॥মাতৃকণ্ঠ ডেস্ক॥ বিশ্বকাপ বা ক্রিকেটের যেকোন আসরে সবচেয়ে মর্যাদাকর লড়াই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। আর সেই যুদ্ধে আজ ১৫ই জুন মুখোমুখি হচ্ছে বিশ্ব ক্রিকেটের এই দুই চির প্রতিন্দ্বন্দি। দ্বাদশ বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ২২তম ম্যাচ এটি। অনেক দিন যাবতই এই ম্যাচ নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিশেষ করে গেল ১৪ ফেব্রুয়ারি জম্মু-কাশ্মীরের রাজধানী শ্রীনগর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরের জেলা পুলওয়ামাতে জঙ্গি হামলায় ভারতের ৪০ জন জওয়ানের মৃত্যু ঘটে। এতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতি। এরপর ভারতে অনেকেই আসন্ন বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ না খেলতে দলের প্রতি আহবান জানান। আবার অনেকে মনে করেন, শুধু-শুধু পাকিস্তানকে ছেড়ে দেয়ার কোন কারনই নেই। মাঠের যুদ্ধে চির প্রতিন্দ্বন্দিদের হারের লজ্জা দিতে হবে। এ সব কারণে উভয় দেশেগত কয়েক মাসের উত্তেজনায় এবারের ভারত-পাকিস্তান লড়াই হয়ে উঠেছে অনেক বেশি মর্যাদাকর। সেই মর্যাদাকর লড়াইয়ে কে জিতে সেটিই কাল নির্ধারন হবে ম্যানচেষ্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে। ম্যাচটি শুরু হবে বাংলাদেশ সময় দুপুর সাড়ে ৩টায়।
এমনিতেই ভারত-পাকিস্তানের রাজনীতি সব সময়ই উত্তেজনাকর থাকে। তারমধ্যে আবার ঘি ঢেলে দিলে কি হতে পারে, তা অবশ্য সবারই জানা। দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে পুলওয়ামাতে জঙ্গি হামলা সম্পর্ককে আরো বিদ্বেশী করে তোলে। যার প্রভাব শান্তির লড়াই ক্রিকেটে গিয়ে পড়ে। পাকিস্তানের সম্পর্ক না রাখার দাবীর পক্ষ্যেও উত্তপ্ত হয়ে উঠে পুরো ভারত। এমনকি খেলাধুলায়ও কোন সম্পর্ক না রাখার দাবীও ওঠে দুই দেশের তরফ থেকেই।। অবশ্য দেখা সাক্ষাৎ হয় কেবল ক্রিকেট মাঠেই। কোন টুর্নামেন্ট হলেই ২২ গজে মুখোমুখি হতে হয় ক্রিকেটের দুই চির প্রতিন্দ্বন্দিকে। ২০১২ সালের পর নিজেরা কোন দ্বিপক্ষীয় সিরিজেও মুখোমুখি হয় না। এর আগে ২০০৭ সালে সর্বশেষ হয়ে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলেছিলো দু’দল। দু’টি সিরিজই ছিলো ভারতের মাটিতে। আর ভারত সর্বশেষ পাকিস্তান সফর করেছিলো ২০০৬ সালে। তাই এই চিত্রই বলে দিচ্ছে কি অবস্থায় রয়েছে ভারত-পাকিস্তানের সর্ম্পক। সেই সর্ম্পক এখন আরও বেশি গরম পুলওয়ামার ঘটনায়। তারপরও শেষ পর্যন্ত ২২ গজে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে ভারত-পাকিস্তান।
২২ গজের লড়াইয়ে নামলে অতীতের কোন ঘটনাই মাথায় থাকে না ক্রিকেটারদের। তবে মনের মধ্যে বিদ্বেষ যে থাকবে না, তা কিন্তু নয়। সেই বিদ্বেষ থেকেই এবার ম্যাচ জয়ের সর্বাত্মক চেষ্টা করবে উভয় দলই। আর বিশ্বকাপের মত মঞ্চে জয় ছাড়া অন্য কিছু ভাবারই উপায় নেই কোন দলেরই। তাই তো পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচকে অন্য লড়াইয়ের চেয়ে বেশ আলাদা ভাবছেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। পাকিস্তানের বিপক্ষে খেলতে নামলেই সেরাটা বের হয়ে আসে বলে জানালেন টিম ইন্ডিয়ার অধিনায়ক, ‘পাকিস্তানের ম্যাচ আমাদের মধ্যে থেকে সেরাটা বের করে আনে। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ বহু বছর ধরে দারুণ প্রতিদ্বন্দিতামূলক হয়ে আসছে। বিশ্ব জুড়ে এই লড়াই নিয়ে আগ্রহ থাকে অনেক বেশি। এই রকম ম্যাচে খেলার সুযোগ পাওয়াটা একটা সম্মানের ব্যাপার। এই ম্যাচ আমাদের সবার ভিতরের সেরাটা বের করে আনে।’
