আসমান-জমিন এবং এই দুইয়ের মাঝে আমাদের জানা ও অজানা যতকিছু আছে- সবকিছুই মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই একমাত্র স্রষ্টা। মহান রাব্বুল আলামীন তার অনন্ত-অসীম মহিমা প্রকাশের লক্ষ্যে এ মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেন। তিনি আসমান-জমিন এবং এর মধ্যস্থিত সবকিছুকে মাত্র ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। এই মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ, যিনি আকাশম-লী ও পৃথিবী এবং এর অন্তর্বর্তী সবকিছু ছয়দিনে সৃষ্টি করেছেন। (সূরা সিজদাহ, ৩২ : ৪)
বস্তুত এ নিখিল বিশ্বে কি কি রয়েছে? আসমান-জমিন রয়েছে, রয়েছে পাহাড়-পর্বত, নদী-নালাসহ অসংখ্য-অগণিত সৃষ্টি। হাজার-লক্ষ-কোটি মাখলুকাত। আল্লাহ তাআলা ভাসমান চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র ও অসংখ্য তারকা দ্বারা আসমানকে সুসজ্জিত করেছেন। এই সুসজ্জিত আসমান আল্লাহ্ তাআলার অসীম কুদরতের এক বিশেষ অনন্য নিদর্শন। বিস্তৃত ও বিশাল পৃথিবীকে তিনি বৈচিত্র্যময় পাহাড়-পর্বত, খাল-বিল, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর ও সারি সারি বৃক্ষ ও তৃণলতার সমারোহে বিন্যাস করেছেন। এতে রয়েছে মানুষসহ হাজারো রকমের জীব-জন্তু ও পশুপাখি। মানুষের পুষ্টি ও তৃপ্তির জন্য আল্লাহ তাআলা এই স্থলভূমিতে হরেক রকমের খাদ্যশস্য ও সবজির আবাদযোগ্যতা দান করেছেন। এইভাবেই তিনি পৃথিবীকে করেছেন মানুষের বসবাস উপযোগী- সুন্দর এক জগৎ।
জলভাগ বা খাল-বিল, নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরে রয়েছে মাছ ও জলজ প্রাণীর প্রাচুর্য্য। পানির তলদেশে রয়েছে মনি-মুক্তাসহ অফুরন্ত রতœভা-ার। ভূগর্ভে রয়েছে অফুরন্ত পানি ও স্বর্ণ রৌপ্যের অমূল্য খনিজ সম্পদ। এভাবে হাজার-লক্ষ-কোটি মাখলুক আল্লাহ্ তাআলা সৃষ্টি করেছেন। আর সবচেয়ে দামি কথা হলো- এই সব মাখলুকাত বা সৃষ্টির মাঝে মানুষই হলো সৃষ্টির সেরা। আশরাফুল মাখলুকাত। প্রশ্ন জাগতে পারে, কেন মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত? সকল সৃষ্টির মধ্যে আল্লাহ তাআলা একমাত্র মানুষকেই আকল-বুদ্ধি ও বিবেক-বিবেচনার এক স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছেন। তাই মানুষ সেরা- আশরাফুল মাখলুকাত।
স্বভাবতই মনে আরো একটি প্রশ্ন জাগতে পারে যে, আল্লাহ মহান কর্তৃক এসব সৃষ্টির নেপথ্যে রহস্য কী রয়েছে? কেন তিনি এসব কিছু সৃজন করেছেন? এ সব প্রশ্নের রহস্য উন্মোচন করতে গিয়ে বিভিন্ন জন বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। কারো কারো মতে এ বিশ্বপ্রকৃতি আল্লাহর ইচ্ছারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। তিনি কোনো বিশেষ উদ্দেশ্যে এই মহাবিশ্ব ও প্রকৃতি সৃষ্টি করেন নাই। এটা একান্তই অল্প সংখ্যক কিছু মানুষের মতামত- যা বিশেষভাবে কোথাও গৃহীত হয়নি।
সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও প্রসিদ্ধ মতামত হলো- আসমান-জমিন এবং এর মধ্যস্থিত যত কিছু আছে এসব কিছু সৃষ্টি করার রহস্য হলো, আল্লাহ মহানের সত্তা ও গুণাবলী এবং মারিফতের প্রকাশ ঘটানো। গোটা সৃষ্টি যেন তাঁর তাসবীহ-তাহলীল (প্রসংশা) ও ইবাদত-বন্দেগীতে নিয়োজিত হয়ে তাঁর মহাত্ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ করে- এইটাই মূল উদ্দেশ্য। এই মর্মে পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আমাদের প্রতিপালক তিনি যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার আকৃতি দান করেছেন এবং এরপর পথপ্রদর্শন করেছেন। (সূরা তাহা, ২০ : ৫০)
প্রত্যেক বস্তুই নিজ নিজ স্বভাব ও প্রকৃতি অনুযায়ী আল্লাহর তাবসীহ-তাহলীল ও ইবাদত-বন্দেগী করে যাচ্ছে। আরো ইরশাদ হয়েছে, আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সবই আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। একমাত্র আধিপত্য তাঁরই এবং প্রশংসা তাঁরই, তিনি সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান। (সূরা তাগাবুন, ৬৪ : ১)
এছাড়া আশরাফুল মাখলুকাত মানুষ সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, আমি জিন এবং মানুষকে সৃষ্টি করেছি এ জন্যই যে, তারা আমারই ইবাদত করবে। (সূরা যারিয়াত, ৫১ : ৫৬) হজরত ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, ইবাদত-বন্দেগীর দ্বারা মানুষ যেন তাঁর মারিফত বা প্রকৃত পরিচয় হাসিল করতে পারে এটাই মানব সৃষ্টির প্রকৃত রহস্য বা উদ্দেশ্য।
উল্লেখিত আলোচনা থেকে এ কথা প্রতীয়মান হয় যে, মানব সৃষ্টির মূল রহস্য হলো ইবাদত ও বন্দেগী। মানুষ ও জিন ছাড়া অন্যান্য সৃষ্টির রহস্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল-কুরআনে আলোচনা হয়েছে। সংক্ষেপে বলা যায় যে, আল্লাহ্ তাআলা যাবতীয় বস্তুকে মানুষের কল্যাণে ও সহযোগিতার জন্য সৃষ্টি করেছেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, তিনি পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন। (সূরা বাকারা, ২ : ২৯)
অন্য আয়াতে আরো ইরশাদ হয়েছে, তোমরা কি দেখ না আল্লাহ্ আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সমস্তই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন। (সূরা লুকমান, ৩১ : ২০)