॥ সাদেকুর রহমান ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ‘সবার জন্য বাসস্থান’ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘জমি আছে ঘর নাই তার নিজ জমিতে গৃহ নির্মাণ’ ও আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের ২৫০টি ঘর পেয়ে খুশি ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুট ইউনিয়নের উপকারভোগীরা। গত এপ্রিলে এসব গৃহহীন মানুষকে ঘরের চাবি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
উপকারভোগী আমেনা বেগম আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, ‘সংসারে অভাবের কারণে নতুন একটি বাড়ী তৈরি করার কোন স্বপ্ন কখনো দেখতাম না। নতুন করে একটি সুন্দর ঘর পাওয়ায় দীর্ঘদিনের দুঃখ-কষ্ট লাঘব হয়েছে। এখন খেয়ে না খেয়ে থাকলেও মাথা গোঁজার মতো একটা জায়গা হয়েছে। শেখের বেটিকে যে আমরা কী বলে ধন্যবাদ দিব তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমরা দোয়া করি শেখের বেটিই যেন বারবার ক্ষমতায় আসে।’
সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি এলাকায় সুবিধাভোগীদের কাছে সুদৃশ্য এসব ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলাতে বরাদ্দ ৭৪৪টি ঘরের মধ্যে ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫২৮টি ঘর সুবিধাভাগী পরিবারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করা হয়েছে। কলেজপাড়ার হতদরিদ্র অজিত ফুটপাতে খোলা আকাশের নীচে বসে ছেঁড়া, কাটা জুতা, স্যান্ডেল মেরামত ও রং-পলিশের কাজ করে। বসতবাড়ীতে সামান্য কিছু জমি ও মাথা গোঁজার মতো ৮টি টিনের জীর্ণশীর্ণ একটিমাত্র কাঁচা মাটির ছাপড়া ঘর ছাড়া আর কিছুই ছিল না তার। সে কোনদিনও ভাবেনি পাকা ঘরে ঘুমাবে। কিন্তু ৭৪৪টি ঘরের মধ্যে অজিতও একটি ঘর পেয়েছে। ঘর পেয়ে সে মহাখুশি। ২০১৮-২০১৯ অর্থ বছরে চট্টগ্রামের ২৭৬টি পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এছাড়াও ৪হাজার ৪৪৮টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে।
‘বাংলাদেশে কোন গৃহহীন মানুষ থাকবে না’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন অঙ্গীকারে ২০১৯ সালের মধ্যে সবার জন্য বাসস্থান নিশ্চিতকরণ কর্মসূচীর আওতায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় হতে পরিচালিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ ১০টি উদ্যোগের মধ্যে অন্যতম আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প। এ অগ্রাধিকার প্রকল্প আমেনা বেগম-অজিতদের মতো হাজারও গৃহহীন মানুষের স্বপ্ন পূরণ করেছে। পাকা ঘর যাদের কাছে এতোদিন ছিল ‘সোনার হরিণ’, সরকারের কার্যকর উদ্যোগে সে ঘর এখন বাস্তব হচ্ছে। রোদ-বৃষ্টি আর শীত থেকে রেহাই পাওয়া তথা স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবন-যাপন নিশ্চিত করতে স্থায়ী ঘর দেওয়া হচ্ছে দুঃস্থ-অসহায় পরিবারগুলোকে।
‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’-এই শ্লোগানকে সামনে রেখে গৃহহীনদের বিনামূল্যে সাড়ে ১৬ ফুট দৈর্ঘ্য ও সাড়ে ১০ ফুট প্রস্থের এবং ৫ফুট চওড়া বারান্দাসহ একটি করে পাকা ঘর করে দেওয়া হচ্ছে সরকারীভাবে। ঘরটিতে ১টি দরজা ও ৬টি করে জানালা রয়েছে। ১৭টি আরসিসি খুঁটি দ্বারা খুব মজবুতভাবে তৈরি করা হচ্ছে ঘরগুলো। পাশাপাশি ঘরের সঙ্গে ১টি করে স্যানিটারি ল্যাট্রিনও নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। সরকারীভাবে প্রতিটি ঘর ও স্যানিটারী ল্যাট্রিন নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে এক লাখ টাকা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ দুর্যোগ প্রবণ দেশ হলেও দুর্গত মানুষের জন্য সরকারের আন্তরিকতার কোন অভাব নেই। গৃহহীন মানুষের কষ্টের বিষয়টি অনুধাবন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ১৯৯৭ সাল থেকে আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। সরকার গৃহহীন মানুষদের জন্য সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে। ‘একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না’ -প্রধানমন্ত্রীর এ অঙ্গীকারের আলোকে দেশের সব গৃহহীন মানুষকে বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
শহর বা পাহাড়ী এলাকায় খাসজমির স্বল্পতার উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক জানান, এসব এলাকায় ৫তলা দালান করা হবে। জরাজীর্ণ ঘরগুলো অচিরেই সংস্কার করা হবে। আর্থিক অবস্থার উন্নতির কারণে প্রকল্প এলাকা ছেড়ে যাওয়া উপকারভোগীর ঘর নতুন করে বরাদ্দ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে দিনাজপুরের চিলি বন্দর উপজেলার ১৯১টি পরিবারকে আধাপাকা টিনের বাড়ী তৈরি করে দেওয়ার বরাদ্দ দেওয়া হয়। গ্রামে গ্রামে সাজসাজ রব হতদরিদ্র ঘর পাওয়া মানুষের মাঝে। সুবিধাভোগী পুনট্রি ইউনিয়নের সরস্বতীপুর গ্রামের অনেকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মায়ের মতো কাজ করেছেন। নিজের মতো করে পরিবার নিয়ে ঘরে থাকবো-এর চেয়ে খুশি আর কী হতে পারে।’।
