॥বিকাশ চন্দ্র বসু॥ রাজবাড়ী জেলার অন্তর্গত পাংশা উপজেলা প্রতিভার সুতিকাগার। অনেক প্রতিভার প্রসূতি এই পাংশা উপজেলার মাগুড়াডাঙ্গী গ্রামে এয়াকুব আলী চৌধুরী নভেম্বর ১৮৮৮ (বাংলা ১৮ কার্তিক ১২৯৫) সালে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন পুলিশ অফিসার (দারোগা) এনায়েতুল্লাহ চৌধুরী। বড় দুই ভাই রওশন আলী চৌধুরী ও আওলাদ আলী চৌধুরী এবং একমাত্র বোন জান্নাতুন্নেসা খাতুন।
স্থানীয় মাগুড়াডাঙ্গী স্কুলেই তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি। পরে পাংশা এম.ই (মধ্য ইংরেজী) স্কুল থেকে পড়া শেষ করেন। এম.ই পাস করার পর এয়াকুব আলী চৌধুরী রাজবাড়ী সূর্যকুমার ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন এবং কৃতিত্বের সাথে এন্ট্রান্স(প্রবেশিকা) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। উচ্চ শিক্ষার জন্য কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। বিএ ক্লাসে অধ্যয়নকালে চোখের অসুখে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে পড়ায় চতুর্থ বছরে কলেজ ত্যাগ করেন। এ সময়ে তাঁর অগ্রজ মাসিক পত্রিকা ‘কোহিনূর’ (১৮৯৮-১৯০১-১৯০৪-১৯০৬-১৯১১-১৯১২ ও ১৯১৫) সম্পাদক রওশন আলী চৌধুরী রোগাক্রান্ত হলে তিনি ‘কোহিনূর’ পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন। ১৯১৪ সালে তিনি চট্রগ্রাম জেলাধীন সীতাকুন্ডু উপজেলার জোরওয়ারগঞ্জ উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয়ে শিক্ষকরূপে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯১৪ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত তিনি এখানে শিক্ষকতা করেন। এই জোরওয়ারগঞ্জে শিক্ষকতাকালে তিনি বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ডাঃ লুৎফর রহমানের সংস্পর্শে আসেন। এরপর তিনি রাজবাড়ী সূর্যকুমার ইনস্টিটিউশনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। সবশেষে তিনি পাংশা জর্জ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন। ১৯২০-১৯২১ সালে পাংশা জর্জ হাইস্কুলে শিক্ষকতা করার সময় অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে যোগদান করেন। রাজনৈতিক কারণে তিনি কারাবরণ করেন। কারামুক্তির পর ১৯২১ সালে শিক্ষকতার চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় গমন করেন এবং মধ্যম ভ্রাতা আওলাদ আলী চৌধুরীর সঙ্গে সাংবাদিকতায় যোগ দেন। একই পরিবারের তিনভাই সাংবাদিকতার মত মহান পেশায় যোগদান নিঃসন্দেহে একটি বিরল ঘটনা। ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’ (৪ সেপ্টেম্বর ১৯২১) প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। এ সমিতির সম্পাদক হিসেবেও কয়েক বছর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সমিতির মাসিক পত্রিকা ‘সাহিত্যিক’ (১৯২৬) এর যুগ্ম-সম্পাদক ছিলেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী ও কবি গোলাম মোস্তফার যুগ্ম-সম্পাদনায় পত্রিকাটি এক বছর চলেছিল (১৯২৬)। তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’, ‘কোহিনূর’ ও ‘সাহিত্যিক’ পত্রিকার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন।
এয়াকুব আলী চৌধুরী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে অত্যন্ত স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতেন এবং কাজী নজরুল ইসলামও এয়াকুব আলী চৌধুরীকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও সম্মান করতেন। কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৩৩ সালে পাংশায় এসেছিলেন। শ্রী শ্যামলাল কুন্ডুর দ্বিতল বাসভবনে কবির থাকার ব্যবস্থা করা হয় এবং এয়াকুব আলী চৌধুরীর বাসভবনে কবি নজরুল ইসলামের আপ্যায়ণের আয়োজন করা হয়।
রওশন আলী চৌধুরী ও আওলাদ আলী চৌধুরীর অকাল মৃত্যুতে তাঁদের পরিবারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চিরকুমার। সচ্চরিত্র, ন্যায়নিষ্ঠাবান এবং ধার্মিক হিসেবে তিনি সুপরিচিত ছিলেন। এয়াকুব আলী চৌধুরীর চারিত্রিক দৃঢ়তায় মুগ্ধ হয়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার ভূয়সী প্রশংসা করেন। তাঁর শেষ জীবন ছিল অত্যন্ত দুঃখময়। শোক, দুঃখ, দারিদ্রে নিপতিত হয়ে ৪৭/৪৮ বছর বয়সে ক্ষয়রোগে (যক্ষারোগ) আক্রান্ত হন। শেষ জীবনের ৪/৫ বছর জীবন্মৃত অবস্থায় মাগুড়াডাঙ্গী গ্রামের বাড়ীতে বাস করেন। মৃত্যুর দুই বছর পূর্বে বঙ্গীয় সরকার তার নামে মাসিক পঁচিশ টাকা হিসেবে একটি ‘সাহিত্যিক বৃত্তি’ মঞ্জুর করেন।
বিশ শতকের বাংলা গদ্যকারদের মধ্যে তাঁর স্থান ছিল অনেক উঁচুতে। তিনি ছিলেন বাংলা গদ্যের একজন শক্তিশালী শিল্পী। ইসলামী দর্শন ও সংস্কৃতি তাঁর রচনায় মূল উপজীব্য বিষয়। বক্তব্যের বলিষ্ঠতায়, ভাষার মাধুর্যে ও ভাবের গাম্ভীর্যে তাঁর রচনাবলি বিশেষ মর্যাদার দাবিদার।
বিশ শতকের প্রথম দিকে বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা না উর্দু হবে এই বিতর্কে তিনি বাংলাভাষার পক্ষাবলম্বন করেন। এয়াকুব আলী চৌধুরী হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি একজন সুবক্তা হিসেবে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ‘ধর্মের কাহিনী’ (১৯১৪), ‘নূরনবী’ (১৯১৮), ‘শান্তিধারা’ (১৯১৯) ও ‘মানব মুকুট’(১৯২২)।
এয়াকুব আলী চৌধুরীর লেখার ভাষা গাম্ভীর্যপূর্ণ, অপূর্ব এবং সুখপাঠ্য। এ বিষয়ে জাতীয় অধ্যাপক ডঃ আনিসুজ্জামান মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন,“ সাহিত্যিক হিসেবে এয়াকুব আলী চৌধুরীর বড় কৃতিত্ব ভাবাশ্রিত প্রবন্ধ রচনায়। ভাষার লালিত্য ও তেজস্বিতা এবং প্রকাশভঙ্গির ঋজুতা তার রচনাশৈলীর বৈশিষ্ট”। শিক্ষক, সাংবাদিক, সম্পাদক ও সুসাহিত্যিক এয়াকুব আলী চৌধুরী ১৯৪০ সালের ১৫ই ডিসেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। লেখক ঃ অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন কলেজ, পাংশা, রাজবাড়ী।