মুফতি মাওলানা মুহাম্মদ রুকুন উদ্দীন ক্বাদরী ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ হচ্ছে সাওম বা রোজা। আত্মসংযম, আত্মনিয়ন্ত্রণ, আত্মশুদ্ধি ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধনে রোজা একটি অপরিহার্য ইবাদত। আর রোজা চাঁদ দেখে শুরু করতে হয় এবং চাঁদ দেখেই তা ছাড়তে হয়।
সাওম বা রোজার পরিচয় ঃ সাওম এর আভিধানিক অর্থ শব্দগত দিক থেকে সাওমুন এবং সিয়াম উভয়টিই মাসদার বা ক্রিয়ামূল। এর আভিধানিক অর্থ (১) কাজ থেকে বিরত থাকা (২) কঠোর সাধনা করা (৩) অবিরাম প্রচেষ্টা (৪) আত্মসংযম।
পারিভাষিক সংজ্ঞা ঃ (১) আল্লামা আবুল হাসান কুদূরী(রঃ) ও জমহুর ওলামায়ে কেরাম বলেন-নির্দিষ্ট শর্তাবলীর মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কতিপয় কাজ থেকে বিরত থাকার নাম সাওম (২) শরহে বেকায়া গ্রন্থকার বলেন- সাওম বা রোজা হলো সুবহে সাদেক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস হতে বিরত থাকা (৩) আল মুজামুল ওয়াসীত গ্রন্থকার বলেন-সাওম হলো সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়ত সহকারে পানাহার হতে বিরত থাকা।
চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যাপারে শরীয়ার বিধান ঃ রমজানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণের ব্যাপারে ইমামগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। যেমন- (১) হযরত ইমাম আবু হানিফার অভিমত ঃ ইমাম আবু হানিফা(রঃ) এর মতে, চাঁদের উদয়স্থলে মেঘাচ্ছন্ন থাকলে রমজানের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার জন্য একজন বিশ্বস্ত পুরুষের সাক্ষ্যই যথেষ্ট; কিন্তু উদয়স্থল পরিষ্কার থাকলে বহু লোকের চাঁদ দেখা শর্ত। দলিল ঃ হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এর বর্ণিত হাদীস যাআ আরাবিয়ুন ইলা নবীয়ি (সাঃ) ফাকালা ইন্নি র’আইতুল হিলালা (২) হযরত ইমাম আহমদের অভিমত ঃ ইমাম আহমদ(রঃ) এর মতে, রমজানের চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার জন্য একজন বিশ্বস্ত পুরুষের সাক্ষ্যই যথেষ্ট; তাই চাঁদের উদয়স্থল পরিষ্কার থাকুক বা মেঘাচ্ছন্ন থাকুক। তবে শাওয়ালের চাঁদ দেখার জন্য মেঘাচ্ছন্ন আকাশের ক্ষেত্রে দু’জন দর্শকের সাক্ষী জরুরী (৩) হযরত ইমাম মালেকের অভিমত ঃ ইমাম মালেক (রঃ) এর মতে, চাঁদ দেখা প্রমাণিত হওয়ার জন্য কমপক্ষে দু’জন বিশ্বস্ত পুরুষের সাক্ষ্য জরুরী (৪) হযরত ইমাম শাফেয়ীর অভিমত ঃ ইমাম শাফেয়ী (রঃ) এ ব্যাপারে দু’টি মত ব্যক্ত করেছেন। প্রথমটি ইমাম মালেক (রঃ) এর মত এবং অন্যটি ইমাম আবু হানিফা(রঃ) এর মত।
সিদ্ধান্ত ঃ মোট কথা, রমজানের চাঁদ দেখার সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তির সাক্ষ্যই যথেষ্ট। আর শাওয়ালের চাঁদ দেখার ক্ষেত্রে ন্যূনতম দু’জন সাক্ষী জরুরী। তবে আকাশ পরিষ্কার থাকলে দু’জন পুরুষ বা একজন পুরুষ ও দু’জন মহিলার সাক্ষী আবশ্যক।
চাঁদ দেখে সাওম শুরু করো, চাঁদ দেখে সাওম ভাঙ্গো ঃ ইসলামের অধিকাংশ ইবাদত চান্দ্রমাসের সাথে সম্পৃক্ত। সাওম ইসলামের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। তাই সাওম চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। রমজানের চাঁদ দেখে সাওম শুরু করতে হবে এবং শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখে তা ভঙ্গ করতে হবে। ‘চাঁদ দেখে সাওম শুরু করো চাঁদ দেখে সাওম ভাঙ্গো’ আল্লাহ্র হাবিব তাজেদারে কায়েনাত দোজাহানের বাদশাহ আহাম্মাদে মুজতবা হযরত মুুহাম্মাদ মুুস্তাফা (সাঃ) এর পবিত্র মুখ নিঃসৃত এ বাণীটির তাৎপর্য নিম্নরূপ- (১) ইবাদতের সাথে সময়ের সম্পর্ক ঃ ইবাদতের সাথে সময়ের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। এ হিসেবে সাওম বা রোজা ফরয হওয়া চন্দ্রের সাথে সম্পর্কিত, আর সাওম পালন সূর্যের সাথে সম্পর্কিত নব চন্দ্র দেখা রোজা ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত। আর