॥খোন্দকার আব্দুল মতিন, জাতিসংঘ সদর দপ্তর থেকে ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও শান্তিপূর্ণ সমাধানে জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের চুক্তির অবিলম্বে কার্যকরভাবে বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যেহেতু রোহিঙ্গা সমস্যার উদ্ভব হয়েছে মিয়ানমারে তাই, এর সমাধানও হতে হবে মিয়ানমারে।’
তিনি বলেন, ‘জাতিসংঘের সঙ্গে মিয়ানমারের যে চুক্তি হয়েছে আমরা তারও আশু বাস্তবায়ন ও কার্যকারিতা দেখতে চাই। আমরা দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ২৭শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩তম অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে একথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠিকে আশ্রয় প্রদান করেছে, যারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। বাংলাদেশ সাধ্যমত তাদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, নিরাপত্তা এবং শিশুদের যতেœর ব্যবস্থা করেছে।
তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার আমাদের প্রতিবেশী দেশ হওয়ায় প্রথম থেকেই আমরা তাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার-এর মধ্যে একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।’
‘তবে, মিয়ানমার মৌখিকভাবে সব সময়ই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে বলে অঙ্গীকার করলেও বাস্তবে তারা কোন কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে না,’ -বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী বিপুল সংখ্যক নিপীড়িত ও রোহিঙ্গার মত নিজ গৃহ থেকে বিতাড়িত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা আমার হৃদয়কে ব্যথিত করে। এ জাতীয় ঘটনাকে অগ্রাহ্য করে শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও টেকসই সমাজ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের দেশের মানুষের উপর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে গণহত্যা চালিয়েছিল মিয়ানমারের ঘটনা সে কথাই বার বার মনে করিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে ৯ মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানীরা ৩০ লাখ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করেছিল। ২ লাখ নারী পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন। এক কোটি মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন।
তিনি বলেন,‘ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের উপর গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের যে বিবরণ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাতে আমরা হতভম্ব।’
‘একজন মানুষ হিসেবে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশাকে আমরা যেমন অগ্রাহ্য করতে পারি না, তেমনি পারি না নিশ্চুপ থাকতে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের উপর ঘটে যাওয়া অত্যাচার ও অবিচারের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গারা যতদিন তাঁদের নিজ দেশে ফেরত যেতে না পারবেন, ততদিন সাময়িকভাবে তাঁরা যাতে মানসম্মত ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে বসবাস করতে পারেন, সে জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রেখে আমরা নতুন আবাসন নির্মাণের কাজ শুরু করেছি।
তিনি এক্ষেত্রে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ওআইসি-সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা যারা সহানুভুতি দেখিয়েছেন এবং সাহায্য ও সহযোগিতা করে চলেছেন তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানান এবং রোহিঙ্গাদের মানসম্মত পরিবেশে বসবাস নিশ্চিত করতে তাঁর সরকারের রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের উদ্যোগে সহযোগিতার জন্যও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার স্বপক্ষে তাঁর অবস্থান, নারীর ক্ষমতায়ন এবং জাতিসংঘ নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে তাঁর দৃঢ় সংকল্প তুলে ধরেন।
শেখ হাসিনা ফার্নান্দা এসপিনোসা গার্সেসকে ৪র্থ নারী হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৩ তম অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় অভিনন্দন জানান এবং জাতিসংঘের প্রতি তাঁর অঙ্গীকার সুরক্ষার যেকোন প্রচেষ্টায় অকুন্ঠ সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
তিনি একইসঙ্গে বিশ্বশান্তি, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সাহসী ও দৃঢ় নেতৃত্ব প্রদানের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেসকেও ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী ৭৩ তম সাধারণ অধিবেশনের প্রতিপাদ্য ‘মেকিং দ্যা ইউনাইটেড নেশন্স রিলেভেন্ট টু অল পিপল: গ্লোবাল লিডারশীপ এন্ড শেয়ারড রেসপন্সিবিলিটিজ ফর পিসফুল, ইক্যুইটেবল এন্ড সাসটেইনেবল সোসাইটিজ,’ উল্লেখ করে বলেন, সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের প্রতিপাদ্য আমাকে অতীতের কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতির পাতায় নিয়ে গেছে।
