মোহাম্মদ রাশেদুজ্জামান শাহিনূর বেগম। ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের এই নারী লেবাননে কাজের উদ্দেশ্যে যাত্রা পথে পাচার হয়ে সিরিয়ায় চলে যায়। অবর্ণনীয় শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের একপর্যায়ে সৌভাগ্যক্রমে সে সরকারী-বেসরকারী সংস্থা আর গণমাধ্যমের সহায়তায় দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। দেশে ফেরার পর শুরু হয় নতুন যুদ্ধ। পারিবারিক-সামাজিক লাঞ্ছনার সাথে খাপ খাওয়ানো, নিঃস্ব অবস্থায় দিনাতিপাত করা, সম্মান নিয়ে বাঁচার যুদ্ধ। এ অবস্থায় কিছু সহানুভূতিশীল ব্যক্তির কল্যাণে সে জানতে পারে ওয়েজ আর্নার্স ওয়েলফেয়ার বোর্ডের কথা। যে বোর্ড প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণে নিয়োজিত। সেখানে আবেদন করে সম্বলহীন শাহিনূর এক লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা পায়। সেই টাকা দিয়ে সে এখন নতুনভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে।
বহুকাল আগে থেকেই অধিক উপার্জন আর উন্নত জীবনের আশায় পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও প্রবাসে বিভিন্ন কর্মে নিজেদের নিয়োজিত করেছে। বিপুল জনগোষ্ঠীর এই দেশের শ্রমবাজারে প্রতি বছর প্রায় ২০ লাখেরও বেশী নারী ও পুরুষ যুক্ত হচ্ছে। তার তুলনায় কর্মসংস্থানের হার একেবারেই কম। তাই এর বিরাট একটি অংশ কর্মহীন হয়ে পড়ে। কর্মহীন থাকলে স্বাভাবিকভাবেই সমাজে নানা রকম সমস্যার সূত্রপাত হয়। তখন একরকম বাধ্য হয়েই ভাবতে হয় অভিবাসনের কথা। নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে বিদেশে নারী কর্মী প্রেরণ শুরু করে। এরপর থেকে সরকার প্রায় ২০-২৫টি দেশে মোট ৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৯৫ জন নারী কর্মীকে চাকুরীর জন্য প্রেরণ করেছে। এতে রেমিটেন্সও এসেছে প্রচুর। তাদের প্রেরিত রেমিটেন্সই বাংলাদেশের বিকাশমান অর্থনীতিকে সচল রেখেছে।
বাংলাদেশের নারী কর্মীদের অভিবাসনের ইতিহাস অতটা সুখকর নয়। যেসব নারী কর্মী বিদেশে যায় তাদের অধিকাংশই অদক্ষ। অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে নিয়মিত কর্মে নিযুক্ত নয়। অনেকে সমাজ-সংসারের নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে পাড়ি জমায় বিদেশে। এদের মধ্যে কেউ কর্মস্থলে দক্ষতার প্রমাণ দিয়েছে, আবার কেউ শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের কারণে দেশে ফিরে এসেছে। কেউ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছে। কেউ কেউ হাসপাতালে শারীরিক ও মানসিক চিকিৎসা নিচ্ছে।
প্রবাসে কর্মীরা সফল হোন আর বিফল হোন তাদেরকে সরকার দেশের মানব সম্পদ হিসেবেই মূল্যায়ন করে। সরকার তাদের প্রেরিত অর্থ আর অর্জিত দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে চায়। এ লক্ষ্যে সরকার ওয়েজ আর্নার্স আইন-২০১৭ নামে একটি আইন পাশ করেছে। এতে বলা আছে-ওয়েজ আর্নার্স বোর্ড বিদেশে কর্মরত কোন নারী অভিবাসী কর্মী নির্যাতনের শিকার, দুর্ঘটনায় আহত, অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে বিপদগ্রস্ত হলে তাদের উদ্ধার ও দেশে আনা, আইনগত ও চিকিৎসা সহায়তার দেয়া, দেশে প্রত্যাগত নারী কর্মীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুনর্বাসন ও পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এবং দেশে-বিদেশে সেফ হোম ও হেল্প ডেস্ক পরিচালনা করতে পারবে। এছাড়াও সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সাথে নিয়ে প্রত্যাগত নারী কর্মীদের পুনর্বাসনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মাধ্যমে প্রত্যাগত নারী কর্মীদের সব ধরণের সামাজিক নিরাপত্তাসহ দেশেই সম্মানজনক কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।
এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ থেকে ২ হাজার ১৮৯ জন নারী কর্মী বিদেশে গমন করে। ১৯৯২ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত এই সংখ্যা কোনভাবেই দুই হাজারকে অতিক্রম করতে পারেনি। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত চার বছরে মোট ২ হাজার ৪১৮ জন নারী কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে এই সংখ্যা ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকে। প্রসঙ্গত ২০১৫ সালের পূর্বে বাংলাদেশের নারী কর্মীদের সৌদি আরবে কর্মসংস্থান প্রায় বন্ধই ছিল। ২০১৫ সালে সৌদির শ্রমবাজার খুলে যাওয়ার ফলে ২০১৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে নারী কর্মীদের বিদেশে গমনের সংখ্যা রাতারাতি লাখ ছাড়িয়ে যায়। এই ৪ বছরে মোট ৩ লক্ষ ৪৩ হাজার ৮৩২ জন নারী কর্মীর বৈদেশিক কর্মসংস্থান হয়েছে। এর মধ্যে শুধু সৌদি আরবেই গিয়েছে ২ লক্ষ ৪৬ হাজার নারী কর্মী। ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ৭ লক্ষ ৯৭ হাজার ৬৯৫ জন নারী কর্মী বিদেশে গমন করেছে। সরকার নতুন করে হংকং, জর্ডান, লেবানন, ওমানসহ কয়েকটি দেশের সাথে বিভিন্ন সেক্টরে নারী কর্মী প্রেরণের চুক্তি করেছে। অন্যান্য দেশেও নারী কর্মী প্রেরণের জন্য সরকার সচেষ্ট রয়েছে। সেই সাথে জোর দেওয়া হচ্ছে দক্ষ নারী কর্মী প্রেরণের বিষয়টিতেও।
