্রাইম ইউনিট, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন(পিবিআই), স্পেশাল সিকিউরিটি এন্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন(এসপিবিএন) গঠন ছিল সময়োপযোগী।
সন্ত্রাসবাদ, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন, সন্ত্রাসবাদে সহায়ক অপরাধগুলো প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে গঠিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এন্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট কার্যকর ভূমিকা রাখছে। এই ইউনিটে আছে কাউন্টার টেররিজম বিভাগ, সাইবার সিকিউরিটি এন্ড ক্রাইম, ক্রাইমসিন ম্যানেজমেন্ট ও ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগ, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট এবং বিশেষ ডগ স্কোয়াড। ইন্টেলিজেন্স ইনফরমেশন কালেকশন, অপারেশন পরিচালনা, মামলা রুজু, তদন্ত এবং তদন্ত পরবর্তী সন্ত্রাসীদের পর্যবেক্ষণে রাখার ক্ষেত্রেও এই ইউনিট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জঙ্গীবাদ দমনে পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল টাস্কফোর্স গ্রুপ(এসটিজি) সারা দেশের জঙ্গীদের নিয়ে তথ্য-ভান্ডার তৈরী করেছে। কাউন্টার টেররিজম ইউনিট এবং এসটিজি জঙ্গী দমনে সমন্বয় রেখে কাজ করে যাচ্ছে।
জঙ্গী দমনে র্যাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সংস্থাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৪ই অক্টোবর-২০১৯ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনের ১হাজার ৯৩২জন সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। এর মধ্যে শুধু জেএমবি সদস্য গ্রেফতার হয় ১১৪৬ জন। অন্যদের মধ্যে হুজিবি’র ১৪৪ জন, হিজবুত তাওহীদের ১০৮ জন ও হিজবুত তাহরীর ৩০৪ জন।
এছাড়াও প্রতিষ্ঠার পর থেকে র্যাব জঙ্গী সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও বিস্ফোরক উদ্ধার করে। তার মধ্যে গ্রেনেড/বম্ব/ককটেল ৪৫০টি, অস্ত্র ১৩৪টি, বিস্ফোরক ২ হাজার ৮১০ কেজি, গ্রেনেড বডি ৬৩২টি, ডেটোনেটর ৯ হাজার ২২৪টি, গোলাবারুদ ৫ হাজার ৩৯২ রাউন্ড, সুইসাইডাল ভেস্ট ৫টি, সার্কিট ১৮৬টি, বোমা তৈরীর কন্টেইনার ৪টি, নিওজেলস্টিক ১৮টি, ইম্প্রোভাইজ ডিভাইস ১টি, আইইডি ১৮টি, পাওয়ার জেল ১৬টি, ড্রোন ১টিসহ বিভিন্ন সামগ্রী রয়েছে।
জঙ্গীবাদ বিষয়ে বেসরকারীভাবেও নানা উদ্যোগ লক্ষ্যণীয়। বিশেষত, তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করার লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে নিরলসভাবে অভিনব কায়দায় কাজ করে যাচ্ছে সুচিন্তা বাংলাদেশ ও আজ সারাবেলা। এদের যৌথ আয়োজনে ‘বঙ্গবন্ধুর গল্প শুনি’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলি’ ও ‘জাগো তারুণ্য, রুখো জঙ্গিবাদ’ নামক নিয়মিত আয়োজন সত্যিই প্রশংসনীয়।
গত ২৭শে অক্টোবর-২০১৮ সুচিন্তা বাংলাদেশের এক আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জঙ্গীবাদ বিরোধী প্রচারণায় তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের হাতে সম্মাননা তুলে দেন। এই ধরনের স্বীকৃতি জঙ্গীবাদ বিরোধী কার্যক্রমকে আরো উৎসাহিত করছে।
দেশের সব নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা এবং জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সন্ত্রাস সম্পর্কে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি যেমন কার্যকর, তেমনি এ ক্ষেত্রে দেশের জনগণেরও রয়েছে দায়িত্ব। জঙ্গীবাদমুক্ত দেশ গড়তে প্রয়োজন শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা এবং পারিবারিক শিক্ষা প্রদানের সচেতনতা। তরুণ প্রজন্মকে বিচ্ছিন্নতামুক্ত করতে পাড়া-মহল্লায় খেলার মাঠ ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থা চালু করতে হবে, সুস্থ সংস্কৃতির চর্চা বৃদ্ধির পাশাপাশি পারস্পরিক ভাবনা বিনিময়ও বাড়াতে হবে-যাতে তরুণ সমাজ সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও জঙ্গীবাদ মোকাবিলায় সাংস্কৃতিক আন্দোলনও জরুরী। অপ-সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করতে পারেন।
জঙ্গীবাদ প্রতিরোধে জাতি দল ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি দেশের সকল স্তরের জনগণকে এই আন্দোলনে শরীক হতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রসার ও প্রচার বাড়িয়ে দেশের জনগণকে মুক্তিযুদ্ধোর চেতনায় অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সম্পৃক্ত করতে হবে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হতে হবে। জঙ্গী দমনের পাশাপাশি উগ্রবাদকে সমূলে নির্মূল করতে জ্ঞান চর্চা, বিজ্ঞান চর্চা এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চা বিস্তারে এগিয়ে আসতে হবে। সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ গড়া সম্ভব এবং সে প্রচেষ্টায় আমরা এখনই অনেকখানি এগিয়ে -পিআইডি ফিচার।