তিনি এ সময় ব্যক্তিগত স্মৃতি রোমন্থনে ৪৪ বছর আগে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তাঁর বাবা এবং বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলায় প্রদত্ত ভাষণটি স্মরণ করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন- ‘মানবজাতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য শান্তি একান্ত দরকার। এই শান্তির মধ্যে সারা বিশ্বের সকল নর-নারীর গভীর আশা-আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়ে রয়েছে। এই দুঃখদুর্দশা-সংঘাতপূর্ণ বিশ্বে জাতিসংঘ মানুষের ভবিষ্যৎ আশা-আকাঙ্খার কেন্দ্রস্থল।’
তিনি বলেন, স্বাধীনতা অর্জনের পর একটা যুদ্ধ বিধ্বস্ত, অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশকে গড়ে তোলার কাজে তিনি আত্মনিয়োগ করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের মানুষের জীবনে স্বস্তি ফিরে আসে। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা শুরু হয়।
‘কিন্তু, দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের জনগণের। মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকেরা তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। একইসঙ্গে তারা আমার মা, তিন ভাই এবং পরিবারের অন্য সদস্য সহ ১৮ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়,’ -বলেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, ভ্রাতৃপ্রতীম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন আজও অব্যাহত রয়েছে যা আমাদের মর্মাহত করে। এ সমস্যার আশু নিষ্পত্তি প্রয়োজন। ওআইসি-র পররাষ্ট্র মন্ত্রীদের কাউন্সিলের সভাপতি হিসেবে আমরা ওআইসি-র মাধ্যমে ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাব।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে তিনটি মৌলিক উপাদান বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকে, তা হল-শান্তি, মানবতা ও উন্নয়ন। তাই মানব সমাজের কল্যাণে আমাদের মানবতার পক্ষে সংগ্রাম অব্যাহত রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ‘জনগণকে সেবা প্রদান এবং তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। মানবতা ও সৌহার্দ্যই আমাদের টেকসই উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
‘সমস্যা-সঙ্কুল এই পৃথিবীতে আমাদের সম্মিলিত স্বার্থ, সমন্বিত দায়িত্ব ও অংশীদারিত্বই মানব সভ্যতাকে রক্ষা করতে পারে,’ – যোগ করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ৩০ বছরে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের অধীনে ৫৪টি মিশনে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১০ জন শান্তিরক্ষী প্রেরণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি রক্ষায় বিশেষ অবদান রেখেছে। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের ১৪৫ জন শান্তিরক্ষী জীবনদান করেছেন।
তিনি বলেন, বর্তমানে ১০টি মিশনে ১৪৪ জন নারীসহ বাংলাদেশের মোট ৭ হাজারেরও বেশি শান্তিরক্ষী নিযুক্ত রয়েছেন। আমাদের শান্তিরক্ষীগণ তাঁদের পেশাদারিত্ব, সাহস ও সাফল্যের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।
‘নিরাপদ, নিয়মিত ও নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসন বিষয়ক ‘গ্লোবাল কমপ্যক্ট’র মূল প্রবক্তা হিসেবে বাংলাদেশ আরও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এবং মানবাধিকার কেন্দ্রিক একটি কম্প্যাক্ট প্রত্যাশা করেছিল’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অভিবাসন বিষয়ক এই কম্প্যাক্ট অভিবাসীদের অধিকার রক্ষায় একটি ক্রমঃপরিবর্ধনশীল দলিল হিসেবে কাজ করবে বলে আমি বিশ্বাস করি।’
বাংলাদেশ সন্ত্রাসবাদসহ সকল সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভূখ-ে প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থবিরোধী কোন কার্যক্রম বা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড আমরা পরিচালিত হতে দিব না।
তিনি বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় আমাদের ‘জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে।’
সহিংস উগ্রবাদ, মানবপাচার ও মাদক প্রতিরোধে আমাদের সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করার নীতি বিশেষ সুফল বয়ে এনেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে গৃহীত ‘গ্লোবাল কল টু অ্যাকশন অন দ্যা ড্রাগ প্রবলেম’-এর সঙ্গে বাংলাদেশ একাত্মতা ঘোষণা করেছে বলেও তিনি জানান।
তাঁর সরকারের উন্নয়ন নীতিমালার সাফল্য তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘২০০৯ সাল থেকে আমরা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জনকল্যাণমুখী উন্নয়ন নীতিমালা বাস্তবায়ন করে চলেছি।’ তাঁর সরকারের সাড়ে ৯ বছরের শাসনে বাংলাদেশ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন করেছে, বলেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পথে আমরা জনগণের সকল প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট রয়েছি।’
তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক ২০১৫ সালে বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মোট দেশজ উৎপাদনের বিবেচনায় বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪৩তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের মাথাপিছু আয় ২০০৬ সালের ৫৪৩ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৮ সালে ১ হাজার ৭৫১ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার গত অর্থবছরে ছিল শতকরা ৭ দশমিক ৮৬ ভাগ। মূল্যস্ফীতি বর্তমানে ৫ দশমিক ৪ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। দারিদ্র্যের হার ২০০৬ সালের শতকরা ৪১ দশমিক ৫ ভাগ থেকে শতকরা ২১ দশমিক ৪ ভাগে হ্রাস পেয়েছে। একই সময়ে হত দরিদ্রের হার ২৪ শতাংশ থেকে ১১ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।
‘বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বৈশ্বিক মডেল হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যাত্রা শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের স্বল্পোন্নত দেশ হতে উত্তরণের এই যাত্রাপথ আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার পরিকল্পনার সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যা আমাদের সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তাঁর সরকার টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বাস্তবায়নে পুরোপুরি অঙ্গীকারাবদ্ধ।
তাঁর সরকার দেশে ১০০টি নতুন অর্থনৈতিক অঞ্চল সৃষ্টি করছে যা প্রায় এক কোটি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করবে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বর্তমান অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপক এবং অপরিসীম সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য কর রেয়াত, দ্বৈতকর পরিহার, শুল্কছাড়সহ বিভিন্ন আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের যৌথ উদ্যেগে ১১টি দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য হিসেবে তিনি বৈশ্বিক নেতৃবৃন্দের কাছে পানির যথাযথ মূল্যায়ন, ব্যবস্থাপনা এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকলের জন্য সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ এবং এ বিষয়ক টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৬ বাস্তবায়নে তাঁর সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ইতোমধ্যে, বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ স্যানিটেশন এবং ৮৮ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সুবিধা পাচ্ছেন।
তাঁর সরকারের দারিদ্র বিমোচনের অন্যতম পদক্ষেপ, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচির উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় ৬৫ লাখ বয়স্ক নারী-পুরুষ, বিধবা বা স্বামী পরিত্যাক্তা নারী এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তি নিয়মিত ভাতা পাচ্ছেন।
সরকার উদ্ভাবিত দারিদ্র বিমোচনের আর্থ-সামাজিক পদক্ষেপসমূহ বহুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ক্ষুদ্র সঞ্চয় ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। গৃহহীন নাগরিকমুক্ত বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে আশ্রয়ণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
তিনি উন্নয়নকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ায় তাঁর সরকারের পদক্ষেপ সমূহের উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে শহরের সুবিধাসমূহ পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি।’
মাত্র একশ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখন্ডে ১৬ কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা বিভিন্ন সামাজিক সূচকে প্রভূত অগ্রগতি অর্জন করেছি। মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি এক লাখে ১৭০ এবং পাঁচ বছর বয়সের নীচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৮-এ হ্রাস পেয়েছে। মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। ৩০ প্রকারের ঔষুধ বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে।
২০১০ সাল থেকে প্রাক-প্রাথমিক হতে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হচ্ছে উল্লেখ করে শিক্ষার প্রসারে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপসমূহ তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চলতি বছর ৪ কোটি ৪২ লাখ ৪ হাজার ১৯৭ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৩৫ কোটি ৪২ লাখ ৯০ হাজার ১৬২টি বই বিতরণ করা হয়েছে। দৃষ্টিহীনদের জন্য ব্রেইল পদ্ধতির বই এবং ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের মাতৃভাষার বই দেওয়া হচ্ছে।
