## মোঃ সামিউল আলম ## পরিবারের কোনো বিষয়ে তার মতামত থাকতে পারে রহিমা কখনও ভাবেনি। সেই রহিমা এখন শুধু মতামত নয়, সিদ্ধান্তও দিতে পারছে। প্রতিবেশীরাও তার কথা শুনছে, তাকে সমীহ করছে। এ এক অন্য রহিমাকে দেখতে পেল নিজের মধ্যে। আর রহিমাকে নতুনভাবে চিনিয়ে দিল সরকারের “মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ’ কার্যক্রম।
রহিমা গ্রাম-বাংলার পরিচিত এক মুখ। গরীব কৃষকের পাঁচ কন্যার একজন। ক্ষুধা, লাঞ্ছনার মধ্যে বেড়ে ওঠা শিশু। শৈশবের গন্ডি না পেরুতেই এক ক্ষেতমজুরের গৃহিনী হয়ে স্বামীর ঘরে আসা। বাবার বাড়ীতে মাকে কখনও দেখেনি পরিবারের ভালো-মন্দে কোন কথা বলতে, শুধু দেখেছে মুখ বুজে দিন-রাত খেটে যাওয়া এক নারীকে। কোন চাওয়া-পাওয়া যাকে স্পর্শ করেনি। স্বামী-সন্তানদের নিয়ে রহিমার সংসারও একইভাবে চলছিল। বছর তিনেক আগে পাশের বাড়ীর কুলসুম ভাবীর কাছে শুনতে পায় সরকার মহিলাদের আত্মকর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্রঋণ দিচ্ছে। অনেকেই এই ঋণ নিয়ে পরিবারে বাড়তি আয়ের ব্যবস্থা করছে। এ কথা শুনে রহিমাও স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, সামান্য পুঁজি পেলে বাড়ীতে কিছু একটা করে সন্তানদের মুখে একটু খাবার দিবে, স্কুলে পাঠাবে, নিজেরা টিনের চালার নীচে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাবে। অবশেষে রহিমার স্বপ্ন একটু একটু করে সত্যি হতে শুরু করল।
রহিমা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ঋণ পেল এবং জানলো কীভাবে এ ঋণ ব্যবহার করে স্বাবলম্বী হতে পারবে, আরও জানলো সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে হবে, বাল্য বিবাহ দেওয়া যাবেনা, যৌতুক নেওয়া ও দেওয়া যাবে না ইত্যাদি। রহিমা এখন সেই পুঁজি দিয়ে ছাগল পালন করে এবং সবজি বাগান করে আয় করছে। তার সন্তানেরা এখন দু’বেলা খেতে পারে, স্কুলে যায়, টিনের চালা ঘরে ঘুমাতে পারছে। এমনকি রহিমা এখন পরিবারের ভালো-মন্দের ব্যাপারে কথা বলে, সিদ্ধান্ত দিতে পারে। প্রতিবেশীরাও তার কথা শোনে, সমীহ করে। এভাবেই গ্রাম-বাংলার হাজারো রহিমারা নিজেকে নতুন রূপে পরিচিত করছে। তারা কথা বলছে, সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বদলে দিচ্ছে নিজেকে, পরিবারকে, সমাজকে আর এভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আর এটা সম্ভব হচ্ছে সরকারের নারী উন্নয়ন ও ক্ষতায়নের সঠিক সিদ্ধান্ত ও কার্যকর প্রয়োগের মাধ্যমে।
বঙ্গবন্ধু জানতেন নারীা উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এ লক্ষ্যে তিনি কাজ শুরু করেছিলেন। এরই ফলশ্রুতিতে আমাদের মহান সংবিধানে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের কথা সন্নিবেশিত হয়েছে। আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ৫নম্বর লক্ষ্যে লিঙ্গ সমতা এবং সকল নারীর ক্ষমতায়নের বিষয় উল্লেখ রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে মোটা দাগে সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণকে বোঝায়। মূলত নারীর ক্ষমতায়ন তিনটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। যেমন ঃ অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন, সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন।
সরকার বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর। এ জন্যই সরকার নারীর ক্ষমতায়নে নানাবিধ কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়ন করে চলেছে। সরকারের ৬ষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নারীদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার অঙ্গীকার করা হয়। সে পরিকল্পনা মোতাবেক এমডিজি ও সিডও সনদ বাস্তবায়নে সরকার সফলতা দেখিয়েছে। এছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে মূলস্রোতে আনার জন্য সরকার বহুমুখী প্রকল্প হাতে নিয়েছেন, যেমন ঃ ভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ নারীর ভাতা, মাতৃত্বকালীন এবং দুগ্ধবতী মায়েদের জন্য ভাতা, অক্ষম মায়েদের ভাতা, তালাকপ্রাপ্তা ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচী, ৪০ দিনের কর্মসূচী, আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প ইত্যাদি। এছাড়াও সরকার মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের মাধ্যমে নারী উন্নয়ন তথা নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রশিক্ষণ, ঋণ প্রদান কর্মসূচীসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এমনকি মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিমের আওতায় একটি ভাউচার প্যাকেজ দেওয়া হয় অবহেলিত, বঞ্চিত, নিগৃহীত জনগোষ্ঠীকে, যার অধীনে তিনটি প্রসবপূর্ব চেকআপ, দক্ষ দাইয়ের অধীনে নিরাপদ জন্মদান, একটি প্রসব পরবর্তী চেকআপ এবং যাতায়াত খরচ বহন করা হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
সর্বোপরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত ১০টি বিশেষ উদ্যোগের মধ্যে আশ্রয়ণ, আমার বাড়ী আমার খামার প্রকল্প, নারীর ক্ষমতায়ন, সমাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচী, ডিজিটাল বাংলাদেশ ইত্যাদি উদ্যোগের মাধ্যমে নারী উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে কার্যকর পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। আর এজন্যই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় নারীর ক্ষমতায়নের জন্য ‘প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ এবং ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ এওয়ার্ড অর্জন, নারী শিক্ষায় অসামান্য অবদানের জন্য ইউনেস্কো কর্তৃক ‘শান্তি বৃক্ষ স্মারক’, নারী শিক্ষা ও উদ্যোক্তাদের অগ্রগতি অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা গ্লোবাল সামিট অন উইমেন এর পক্ষ থেকে ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশীপ’ ইত্যাদি পদকে ভূষিত হওয়ার পাশাপাশি বিশ্ব গণমাধ্যম নারীর ক্ষমতায়নে তাঁর সাফল্যগাঁথা বিশেষ গুরুত্ব সহকারে প্রচার করেছে এবং করছে।
আমাদের মেয়েরা এভারেস্ট জয় করেছে, ক্রীড়াঙ্গণে সাফল্য দেখাচ্ছে, চাকুরী, ব্যবসাসহ পেশাগত বিভিন্ন ক্ষেত্রে দক্ষতা দেখাচ্ছে। সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নেও আমাদের নারীরা বিশ্বে দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের ঈর্ষণীয় সাফল্য থাকলেও আমাদের হীন মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি, ধর্মীয় কুসংস্কার, আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, যৌতুক এবং বিশেষ করে বাল্য বিবাহের কারণে সেই কাঙ্খিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারি নাই। আমাদের অনেক অর্জনের লাগাম টেনে ধরছে বাল্য বিবাহ নামক এক ভয়ংকর সামাজিক ব্যাধি। আমাদের সামষ্টিক উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় বাধা এই বাল্য বিবাহ। এটাকে অবশ্যই আমাদের রোধ করতে হবে, নয়তো আমাদের দৃশ্যমান অর্জনকে এগিয়ে নিতে পারব না। ফলে সুদূর পরাহত হবে আমাদের টেইসই উন্নয়ন।
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ আর আমাদের সমাজ উন্নয়নের জন্য, কল্যাণকর সৃষ্টির জন্য অবশ্যই নর-নারী সকলের সামষ্টিক উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন প্রয়োজন। নারী উন্নয়ন ও ক্ষতায়নের বাধাসমূহ দূর করার মধ্য দিয়ে গ্রাম-বাংলার লাখো রহিমাকে কল্যাণকর সৃষ্টির অংশীদার করার মধ্য দিয়ে আমাদের এ দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। যেমনিভাবে আমরা স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছি, তেমনিভাবে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি ২০৪১ সালের মধ্যে পৌঁছে যাবে উন্নত বিশ্বের কাতারে -পিআইডি প্রবন্ধ।