নারী কর্মীদের নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিদেশ গমনেচ্ছু নারী কর্মীদের সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে বিএমইটিতে নারী অভিবাসী কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। দেশের প্রায় সব জেলা/উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ভাষা ও ট্রেড প্রশিক্ষণ প্রদান করে নারী কর্মীদের যোগ্য করে তোলা হচ্ছে। নারী কর্মীদের অধিকার রক্ষায় আলাপ-আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিদেশে নির্যাতনের শিকার নারী কর্মীদের জন্য সেফ হোম নির্মাণ, শেল্টার হাউজ স্থাপন, দেশে নিরাপদে ফিরিয়ে আনা, নারী কর্মীদের সেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করা, নিরাপদ কর্মপরিবেশের নিশ্চয়তাসহ বেতন ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষ নেগোসিয়েশন করছে।
প্রত্যাগত নারী কর্মীরা বিমান বন্দরে আসার সাথে সাথে প্রবাসী কল্যাণ ডেস্কের মাধ্যমে মেডিকেল সুবিধাসহ নানা সহায়তা ও প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের মাধ্যমে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। চালু রয়েছে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন ‘প্রবাস বন্ধু কল সেন্টার’ যার নম্বর (+৮৮০১৭৮৪৩৩৩৩৩৩, +৮৮০১৭৯৪৩৩৩৩৩৩ এবং +৮৮০২৯৩৩৪৮৮৮)। সরকার বিদেশ গমনেচ্ছু নারী-পুরুষ সকলকে জেনে, বুঝে, ভাষা শিখে ও যথাযথ ট্রেনিং নিয়ে অভিবাসনের পরামর্শ দিচ্ছে।
অন্য দিকে, সৌদি আরব নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের একটি বড় শ্রমবাজার এবং ভ্রাতৃ প্রতিম মুসলিম দেশ। সে জন্য আমাদের শ্রমিকরাও সেখানে যেতে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমরা সৌদি আরবকে যে শ্রদ্ধার অবস্থানে রেখেছি নিশ্চয় সৌদি আরব সে সম্মানের মূল্যায়ন করবে। এতে দুই দেশই লাভবান হবে। সৌদি আরবসহ হোস্ট দেশগুলোকে আন্তর্জাতিক আইন মেনে চলতে হবে। এতে করে কর্মীদের প্রবাস জীবন স্বস্তির হবে।
প্র্রায়ই বিভিন্ন দেশ থেকে নারী কর্মীরা ফিরে আসছেন। দেশের অনেক মহল থেকেই নারী কর্মীদের বিদেশে প্রেরণের ব্যাপারে নেতিবাচক মতামত আসছে। তবে অভিবাসন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কাজের খোঁজে মানুষ স্ব-উদ্যোগেই বিদেশে যায়। বাংলাদেশের নারী সমাজের অর্থনৈতিক মুক্তি ও টেকসই সামাজিক অবস্থান সৃষ্টি করতে নারী কর্মীদের অভিবাসন অত্যন্ত জরুরী। লক্ষণীয় যে, বিগত সময়ে নারী কর্মীদের অভিবাসন বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হওয়ায় নারী পাচারের ঘটনা ঘটতো। অভিবাসন ও মানব পাচার একে অপরের সাথে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। অভিবাসন ব্যাহত হলে মানব পাচার বেড়ে যাবে-এটাই স্বাভাবিক।
শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে জনসচেতনতা তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিগ্রহের শিকার হয়ে প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। বিদেশ গমনেচ্ছু নারী কর্মীদের সতর্ক থাকতে হবে। নারী কর্মীরা জেনে, বুঝে, ভাষা শিখে, বেসিক আইন-কানুন জেনে, যে এজেন্সীর মাধ্যমে যাবে সেই এজেন্সীর সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে, যথাযথ প্রশিক্ষণ নিয়ে বিদেশে গেলে, দেশীয় প্রশিক্ষণের মান ও মেয়াদ বাড়ালে, তাদের প্রত্যেকের হাতে স্মার্ট ফোন দেওয়া হলে, পাসপোর্ট ও ছাড়পত্র পাওয়ার ক্ষেত্রে আরো নজরদারী বাড়ালে এবং সরকার ও দূতাবাসের মাধ্যমে নারী কর্মীদের খোঁজ নিলে, সময়ে সময়ে মালিকদের কাছে কর্মীদের ব্যাপারে খোঁজ নেওয়া হলে, মাঝে-মধ্যে ছুটি-অবসর-বিনোদনের ব্যবস্থা করা হলে, সুষ্ঠু ডাটাবেজ ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার হলে, নির্যাতন ও প্রতারণাকারীকে উপযুক্ত শাস্তি দিতে পারলে নারী কর্মীদের শ্রম অভিবাসনের ক্ষেত্রে অনেক সমস্যাই লাঘব হতে পারে। সকল প্রতিকূলতা ও প্রতিবন্ধকতা দূর করে জয় হোক সকল নারী কর্মীর, জয় হোক বাংলার শ্রমজীবী মানুষের -পিআইডি প্রবন্ধ।