তিনি বলেন, প্রাথমিক হতে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত প্রায় ২ কোটি ৩ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। ১ কোটি ৪০ লাখ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর মায়েদের কাছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে বৃত্তির টাকা পৌঁছে যাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত হয়েছে। শিক্ষার হার গত সাড়ে ৯ বছরে ৪৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭২র দশমিক ৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক হল নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ। নারী শিক্ষার উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জনের মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন আমরা নিশ্চিত করেছি।
তিনি বলেন, সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মেয়েদের দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বিনাবেতনে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ে মেয়ে ও ছেলে শিক্ষার্থীর অনুপাত ৫৩:৪৭। ২০০৯ সালের শুরুতে যা ছিল ৩৫:৬৫।
বাংলাদেশের কৃষি, সেবা ও শিল্পখাতে প্রায় ২ কোটি নারী কর্মব্রত রয়েছেন উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সর্ববৃহৎ উৎস তৈরি পোশাক খাতে প্রায় ৪৫ লাখ কর্মীর ৮০ শতাংশই নারী। নারী উদ্যোক্তাদের জামানত ছাড়াই ৫ শতাংশ সার্ভিস চার্জে ব্যাংক ঋণের সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা তহবিলের ১০ শতাংশ এবং শিল্প প্লটের ১০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, তৃণমূল পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য প্রতিটি স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে ৩৩ শতাংশ আসন নারীর জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের সংসদই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র সংসদ যেখানে সংসদ নেতা, সংসদ উপনেতা, স্পিকার এবং বিরোধী দলীয় নেতা নারী। বর্তমান সংসদে ৭২ জন নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য রয়েছেন।
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বাধিক ঝুঁকির সম্মুখীন পৃথিবীর প্রথম দশটি দেশের একটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ। জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে আমরা আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের এক শতাংশ ব্যয় করছি এবং জলবায়ু সহায়ক কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করছি।’
তিনি বলেন, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ এবং ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য-সুন্দরবন সংরক্ষণে ৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে বাংলাদেশ সরকারের একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে।
তাঁর সরকার উন্নয়ন কার্যক্রম এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সক্ষমতা সৃষ্টিতে গৃহীত পদক্ষেপসমূহকে একীভূত করে বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ শীর্ষক মেগা প্রকল্প গ্রহণ করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০ একটি জলকেন্দ্রিক, বহুমুখী এবং টেকনো-ইকনমিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।’
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশই পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা দীর্ঘ ৮২ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
তিনি বলেন, অটিজম ও জন্মগত স্নায়ুরোগে আক্রান্ত শিশুদের বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। এ বিষয়ে কার্যক্রমকে জোরদার করতে এ সংক্রান্ত একটি সেল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে উল্লেখ করে বলেন, এছাড়া অটিজম বিষয়ক জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটি এবং জাতীয় অ্যাডভাইজরি কমিটি গঠন করা হয়েছে।
এই কমিটির সভাপতি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অ্যাডভাইজরি প্যানেলের সদস্য সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এ সংক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ এশিয়ার শুভেচ্ছা দূত হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, যোগ করেন তিনি।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ধারণার মূল দর্শন জনকল্যাণ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের মহাসচিব কর্তৃক ‘হাই লেভেল প্যানেল অন ডিজিটাল কো-অপারেশন’ প্রতিষ্ঠাকে স্বাগত জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে আমরা মহাকাশ প্রযুক্তির জগতে প্রবেশ করেছি। বস্তুত এটি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্ন।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন প্রথমবারের মত বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ভূকেন্দ্র স্থাপন করার মাধ্যমে তিনি যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের মধ্য দিয়ে তা বাস্তবায়িত হয়েছে।