॥কাজী তানভীর মাহমুদ॥ পদ্মা নদীর তীরবর্তী জেলা রাজবাড়ী। এ জেলায় পদ্মা, হড়াই, চত্রা, চন্দনাসহ বিভিন্ন নদী অবস্থিত। এক সময় এই নদীগুলোর স্রোতে ভাসতো জেলার হাজারো খাল বিল। তবে কালের বিবর্তনে পদ্মা ছাড়া অন্য নদীগুলো স্থান পেয়েছে মানচিত্রের পাতায়।
রাজবাড়ী জেলার উত্তর দিকে প্রমত্তা পদ্মা নদী হাবাসপুর-সেনগ্রাম-ধাওয়াপাড়া ঘাট পর্যন্ত সরলভাবে প্রভাবিত হয়ে জেলা শহরের কিঞ্চিৎ পশ্চিম হতে উত্তরে বাঁক নিয়ে দৌলতদিয়া পর্যন্ত প্রবাহিত। দৌলতদিয়ার সামান্য উত্তরে আরিচার ভাটিতে পদ্মা যমুনার সাথে মিলিত হয়েছে। পদ্মার অপর পাড়ে পাবনা ও মানিকগঞ্জ জেলা। দক্ষিণে পদ্মার শাখা নদী গড়াই।
নদী ছাড়াও জেলার কয়েক হাজার পুকুর, জলাশয়, খাল ও বিলে একসময় দেশীয় নানা প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। যার মধ্যে অতি পরিচিত মাগুর, চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি আইড়, পাঙ্গাস, কৈ, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু দেশীয় মাছগুলো এখন আর তেমন দেখা যায় না। পাশাপাশি নদীর ফলি, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, রানি, পুতুল, টেংরা, পাবদা, পুঁটি, সরপুঁটি, চেলা, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, গোঙসা, রায়াক, রয়না, বাতাসি, বাজারি, বেলেসহ শতাধিক প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। কিন্তু কালের বিবর্তনে এসব মাছ আজ বিলুপ্তির পথে।
এসব মাছের মধ্যে কিছু প্রজাতির মাছ মাঝে মধ্যে পাওয়া গেলেও ‘মহাশোল’ মাছটির দেখাই মেলে না। মহাশোল মাছটি দেখতে বা চিনতে হলে ইন্টারনেটের সাহায্য নিতে হয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে মহাশোল মাছটি যেন নতুন এক নাম। অনেকে তো আবার মনে করেন যে, মহাশোল মাছ বোধ হয় বড় আকৃতির শোল মাছ। মহাশোল মাছটি দেখতে অনেকটা বড় আকৃতির লম্বা রুই বা মৃগেল মাছের মত। মাছটি খেতে অনেক সুস্বাদু বলে জানা যায়। সাধারনত নদীতে এই মাছ পাওয়া যেত।
মাছ চাষী, শিকারি, ব্যবসায়ী ও মৎস্য বিভাগের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজবাড়ী জেলার পদ্মা, হড়াই, চত্রা, চন্দনা নদী ও অসংখ্য খাল-বিলে একটা সময় প্রচুর পরিমাণে দেশীয় প্রজাতির বিভিন্ন ধরনের মাছ ধরা পড়তো। মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করতেন হাজারো মানুষ। জেলার বিভিন্ন হাট-বাজারে এসব মাছ বিক্রি হতো। কিন্তু নদী, খাল-বিলের পানি কমে যাওয়া, কৃষি ক্ষেতে ব্যবহৃত কীটনাশকের পানি, নদী দখল ও বাঁধ দেয়ার কারণে বিলুপ্ত হচ্ছে দেশীয় প্রজাতির মাছ।
রাজবাড়ী মাছ বাজারের মাছ ব্যবসায়ী হরিপদ হলদার জানান, আজ থেকে ২৫/৩০ বছর আগেও মহাশোল মাছটি পাওয়া যেত। মাছটি বেশ বড় আকারের হতো। এটি সাধারণত নদীতে জেলেদের জালে ধরা পড়তো। একেকটি মাছ এক থেকে ৪/৫ কেজি পর্যন্ত হতো। মাছটি খেতে অনেক সুস্বাদু। মহাশোল মাছ ছাড়াও নদীর ফলি, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসী, রানি, পুতুল, টেংরা, পাবদা, চেলা, মলা, গোঙসা, রায়াক, রয়না, বাতাসি, বাজারি মাছ বিলুপ্ত হয়েছে।
রাজবাড়ী শহরের গোদার বাজার পদ্মা নদীর ঘাট এলাকার মাছ শিকারী জোনাব আলী জানান, তার বয়স প্রায় ৭০ বছর। তিনি ছোটবেলা থেকেই নদীতে বড়শি ও জাল দিয়ে মাছ ধরেন। অনেক দিন ধরেই মহাশোল মাছটিকে আর দেখা যায় না।
গোয়ালন্দ উপজেলার দৌলতদিয়া ফেরী ঘাট এলাকার জেলে সুরেন সরকার জানান, নদীতে আর আগের মত মাছ জালে ধরা পড়ে না। নানা ধরনের ওষুধ ব্যবহারের কারণে নদী ও খাল বিলে দেশী মাছ কমে গেছে। পানি দূষণ ও সংরক্ষণের অভাবে অনেক ভালো ভালো সুস্বাদু মাছ হারিয়ে গেছে।
রাজবাড়ী শহরের বাসিন্দা হান্নান মিয়াজী জানান, এক সময় জেলার নদী ও খাল-বিলে প্রচুর পরিমাণে দেশী মাছ দেখা যেত। আমরা ছোটবেলায় যে মাছগুলো খেয়েছি তরুণ প্রজন্মের অনেকেই সেই সব মাছ চেনে না। ভবিষ্যতে তাদের কাছে এ সকল মাছের নাম গল্প-কাহিনী বলে মনে হবে।
রাজবাড়ী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাঃ মজিনুর রহমান জানান, বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশে দেশীয় মাছ কমে যাচ্ছে। রাজবাড়ী জেলার স্থানীয় অনেক মাছ এখন বিলুপ্তির পথে। দেশীয় মাছকে সংরক্ষণের লক্ষ্যে জেলার মাছ চাষীদেরকে নানান প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। মাছ চাষে সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করার জন্য চাষীদেরকে অনুরোধ করা হচ্ছে। জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে ৪টি উপজেলার নদীর কোলগুলোতে মাছের অভয়াশ্রম তৈরীর জন্য ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে। প্রকৃতপক্ষে দেশীয় প্রজাতির মাছগুলো সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে বড় হচ্ছে সচেতনতা।