সম্প্রতি আমাদের দেশের সংবাদপত্রে প্রতিদিন যেসব খুন, সন্ত্রাসী, মাদকাসক্তদের ঘটনাসহ সব অপরাধের খবর ছাপা হচ্ছে তার সব ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দেশের তরুণ যুবসমাজের একটি অংশ। কিন্তু সবচেয়ে মারাত্দক যে বিষয়টি জাতির জন্য উদ্বেগের এবং আমাদের সতর্ক হতে নির্দেশ দিচ্ছে তা হলো_ এদের অধিকাংশই আজ তরুণ। নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই দেশে যুবসমাজের মধ্যে মাদকাসক্তির পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সর্বনাশা মাদকের কারণে যুবসমাজ যে শুধু মেধাশূন্য হচ্ছে তাই নয়, এই মাদকাসক্তদের মধ্যে মনুষ্যত্বও লোপ পাচ্ছে। প্রশ্ন জাগে, যে মেয়েটিকে বাবা-মা জন্ম থেকে তিলে তিলে আদর ভালোবাসা দিয়ে মানুষ করে তুলেছেন সে কিভাবে তাদের বুকে ছুরি বসায়। হত্যা করতে দ্বিধা করে না বাবা-মাকে, কিংবা যে ছেলেটি আজ বাবা-মায়ের মাথার ঘাম পায়ে ফেলানোর কষ্টার্জিত অর্থ নিয়ে নামকরা একটি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসেছে সে কেন আজ মাদকাসক্ত? সন্তানকে তার বাবা-মা একমাত্র সম্বল সেই জমি বিক্রির টাকা দিয়ে একটি কারণে পড়তে পাঠান, ছেলেটা যেন পড়াশোনা শেষ করে মানুষের মতো মানুষ হয়। কিন্তু সে সব বাবা-মায়ের ছেলে-মেয়েদের এহেন কাণ্ডকীর্তি কি মানুষের পর্যায়ে পড়ে? পুলিশ প্রশাসনের মতে, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও খুনসহ রাজধানীতে সংঘটিত অধিকাংশ অপরাধের সঙ্গেই মাদকাসক্তির সম্পর্ক রয়েছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ধূমপায়ীদের মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই মাদকাসক্ত এবং তার মধ্যে শতকরা ৪৪ ভাগ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত। সিগারেট থেকে নেশা শুরু করলেও মাদকের প্রতি আসক্তি তাদের ধীরে ধীরে শুরু হয়। বেশিরভাগই শুরু হয় বন্ধুবান্ধবের সাহচর্যে। মূলত মাদক কেনার অর্থ জোগাড় করতে গিয়েই কিশোর-তরুণরা ব্যাপকভাবে নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। এ সুযোগে মাদক ব্যবসায়ী, সংঘবদ্ধ অপরাধীচক্র খুন, অপহরণ ও চাঁদাবাজিসহ নানা কাজে তাদের ব্যবহার করতে থাকে। মাদকের এই নেশার জালে একবার জড়িয়ে পড়লে কেউ আর সহজে এ জাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। ফলে মাদকসেবীরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।
আমাদের দেশে কিশোর সন্ত্রাসীর ক্রমবর্ধমান দাপটের যে তথ্য সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে তার মূল কারণ সম্ভবত নিহিত রয়েছে এখানেই। দেশের সর্বত্র স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের নানাভাবে উত্যক্ত করা, গুলি বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করা, কিংবা সড়ক দুর্ঘটনার আধিক্যের পেছনেও মাদকাসক্তির ভূমিকা অন্যতম। বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভৌগোলিক কারণে মাদক উৎপাদনকারী না হয়েও মাদকাসক্তির জন্য একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য যে খুব সহজেই যত্রতত্র পাওয়া যাচ্ছে তার নমুনা আমরা প্রতিদিন খবরের কাগজে পাই। ইয়াবা ‘দ্য কুইন’, নেশার জগতে দীর্ঘদিন যাবৎ রাজা হয়ে বসে আছে হেরোইন, বর্তমানে নতুন রানীর সন্ধান পাওয়া গেছে তার নাম দ্য কুইন। নেশার জগতে নতুন সংস্করণ ইয়াবা এখন বাজারে এসেছে ইয়াবা প্লাস নামে। তরুণ-তরুণীদের ভাষায় দ্য কুইন। কারণ হচ্ছে হেরোইন সাধারণত ছেলেরা সেবন করে, মেয়েদের মধ্যে হেরোইনসেবীর সংখ্যা নেই, কিন্তু ইয়াবার নেশায় মেয়েরা মোটেও পিছিয়ে নেই। ইয়াবা দিয়ে নেশার জগতে প্রবেশের পর ইয়াবা আসক্তরা এখন অন্যান্য নেশায়ও জড়িয়ে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের গুরুত্ব সহকারে এগুতে হবে। নতুবা সাম্প্রতিক ঘটনার মতো মাদকাসক্ত ছেলে বা মেয়ের হাতে বাবা-মাকে প্রাণ দিতে হবে যেমন পিংকি, সিমি, তৃষ্ণা, ফাহিমা, মহিমা আর ইলোরার মতো আরও অনেক মা-বোনকে আমাদের হারাতে হয়েছিল। এখনই সময় প্রতিরোধ ব্যবস্থার এবং কঠিন আইন প্রয়োগের।