॥স্টাফ রিপোর্টার॥ ক্রীড়াঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র রাজবাড়ীর লায়লা নূর বেগম(৪৭) ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় সদ্য অনুষ্ঠিত ১৮তম এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের একমাত্র জাজ হিসেবে সফলভাবে সাঁতার পরিচালনা করে এলেন। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মানজনক ‘জাতীয় ক্রীড়া পদক’ প্রাপ্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যাতিমান এই সাঁতারু গতকাল ১৩ই সেপ্টেম্বর বিকালে দৈনিক মাতৃকণ্ঠের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় তার বর্ণিল ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত জীবনের নানা কথা জানালেন।
লায়লা নূর বেগমের জন্ম রাজবাড়ী শহরের ভবাণীপুরে (স্টেডিয়াম সংলগ্ন)। বাবা মরহুম ওবায়দুল হকের আদি নিবাস ফেনী জেলায়। কালেক্টরেটে চাকরীর সুবাদে ১৯৫৪ সালে রাজবাড়ীতে আসেন। ভালো লেগে যাওয়ায় এখানেই স্থায়ী হয়ে যান। ৬ ভাই-বোনের মধ্যে ৫ম লায়লা নূরের অন্যান্য ভাই-বোনেরাও খেলাধুলার সাথে জড়িত। বলতে গেলে আদর্শ একটি ক্রীড়া পরিবারের সন্তান তিনি। ছোট বোন নূর-ই-আফরোজও একজন জাতীয় সাঁতারু। বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক, মেঝ ভাই ইঞ্জিনিয়র একরামুল হক, ছোট ভাই এমবিএ করা ফজলুল হক ও বড় বোন স্কুল শিক্ষিকা নূরজাহান বেগম ফুটবল, সাঁতার ও ক্রিকেট খেলতেন। জাতীয়, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে এবং স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হয়ে খেলেছেন।
লায়লা নূর ছোটবেলা থেকেই ভালো সাঁতারু। প্রতিবেশী খ্যাতিমান সাঁতার কোচ এরশাদুন্নবীর হাতে তার সাঁতারের হাতেখড়ি। ১৯৭৯ সালে মাত্র ৮ বছর বয়সে জাতীয় পর্যায়ের সাঁতারে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮২ সালে জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার ৩টি ইভেন্টে প্রথম স্থান অধিকার করে জাতীয় পর্যায়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৮৩ সালে চতুর্থ জাতীয় এজগ্রুপ (বয়সভিত্তিক) সাঁতারে ১৫-১৭ গ্রুপে ১২টি ইভেন্টের মধ্যে ১২টিতেই অংশগ্রহণ করে ১২টিতেই প্রথম হয়ে সাড়া জাগান, যে রেকর্ড এখন পর্যন্ত কেউ ভাঙতে পারেনি। ১৯৮৬ সালে জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত জাতীয় সাঁতার প্রতিযোগিতার ৬টি ইভেন্টে প্রথম ও ২টিতে দ্বিতীয় হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। ওই প্রতিযোগিতার ১৩-১৪ গ্রুপে লায়লা নূরের ছোট বোন নূর-ই-আফরোজ ২টিতে প্রথম ও ২টিতে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করায় দলগত পয়েন্টে রাজবাড়ী জেলা চ্যাম্পিয়ন হয়। ১৯৮৭ সালেও তিনি ৩টিতে প্রথম ও ১টিতে দ্বিতীয় হয়ে ব্যক্তিগত চ্যাম্পিয়ন হন। ১৯৮৮, ১৯৮৯, ১৯৯০ ও ১৯৯১ সালে পর পর ৪বছর ৪টি করে ইভেন্টে টাইমিং ব্রেক করে জাতীয় রেকর্ড গড়ে দ্রুততম সাঁতারু হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। ১৯৯১ সালে শ্রীলংকার কলম্বোয় অনুষ্ঠিত এস.এ গেমসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মহিলা টিম অংশগ্রহণ করে এবং তিনি তাতে ২টি ব্রোঞ্জ পেয়ে বর্ণাঢ্য সাঁতার ক্যারিয়ার সমাপ্ত করেন।