বিশ্বকাপের সূচি হবার পর থেকে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দিকে চোখ ক্রিকেটপ্রেমিদের। তাই আইসিসি অনলাইনে টিকিট ছাড়ার দু’দিনের মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায় । এই ম্যাচকে সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টিভিতে শুরু হয়ে গেছে বিজ্ঞাপন যুদ্ধ। তবে এসব উত্তেজনার আঁচ নিতে চান না ভারতের অধিনায়ক কোহলি। মানসিকভাবে নিজেদের প্রস্তুত করে মাঠের খেলায় মনোযোগি হতে মরিয়া ভারত দলপতি, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, মিডিয়া বা অন্য কোথাও কি হলো এসবের দিকে আমি তাকাই না, এসব নিয়ে ভাবিওনা। মানসিকভাবে এই ম্যাচের জন্য আমরা যে তৈরি, সেটা জানি। এখন কাজটা হবে, মাঠে নেমে পরিকল্পনাগুলো ঠিক মতো কাজে লাগানো।’
পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে শতভাগ নির্ভার থাকতে পারছেন না ভারত অধিনায়ক কোহলি। কারন তার দলের অন্যতম সেরা অস্ত্র ওপেনার শিখর ধাওয়ানকে ছাড়াই খেলতে হবে ভারতকে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সেঞ্চুরির ইনিংস খেলার পথে হাতে চোট পান ধাওয়ান। এই বাঁ-হাতি ওপেনারকে না পাওয়াটা কোহলির জন্য ধাক্কাই বটে। ধাওয়ানের ইনজুরি নিয়ে কোহলি বলেন, ‘দু’সপ্তাহ হাতে প্লাস্টার করা থাকবে ধাওয়ানের। প্লাস্টার খোলার পরই বুঝা যাবে হাতের কি অবস্থা। আশা করব, বিশ্বকাপের পরের দিকে, সেমিফাইনাল পর্ব থেকে সুস্থ হয়ে উঠবে সে। শিখর সুস্থ হয়ে খেলার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। আমরা তাকে দলের সঙ্গে রেখে দিতে চাই।’
ভারতের মত পাকিস্তানও ম্যানচেষ্টারের ম্যাচ নিয়ে খুব বেশি অস্থির। এটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। অতীত থেকে যা হয়ে আসছে, বর্তমানেও তেমনটাই হচ্ছে। তবে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে নামার আগে নিজেদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন পাকিস্তানের অধিনায়ক সরফরাজ আহমেদ। আগের ম্যাচে ফিল্ডিং-এর ভুলে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ম্যাচ হারে পাকিস্তান। ভারতের বিপক্ষে ভুল না করার ব্যাপারে বেশ সর্তক পাকিস্তানের দলপতি সরফরাজ, ‘আগের ম্যাচে প্রচুর ভুল করেছি আমরা। সবচেয়ে বেশি ভুল ছিলো আমাদের ফিল্ডিংয়ে। অনেক মিস সাথে ক্যাচ ড্রপ। দেখে মনেই হচ্ছিল না আমরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলছি। তাও বিশ্বকাপে। ভারতের বিপক্ষে খেলতে নামার আগে ফিল্ডিংয়ে আমাদের আরও উন্নতি করা প্রয়োজন।’
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ থেকে মাত্র একটি অর্জনই ছিলো পাকিস্তানের। আর তা’হল, পেসার মোহাম্মদ আমিরের দুর্দান্ত বোলিং। ১০ ওভারে মাত্র ৩০ রান দিয়ে ৫ উইকেট শিকার করেছেন এই পেসার। এছাড়া দলের আর কোন খেলোয়াড়ই পারফরমেন্সে ছিটেফটাও দেখাতে পারেননি। তাই ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে আমিরের বোলিং নৈপুন্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিতে পারছেন সরফরাজ, ‘ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে বল হাতে দুর্দান্ত পারফরমেন্স করেছে আমির। ৩০ রানে ৫ উইকেট প্রশংসা করার মত। বল সুইং করতে শুরু করলে তার থেকে ভয়ংকর বোলার খুব কমই রয়েছে। তার উপর চাপ সৃষ্টি করা অনেক কঠিন। উইকেট থেকে সাহায্য পেতে শুরু করলে আমিরকে খেলাই কঠিন। আশা করবো ভারতের বিপক্ষে আমির ভালো কিছু করবে।’
