॥স্টাফ রিপোর্টার॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে কোন ধরনের নির্যাতনের মানসিকতা তাঁর সরকারের নেই এবং সরকার এ ধরনের কাজ করে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সত্যিকথা বলতে কি, এ ধরনের কোন মানসিকতা আমাদের নেই এবং আমরা সেটা করিও না।’
শেখ হাসিনা গতকাল ৬ই আগস্ট বিবিসি’তে প্রচারিত এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেন। বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের সিনিয়র সাংবাদিক মানসী বড়–য়া এই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, গণতন্ত্র এবং ঋণ খেলাপি হওয়ার সংস্কৃতি সম্পর্কেও কথা বলেন।
মানসী বড়–য়া বলেন, বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতনের ইতিহাস অনেক দিনের। এটি কোন বিশেষ সরকারের আমলে যে ঘটেছে তা নয়। কিন্তু বর্তমান সরকার এ ধরনের নির্যাতন বন্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? জানতে চান তিনি।
উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ঘটনাচক্রে কিছু (দু-একটি) ঘটনা ঘটতে পারে। বরং আপনি যদি গত ১০বছরে আমাদের অবস্থানটা দেখেন- আমরা কিন্তু অপরাধ নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পেরেছি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আপনি আমার নিজের কথাটাই চিন্তা করেন- যখন আমি আমার বাবা-মা-ভাইদের সব হারালাম, খুনীদেরকে বিচার না করে ইনডেমনিটি দেওয়া হলো, অর্থাৎ আপনি অপরাধকে প্রশ্রয় দিলেন।’
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তাঁকে বিচার পেতে ৩৫টি বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘যে দেশে অপরাধকে স্বীকৃতি দিয়েই একটা সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয় সেই দেশে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত কঠিন হয়ে যায়।’
‘তবে আমরা যেকোন অপরাধের জন্য কঠোর আইন প্রয়োগের ব্যবস্থা নিয়েছি। এখন ঐভাবে কখনই হেফাজতে মৃত্যু হয় না বা নির্যাতনও যে খুব একটা করা হয়, তাও নয়,’ যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিকভাবে অপরাধীদের থেকে তথ্য সংগ্রহের যে কতগুলো নিয়ম রয়েছে- সেজন্য আমরা আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিয়ে আসি। তারা এজন্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বহুদেশে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতিতেই অপরাধীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এর বাইরে কোন কিছুই করা হয় না, এটা হলো বাস্তবতা।’
শেখ হাসিনা বলেন, দেশ স্বাধীন হবার সাড়ে ৩বছরের মধ্যেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলো। এই কালচারটাই চলে এলো, এটাই প্রচলিত হলো।
তিনি বলেন, ‘সে সময় দেশে সামরিক শাসন বলবৎ ছিল (কখনও সরাসরি আবার কখনও নাম পরিবর্তন করে) যেখানে ক্ষমতাটা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেই ছিল।’
‘সেখান থেকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে দেশকে একটু সুষ্ঠু ধারায় ফিরিয়ে নিয়ে আসা একটা কঠিন দায়িত্ব, এই কঠিন দায়িত্বটা আমরা পালন করে যাচ্ছি,’ বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘কাজেই এখন যারা সমালোচনা করছে তাদেরকে যদি আপনারা সুনির্দিষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে, আমার মনে হয়, এ সম্পর্কে তারা খুব বেশি তথ্য দিতে পারবে না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা শ্রেণী আছে যারা দেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারটা বেশি করে চালাচ্ছে। দেশে অসাংবিধানিক এবং অস্বাভাবিক সরকার বা মার্শাল ‘ল’ থাকলেই তাদের খুব লাভ হয়।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘তারা সারাক্ষণ আমাদের নানা খুঁটিনাটি দোষক্রটি খুঁজে বের করতে লেগেই আছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার কথা হলো আমার দেশের মানুষ স্বস্তিতে আছে কি না, তারা ভালো আছে কি না।’
তিনি বলেন, ‘আমি জানি, জেনেভাতে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং আমাদের আইন মন্ত্রীও সেখানে উপস্থিত ছিলেন এবং অন্যান্য প্রতিনিধিরাও সেখানে ছিলেন এবং এর যথাযথ উত্তর তারা দিয়ে এসেছেন।’
উল্লেখ্য, ৩০ ও ৩১শে জুলাই জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির(কমিটি এগেইনস্ট টর্চার-ক্যাট) কাউন্সিলে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নির্যাতন এবং অন্যান্য অমানবিক আচরণ বন্ধে বাংলাদেশের সরকার কি ব্যবস্থা নিয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, ‘যুক্তরাজ্যের রাজধানী লন্ডনে চলমান মেডিকেল চিকিৎসা শেষে(চোখের) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল বৃহস্পতিবার দেশে ফিরবেন। তিনি ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এবং রাষ্ট্রদূতদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ‘দূত সম্মেলনে’ যোগদান এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে গত ১৯শে জুলাই লন্ডন পৌঁছেন।
মানসি বড়–য়া বলেন, অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশ এখন খুবই ভালো করছে। গত বছর অন্যতম দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল। তিনি জানতে চান- এ প্রবৃদ্ধির সুফল সবার কাছে কি পৌঁছুচ্ছে?
উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবশ্যই’। তিনি বলেন, ‘একটু চিন্তা করেন ২০০৫-২০০৬ সালে যেখানে আমাদের দারিদ্রের হার ৪১ শতাংশ ছিল সেখানে আজকে সেটা কমে ২১ দশমিক ৪ভাগে নেমে এসেছে। গত ১০ বছরের মধ্যে আমরা এটা অর্জন করতে পেরেছি। মানুষের মাথাপিছু আয় যেটা মাত্র ৪শ’/৫শ’ মার্কিন ডলার ছিল আজকে সেখানে ২০০০ ডলারের কাছাকাছি আমরা পৌঁছে যাচ্ছি। প্রবৃদ্ধি এখন ৮ দশমিক ১ভাগ অর্জন করতে পেরেছি।’
তিনি বলেন, ‘উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হলে স্বাভাবিকভাবেই মূল্যস্ফীতি বাড়ে, সেখানে আমরা কিন্তু মূল্যস্ফীতি বাড়তে দেইনি। আমরা কিন্তু তা ৫ দশমিক ৫ বা ৬’র মধ্যেই ধরে রেখেছি।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘খুব স্বাভাবিকভাবে এর সুফলটা কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছেই পৌঁছায়।’
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভালো হওয়ার পরেও বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে অভিবাসন প্রত্যাশায় দেশের জনগণের একটি অংশের দেশ ত্যাগের প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এটা মানুষের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা।’
তিনি বলেন, ‘আদিকাল থেকেই মানুষের একটা প্রবণতা রয়েছে, এই জায়গায় নয়, অন্য জায়গায় গিয়ে আমার ভাগ্য গড়তে হবে। এটার সাথে দারিদ্রের বিষয়টাকে ঠিক যুক্ত করা যায় না।’ সরকার প্রধান বলেন, ‘কেউ যদি বাংলাদেশে কাজ করতে চায় তাহলে আমরা বিনা জামানতে আমাদের যুব সমাজকে ব্যাংক ঋণ দিচ্ছি।’
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে দেশে বিদ্যমান খেলাপি ঋণের প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যতোটা প্রচার হয় বিষয়টা কিন্তু ততোটা নয়।’ তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও আসার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং ব্যাংকের সচিবের সাথে সভা করেছি। ঋণ নিয়ে না দেয়ার প্রবণতা, এই কালচারটা আমাদের দেশে শুরু হয় সামরিক শাসকদের শাসনামলে। আমরা যখনই সরকারে এসেছি তখনই চেষ্টা করেছি তাদের(খেলাপি) কাছ থেকে টাকাটা আদায় করার।’ প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরো বলেন, ‘সব সময় মার মার কাট কাট করলেতো হবে না, তাদেরকে নরমে-গরমে যেভাবে সম্ভব ঋণ পরিশোধের নিয়মের আওতায় আনতে হবে। এবারের বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা দেয়া হয়েছে যে, আপনারা বেঁধে দেয়া সময়ে ঋণটা ফেরত দিলে আবার নতুন ঋণ পাবেন। না হলে আর দেয়া হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী প্রশ্নকর্তাকে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন- দেখুন এই সমস্যাগুলো যদি এতবড় হতো তাহলে কি আমাদের অর্থনীতি এতটা শক্তিশালী হতো, মজবুত হতো, বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি কি এতটা হতে পারতো? প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে দেশের মানুষের কাছে আমি খুব কৃতজ্ঞ। কারণ আমি যখন ডাক দেই বা একটু কথা বলি, আপনাদের এটা করতে হবে- আমি দেখেছি, মানুষ তাতে সাড়া দেয়।’
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের মান সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেখুন আমাদের দেশে আমি সরকারে আসার আগে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আসার আগে ’৭৫ এর পর থেকে বাংলাদেশে একটিমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল ছিল, সেটাও সরকারী-বিটিভি। একটামাত্র রেডিও। আর কয়েকটি সংবাদপত্র এবং কিছু সরকারী সংবাদপত্র।
তিনি বলেন, ‘আমি এসে সব উন্মুক্ত করে দিলাম বেসরকারী খাতে। এখন ৪৪টি টেলিভিশন। অবশ্য আমার উদ্দেশ্য ছিল অন্যরকম। আমার উদ্দেশ্য ছিল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা।’ মানষি বড়–য়া জানতে চান- এ সকল সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা বর্তমানে কতটুকু রয়েছে?
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গণমাধ্যমের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা বিদ্যমান রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘স্বাধীনতা যদি না থাকতো তাহলে সত্য মিথ্যার মিশ্রণে সরকারের বিরুদ্ধে এত অপপ্রচার তারা কিভাবে করছে আমাকে বলেন।’
শেখ হাসিনা বলেন, যখন সামরিক স্বৈরশাসকেরা ক্ষমতায় ছিলো- এরশাদের আমলে বা জিয়ার আমলে বলেন, এমনকি খালেদা জিয়ার আমলে- এই স্বাধীনতা কি কেউ ভোগ করেছে। সাংবাদিকদের ওপর কি অত্যাচারটা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘সবাই সব কথা বলে, তারপর বলে স্বাধীনতা নাই। তাহলে স্বাধীনতা না থাকলে এত কথা বলল কিভাবে?’
সরকারের সমালোচনা সম্পর্কিত অপর এক প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সরকারের সমালোচনা করা যায় না, একথা বলারতো সাহস পাচ্ছেন। এটাওতো সমালোচনা। আর টক শো আপনি যদি শোনেন, আপনি একটু শুনে দেখবেন যে, তারা কি বলে।’ তিনি বলেন, ‘সকলে মিলে আমরা চেষ্টা করছি একটা শান্তপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করতে, সেখানে যখন উস্কানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয় তখন কি হাত গুটিয়ে কেউ বসে থাকবে। পৃথিবীর কোনো দেশ কি এরকম হাত গুটিয়ে বসে থাকে? কেনো দেশই থাকে না। কারণ সরকারকেতো মানুষের নিরাপত্তা দিতে হবে। নিরাপত্তার জন্য যেটা করণীয় সেটাতো করতেই হবে।’