সাঁতার ক্যারিয়ার সমাপ্তের পর লায়লা নূর ১৯৯১-৯২ শিক্ষাবর্ষে স্কলারশীপ প্রোগ্রামের আওতায় ভারতের পাঞ্জাবের পাতিয়ালা থেকে সাঁতারের কোচিংয়ের উপর ডিপ্লোমা সম্পন্ন করেন। ১৯৯৭-৯৮ শিক্ষাবর্ষে সরকারী শারীরিক শিক্ষা কলেজ, ঢাকা থেকে বিপিএড (ব্যাচেলর অব ফিজিক্যাল এডুকেশন) ডিগ্রী লাভ করেন। এতে তিনি সারা দেশের মধ্যে ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হন। ১৯৯৯ সালে একমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে জার্মানীর লাইপজিক ইউনিভার্সিটি থেকে সাঁতারের উপর উচ্চতর ডিগ্রী লাভ করেন। এরপর ২০১৩ সালে উত্তরা ইউনিভার্সিটি থেকে প্রথম শ্রেণীতে এমপিএড (মাস্টার্স অব ফিজিক্যাল এডুকেশন) ডিগ্রী লাভ করেন। এছাড়া বিশ্ব সাঁতার সংস্থা ফিনা (ফেডারেশন অব ইন্টারন্যাশনাল ডিন্যাটেশন)’র অধীনে একাধিক কোর্স করেছেন।
অপরদিকে একাডেমিক শিক্ষার মধ্যে রাজবাড়ী টাউন মক্তব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্তের পর ১৯৮৫ সালে রাজবাড়ী সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি, ১৯৮৭ সালে রাজবাড়ী সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি এবং একই কলেজ থেকে ১৯৯১ সালে ডিগ্রী পাস করার পর ১৯৯৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাইব্রেরী সায়েন্স এন্ড ইনফরমেশন টেকনোলজীতে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
লায়লা নূর ১৯৯৪ সালে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে প্রথম মহিলা সাঁতার কোচ হিসেবে যোগদান করেন। তবে সেখানে সুইমিং কোচ হিসেবে চাকুরী মনঃপুত না হওয়ায় ২০০০ সালে সেই চাকুরী ছেড়ে দিয়ে একই বছর ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা (আইএসডি)তে ক্রীড়া শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। এরপর ২০০৬-২০১৩ পর্যন্ত আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুল ঢাকা (এআইএসডি)তে ক্রীড়া শিক্ষিকা হিসেবে চাকরী করেন। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে ওই স্কুলে ক্রীড়া শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। সেখানকার সকল শিক্ষক-শিক্ষিকাই বিদেশ থেকে হায়ার করা এবং আইবি(ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকোলরিয়েস্ট) শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ডিগ্রী দেয়া হয়ে থাকে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত কুর্মিটোলা গলফ ক্লাবে সাঁতার প্রশিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৩-২০১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে সাঁতারের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৯ সালে কাঠমন্ডু এস.এ গেমসে চাইনিজ কোচের সাথে সহকারী কোচ হিসেবে এবং ২০১৪ সালের গ্লাসগো কমনওয়েলথ গেমসে হেড কোচ ও ম্যানেজার হিসেবে বাংলাদেশ ন্যাশনাল টিমের দায়িত্বে ছিলেন।
লায়লা নূর ২০০০ সাল থেকে বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশনের কার্যকরী সদস্য হিসেবে এবং পরবর্তীতে সহ-সভাপতি ও ট্রেনিং ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে সাঁতারের উন্নয়নে কাজ করেন। বর্তমানে তিনি সাউথ এশিয়ান সুইমিং ফেডারেশনের সদস্য এবং এশিয়ান সুইমিং ফেডারেশনের (২০১৬-২০২০ সাল মেয়াদী কমিটির) সুইমিং টেকনিক্যাল কমিটির মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সাঁতারের জাজ/রেফারী হিসেবে দক্ষতা ও সুনামের সাথে খেলা পরিচালনা করে আসছেন। ২০১৬ সালে ভারতের আসামের গোহাটিতে অনুষ্ঠিত এস.