শুক্রবার সকালে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের ভেন্যুতে অনুশীলন করে পাকিস্তান দল। তবে মাঠে নেমেই পিচের দিকে ছুটে যান পাকিস্তানের অধিনায়ক সরফরাজ, কোচ মিকি আর্থার ও প্রধান নির্বাচক ইনজামাম উল হক। পিচের সামনে দাড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ শলাপরামর্শ করেন তারা। হয়তো তখনই ম্যাচের ছক কষে ফেলেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের হর্তাকর্তারা। কিন্তু তখনও খেলার ভেন্যুতে পৌঁছাতে পারেনি ভারত দল। আজ গা গরমের জন্য অনুশীলনে নামবেন কোহলি বাহিনী।
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ নিয়ে উত্তেজনায় আছেন দু’দলের সাবেক খেলোয়াড়রাও। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়ক কপিল দেব পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে নিজ দেশকেই এগিয়ে রাখছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের সময়ে পাকিস্তান দলটি ছিলো অনেক বেশি ভালো ও শক্তিশালী। আজকের এই পাকিস্তান দল সম্পর্কে বলতে পারি, দশবার ম্যাচ হলে ভারত সাতবার জিতবে। বর্তমানে পাকিস্তানের চেয়ে ভারত অবশ্যই অনেক ভাল দল। তবে ম্যাচের দিন যারা ভালো খেলবে তারাই জিতবে।’
পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক শহিদ আফ্রিদিও নিজ দেশের জয়ের ব্যাপারে আশাবাদি। তবে দলের ফিল্ডিং নিয়ে বেশ চিন্তিত তিনি। বর্তমান অধিনায়ক সরফরাজের সুরে আফ্রিদি বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে খুবই বাজে ফিল্ডিং করেছে পাকিস্তান। ফিল্ডিং খারাপ হলে ম্যাচে লড়াই করা কঠিন হয়ে যায়। তবে আশা করছি, ভারতের বিপক্ষে নিজেদের শতভাগ প্রস্তুত করেই মাঠে নামবে পাকিস্তান। ফিল্ডিং-এ অন্য এক পাকিস্তানকে দেখবো বলে আশা করি।’
তবে ম্যাচ নিয়ে যেভাবেই পরিকল্পনা করুক ভারত-পাকিস্তান, আর মাঠের বাইরে নিজেদের ঢঙ্গে যেভাবেই উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলুক ক্রিকেটপ্রেমিরা তাতে কিন্তু সব আয়োজনকে ভেস্তে দিতে পারে বেরসিক বৃষ্টি। ম্যানচেষ্টারে ম্যাচের দিন বৃষ্টির প্রবল সম্ভাবনা আছে। আবহাওয়া পূর্বাভাস তেমনই বলছে। তবে বৃষ্টির এই লীলা-খেলা নিয়ে এখনই ভাবছে না দু’দল। নিজেদের প্রস্তুতিতেই সবচেয়ে বেশি নজর তাদের। তাই দেখা যাক, আগামীকালের ম্যাচে কার জয় হয়- ভারত, পাকিস্তান নাকি বৃষ্টির।
ভারত দল : বিরাট কোহলি (অধিনায়ক), রোহিত শর্মা (সহ-অধিনায়ক), জসপ্রিত বুমরাহ, যুজবেন্দ্রা চাহাল, শিখর ধাওয়ান, মহেন্দ্র সিং ধোনি (উইকেটরক্ষক), রবীন্দ্র জাদেজা, কেদার যাদব, দিনেশ কার্তিক, কুলদীপ যাদব, ভুবেনশ্বর কুমার, মোহাম্মদ সামি, হার্ডিক পান্ডিয়া, লোকেশ রাহুল ও বিজয় শঙ্কর।
পাকিস্তান দল : সরফরাজ আহমেদ (অধিনায়ক), আসিফ আলি, বাবর আজম, ফখর জামান, হারিস সোহেল, হাসান আলী, ইমাদ ওয়াসিম, ইমাম উল হক, মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ হাফিজ, মোহাম্মদ হাসনাইন, শাদাব খান, শাহিন আফ্রিদি, শোয়েব মালিক ও ওয়াহাব রিয়াজ।