প্রকল্পের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৯৭ সালের ১৯শে মে কক্সবাজার জেলাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকা ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হওয়ায় বহু পরিবার গৃহহীন হয়ে পড়ে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দেখে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল হয়ে পড়েন এবং সকল গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। তারই পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ১৯৯৭ সালে ‘আশ্রয়ণ’ নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। সম্পূর্ণভাবে সরকারের অর্থায়নে ১৯৯৭ সাল থেকে এ পর্যন্ত তিনটি পর্যায়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প(১৯৯৭-২০০২), আশ্রয়ণ প্রকল্প পর্যায়-২ (২০০২ -২০১০), আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প(২০১০-২০১৯) এর অধীনে সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে মোট ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৮টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়। তার মধ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৫টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। বর্ণিত প্রকল্পের সাফল্য ও ধারাবাহিকতায় ২০১০-২০১৯ (সংশোধিত) মেয়াদে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে আড়াই লাখ ভূমিহীন, গৃহহীন, ছিন্নমূল পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
পুনর্বাসিত ভূমিহীন, গৃহহীন, দুর্দশাগ্রস্ত ও ছিন্নমূল পরিবারের স্বামী-স্ত্রীর যৌথ নামেই ভূমির মালিকানা স্বত্ত্বেও দলিল/কবুলিয়ত সম্পাদনসহ রেজিস্ট্রি এবং নামজারী করে দেওয়া হয়। পুনর্বাসিত পরিবারসমূহের জন্য সম্ভাব্য ক্ষেত্রে বহু পুকুর এবং গবাদি পশু পালনের জন্য সাধারণ জমির ব্যবস্থা, কমিউনিটি সেন্টার নির্মাণ, মসজিদ নির্মাণ ও কবরস্থানের ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি পুনর্বাসিত পরিবারের সদস্যদের জন্য বিভিন্ন উৎপাদনমুখী ও আয়বর্ধক কর্মকান্ডের জন্য ব্যবহারিক ও কারিগরি প্রশিক্ষণদানসহ প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মধ্যে ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, একই সময়ে প্রকল্প এলাকায় সর্বমোট ৮৬৪টি গ্রামে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছে এবং প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার গাছের চারা রোপণ করা হয়েছে। এইসব প্রকল্প এলাকায় পুনর্বাসিত জনগোষ্ঠী আয়বর্ধক কাজের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করছে। তাদের ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে নিজেদেরকে ভবিষ্যতের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলছে।
এই প্রকল্পের আওতায় সরকার ইতিমধ্যে ৬০১জন ভিক্ষুকসহ ১ লাখ ১৫ হাজার ৭৭৫টি গৃহহীন পরিবারকে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। ভিশন-২০২১ বাস্তবায়ন এবং ২০৩০ সাল নাগাদ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশে দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যে ভবিষ্যতে এই প্রকল্পকে আরো বেগবান করা হবে।
ইতিমধ্যে গাজীপুর জেলার বান্দরবাড়ী আশ্রয়ণ প্রকল্পে প্রায় ৭০ জন কুষ্ঠরোগীকে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীর জন্য দিনাজপুর সদর উপজেলায় একটি ‘হিজড়া পল্লী’ তৈরী করা হয়েছে।
আশ্রয়ণ প্রকল্প-২ এর আওতায় কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারকে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে ৮শত কোটি টাকা ব্যয়ে একটি আধুনিক নগরী গড়ে তোলা হচ্ছে। পাঁচতলা বিশিষ্ট ১৩৭টি ভবন এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নামে দশতলা বিশিষ্ট একটি উচ্চ টাওয়ার নির্মাণের কাজ চলছে। কক্সবাজার বিমান বন্দরের কাছে সমিতিপাড়া ও কুতুবদিয়া পাড়ার ৬৮০ একর খাস জমির ওপর এই প্রকল্প এলাকা গড়ে উঠছে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রকৌশল ডিভিশন ভবন নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। গত ১৫ই জুন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তা জানান, ইতিমধ্যে ২০টি ৫তলা বিশিষ্ট পাকা ভবন নির্মিত হচ্ছে। তার মধ্যে প্রথম দফার ১০টি ভবনের কাজ ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে এবং দ্বিতীয় পর্যায়ের ১০টি ভবনের কাজও প্রায় শেষ হওয়ার পথে।
বাংলাদেশ সেন্টার ফর এডভান্সড স্টাডিজ (বিসিএএস)-এর নির্বাহী পরিচালক বলেন, বাংলাদেশ জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন পরিবেশ উদ্যোগ, যেমন-ন্যাশনাল অ্যাডাপ্টেশন প্রোগ্রাম অব অ্যাকশন (নাপা), বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি এন্ড অ্যাকশন প্লান (বিসিসিএসএপ) গ্রহণ করার ক্ষেত্রে পথিকৃৎ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া পরিবারগুলোকে আশ্রয়দানের ক্ষেত্রে নেতৃত্বের পরিচয় দিয়েছে -পিআইডি ফিচার।