এ গেমসে, ২০১৭ সালে উজবেকিস্তানে ৯ম এশিয়ান এজগ্রুপ সাঁতারে, ২০১৭ সালে তুর্কমেনিস্তানে এশিয়ান ইনডোর গেমসে এবং এশিয়ান শর্ট কোর্সে (সাঁতার) রেফারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৫ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত এস.এ গেমসে জুরি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একই বছর ইয়েমেনের সানায় এশিয়ান উইমেন্স স্পোর্টস কনফেডারেশনে মহিলা ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০০৯ সালে জাপানের কুসুমোতে ওয়ার্ল্ড উইমেন্স স্পোর্টস কনফেডারেশনে ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে সিংগাপুরে অনুষ্ঠিত ফার্স্ট ওয়ার্ল্ড সুইমিং কোচেস কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১২ সালে ভারতের চেন্নাইতে অনুষ্ঠিত সাউথ এশিয়ান আমেরিকান স্কুল (সাইসা) প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের আমেরিকান স্কুল দল চ্যাম্পিয়ন হয়, যার কোচ ছিলেন তিনি। ২০১৩ সালে শ্রীলংকার কলম্বোতে অনুষ্ঠিত সাইসার ট্র্যাকেন ফিল্ডে এআইএমডি চ্যাম্পিয়ন হয়, তিনি এর কোচ ছিলেন। ২০০৬ সালে ভারতের মুর্শিদাবাদে অনুষ্ঠিত বিশ্ব দূরপাল্লার সাঁতার প্রতিযোগিতায় কোচ কাম লাইফ সেভার হিসেবে যোগদান করেন।
সাঁতার জীবনের অর্জন ও অবদানের জন্য তিনি ২০০৪ সালে ক্রীড়া ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘জাতীয় ক্রীড়া পদক’ পান। জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এই পুরস্কার তার হাতে তুলে দেয়। এছাড়াও রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে ‘জেলা প্রশাসক পদক’ প্রদান করা হয়।
খেলোয়াড়, সংগঠক, কোচ হিসেবে এবং লেখাপড়া, প্রশিক্ষণ ও ভ্রমনে এ পর্যন্ত তিনি ৩০টিরও অধিক দেশে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে আমেরিকা, রাশিয়া, জার্মানী, ইংল্যান্ড, বেলজিয়াম, সিংগাপুর, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, তুরস্ক, দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইয়েমেন, কাতার, জাপান, থাইল্যান্ড অন্যতম।
ব্যক্তিগত জীবনে লায়লা নূর ১ পুত্র ও ১কন্যা সন্তানের জননী। ছেলে নোমান মুজিব নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে বিবিএ ৩য় বর্ষে অধ্যয়নরত এবং মেয়ে রাইসা মুজিব ও লেবেলের পরীক্ষার্থী। স্বামী মোঃ মজিবুর রহমান সরকারী শারীরিক শিক্ষা কলেজ, ঢাকার সিনিয়র লেকচারার। তিনি একজন ফুটবলার ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশ রাগবি ফেডারেশনের যুগ্ম-সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শ্বশুর বাড়ী গাজীপুর জেলা সদরে। তারাও ক্রীড়া পরিবার হিসেবে সুপরিচিত।
লায়লা নূর বেগম বলেন, বাবা/মা/ভাই/বোনদের একান্ত উৎসাহেই সাতারু হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পেরেছি। বর্তমানে ঢাকায় নিজের বুটিক ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত আছি। নারীদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি জিম(ফিটনেস সেন্টার) করার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছি। রাজবাড়ী একসময় ক্রীড়া ক্ষেত্রে অনেক ভালো করতো। ভলিবল, ফুটবল, সাঁতার, ব্যাডমিন্টনে চ্যাম্পিয়ন পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে খুব খারাপ অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাই এ অবস্থা থেকে উত্তরণে রাজবাড়ীর ক্রীড়াঙ্গনের জন্য কাজ করতে চাই। সুযোগ পেলে রাজবাড়ীর জন্য অবদান রাখতে চাই।