মাসের আগমন রোজা পালনের জন্য শর্ত। যেমন আল্লাহ্তায়ালা ইরশাদ করেন “ফামান শাহিদা মিনকুমু-শাহরা ফালয়াসুমহু” অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যে রমজান মাস পায় সে যেন রোজা রাখে (২) রমজানের চাঁদ দেখলে রোজা ফরজ হয়। চাঁদ উদিত হয়েছে তা স্বচক্ষে দেখা বা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তির মাধ্যমে চাঁদ ওঠার সংবাদ পেলে সাওম পালন করা ফরজ। দলিল ঃ হুজুর পাক (সাঃ) এর পবিত্র জবান মুবারকের বাণী-তোমরা চাঁদ দেখে রোজা পালন কর এবং চাঁদ দেখে রোজা ভঙ্গ কর। এ হাদিস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, রোজা রাখা এবং রোজা ভঙ্গ করা উভয়টিই চাঁদ দেখার ওপর নির্ভরশীল। তাছাড়া রমজান মাসের আগমন হলো রোজার জন্য সব, তথা কারণ। সব পাওয়া না গেলে মুসাব্বার, তথা কারণ বাস্তবায়ন আবশ্যক হয় না। আর রমজানের আগমনের সূচনা হলো চাঁদ দেখা। কারণ চান্দ্র মাস চাঁদের সাথে সম্পৃক্ত। সুতরাং চাঁদ দেখা রোজা রাখার পূর্বশর্ত। তাই শাবান মাসের উনত্রিশ তারিখ সন্ধ্যায় রমজানের চাঁদ তালাশ করা মুসলমানদের ওপর ওয়াজিব (৩) উনত্রিশে শাবান চাঁদ না দেখা গেলে তার বিধান-যদি উনত্রিশে শাবান চাঁদ দেখা না যায়, তাহলে রোজা রাখা যাবে না, বরং আরেক দিন বৃদ্ধি করে শাবান মাসকে ত্রিশ দিন গণনা করতে হবে। যেমন- হুজুর পাক(সাঃ) এর পবিত্র জবান মুবারকের বাণী- তোমরা সাওম পালন করবে না, যতক্ষণ চাঁদ দেখতে পাবে না এবং সাওম ভাঙ্গবে না যতক্ষণ চাঁদ দেখতে পাবে না। ২৯ তারিখ আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলে সে মাসে ত্রিশ দিন পূর্ণ করে নাও। হুজুর পাক(সাঃ) অন্যত্র বলেন, যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে, তবে শাবান মাসকে ত্রিশ দিন পূর্ণ করবে (৪) রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার জন্য রমজানের চাঁদ নিজের চোখে দেখা শর্ত নয়, বরং কোন নির্ভরযোগ্য মাধ্যমে শুনলে অথবা বিশ্বস্ত কেউ দেখেছে বললে রোজা রাখা আবশ্যক হবে। সাওম ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। ফলে তার গুরুত্ব অপরিসীম। এ সাওম তথা রোজার জন্য শরীয়ত রমজান মাস নির্ধারিত করে দিয়েছে। তাই রমজানে চাঁদ দেখার মাধ্যমে সাওম শুরু করতে হয় এবং শাওয়ালের চাঁদ দেখার ওপর ভিত্তি করে সাওম রাখা বন্ধ করতে হয়। আল-কুরআনের আয়াতের আলোকে সাওম। অর্থ ঃ হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য সাওম বা রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণের উপর। আশা করা যায়, তোমাদের মধ্যে তাকওয়ার গুণ ও বৈশিষ্ট্য জাগ্রত হবে। সূরা বাকারা ১৮৩। অর্থ ঃ রমজান মাস, ইহাতেই কুরআন মজীদ নাযিল হয়েছে, তা গোটা মানব জাতির জন্য জীবন-যাপনের বিধান এবং তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশাবলীতে পরিপূর্ণ যা সঠিক ও সত্য পথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিষ্কার রূপে তুলে ধরে। সূরা বাকারা ১৮৫। অর্থ ঃ সাওম বা রোযার সময় রাত্রি বেলা স্ত্রীদের সাথে সহবাস তোমাদের জন্য হালাল করে দেয়া হয়েছে। তারা তোমাদের পক্ষে পোশাকস্বরূপ আর তোমরাও তাদের জন্য পোশাকস্বরূপ। সূরা বাকারা ১৮৭ । অর্থ ঃ আর রাত্রি বেলা খানাপিনা কর যতক্ষণ পর্যন্ত না তোমাদের সম্মুখে রাত্রির বুক হতে প্রভাতের শেষ আভা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে। তখন এসব কাজ পরিত্যাগ করে রাত্রি পর্যন্ত তোমরা রোযা পূর্ণ করে লও। সূরা বাকারা ১৮৭। অর্থ ঃ আজ হতে যে ব্যক্তিই এ মাসের সম্মুখীন হবে তার পক্ষে পূর্ণ মাসের রোজা রাখা একান্ত কর্তব্য। আর যদি কেহ অসুস্থ হয় কিংবা ভ্রমণ কার্যে ব্যস্ত থাকে তবে সে যেন অন্যান্য দিনে এ রোযা পূর্ণ করে নেয়। সূরা বাকারা ১৮৫। (লেখক ঃ শিক্ষক, আঞ্জুমান-ই-ক্বাদরীয়া সাবি-ইল-হাসান দাখিল মাদ্রাসা, দৌলতদিয়া, গোয়ালন্দ, রাজবাড়ী)।