##মোঃ আবুল বশার## বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার, প্রধান সমুদ্রবন্দর এবং বৃহত্তম বাণিজ্যিক নগরী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম। যে বন্দর দিয়ে দেশের ৭৯% পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে। সেখানে যানজটমুক্ত আমদানি-রপ্তানি ও সময় বাঁচানোর জন্য সরকার টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
প্রস্তাবিত টানেল চট্টগ্রাম বন্দর নগরকে কর্ণফুলী নদীর অপর অংশের সাথে সরাসরি সংযুক্ত করবে এবং পরোক্ষভাবে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের মাধ্যমে সারাদেশের সাথে সংযুক্ত করবে। চট্টগ্রাম পরিণত হবে চীনের সাংহাইয়ের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন। চট্টগ্রাম অঞ্চলের কোটি মানুষের স্বপ্নের কর্ণফুলী টানেলটির নাম ইতোমধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। শুধু দেশেই নয় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সুড়ঙ্গপথ এটি।
গত বছরের ১৪ই অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরকালে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি হয়। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শি জিন পিং বহুল প্রতীক্ষিত এই প্রকল্পের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করেন। তিন হাজার পাঁচ মিটার দীর্ঘ দেশের প্রথম টানেল নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। যার সিংহভাগ অর্থায়ন করবে চায়না এক্সিম ব্যাংক। আগামী ২০২২ সালের ডিসেম্বরে টানেলটি সম্পন্নের টার্গেট নির্ধারণ করেছে সেতু বিভাগ। কর্ণফুলী নদীর মোহনায় কাফকো, আনোয়ারা-পতেঙ্গা পয়েন্টে টানেলটি নির্মাণ করা হবে। এটি নদীর পশ্চিম পাশে সি বিচের নেভাল গেট পয়েন্ট থেকে নদীর ১৫০ ফুট নিচ দিয়ে অপর পাশে গিয়ে উঠবে আনোয়ারায়। নদীর তলদেশে এর গভীরতা হবে সর্বনিম্ন ৩৬ ফুট থেকে সর্বোচ্চ ১০৮ ফুট। মোট দুইটি টিউব নির্মিত হবে। একটি দিয়ে শহরপ্রান্ত থেকে টানেলে প্রবেশ করবে, অপরটি দিয়ে শহরে আসবে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের সাড়ে ৩২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে।
টানেলের প্রতিটি টিউব চওড়া হবে ১০ দশমিক ৮ মিটার বা ৩৫ ফুট এবং উচ্চতা হবে ৪ দশমিক ৮ মিটার বা ১৬ ফুট। একটি টিউবে বসানো হবে দুটি স্কেল, থাকবে দুই লেনে গাড়ি চলাচলের ব্যবস্থা। পাশে থাকবে আরও একটি টিউব। মাঝে ফাঁকা থাকবে ১১ মিটার। যে কোন বড় যানবাহন দ্রুত ও খুব স্বাচ্ছন্দে চলতে পারবে। এখন মূল খনন কাজ শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৪শে ফেব্রুয়ারী তারিখে কম্পিউটারের সাহায্যে বোরিং কার্যক্রম উদ্বোধন করেছেন। খনন কাজের জন্য মূলযন্ত্র টিবিএম স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আগেই এ মেগা প্রকল্পের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী।
বিশিষ্টজনদের ধারণা, দেশের প্রথম এবং একমাত্র টানেলটি চালু হলে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। আসবে অনেক উদ্যোক্তা, করবে বিনিয়োগ। টানেলের দুই প্রান্তে গড়ে উঠবে নানা ধরণের শিল্প প্রতিষ্ঠান। বাড়বে কর্মসংস্থান, মুছে যাবে বেকারত্ব। সরকারের গৃহীত ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অর্থনৈতিক করিডোর বাস্তবায়ন আরও একধাপ এগিয়ে যাবে।
কর্ণফুলী নদীর ওপারে গড়ে উঠবে অর্থনৈতিক জোন ও সমৃদ্ধ আরও এক মহানগরী। এর ফলে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সাথে দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম ও রাজধানী ঢাকার দুরত্ব আরও কমে যাবে। চাপ কমবে নদীর ওপর থাকা অন্য দুই সেতুর। একই সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপিত হবে প্রস্তাবিত সোনাদিয়া সমুদ্রবন্দরের সঙ্গেও।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল তৈরির খননকাজ শুরুর জন্য প্রাথমিক যে সমস্ত অবকাঠামো দরকার সেগুলো প্রায় শেষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের জুনে চীন সফরের সময় এ টানেল নির্মাণে চীনের সাথে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন। ২০১৫ সালের ৩০শে জুন বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এবং সিসিসিসি’র মধ্যে বাণিজ্যিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কর্ণফুলী নদীর উত্তরপ্রান্তে সমৃদ্ধ মহানগরী হলেও অপরপ্রান্তে এখনও গ্রাম।
বর্তমানে কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু ও শত বছরের পুরোনো রেলসেতু দিয়ে ক্রমবর্ধমান যান চলাচল সামাল দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া কর্ণফুলী নদীর তলদেশে পলি জমার কারণে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থায় কর্ণফুলীতে নতুন করে কোনো ব্রিজ নির্মাণ না করে নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া সরকারের দুরদর্শী পরিকল্পনা।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলায় প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এর জন্য অপরিহার্য অবকাঠামো সুবিধাসম্পন্ন করে বিনিয়োগের উপযোগী করতে টানেলটি গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম মহানগরী থেকে সড়কপথে মাত্র ২৮কিলোমিটার দুরত্বে কর্ণফুলী টানেল প্রকল্পটি অবস্থিত। টানেল নির্মিত হলে দূরত্ব অর্ধেকে নেমে আসবে, সময়ও বাঁচবে। আনোয়ারায় অর্থনৈতিক জোনটি হবে দেশের প্রথম জিটুজি অঞ্চল।
প্রস্তাবিত সোনাদিয়া মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর, কোরিয়ান রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, চীনা বিশেষায়িত রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল এবং কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের হাব ও এলএনজি টার্মিনালের সঙ্গে সরাসরি এই টানেল যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে এ অঞ্চলটিতে ব্যাবসা বাণিজ্য ও উন্নয়নের অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের কাতারে নিয়ে যেতে এবং জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল হবে উন্নয়নের বিশেষ নিয়ামক। -পিআইডি প্রবন্ধ।