॥মোঃ শওকত আলী, জেলা প্রশাসক রাজবাড়ী॥ পদ্মা, হড়াই, গড়াই, চন্দনা, কুমার আর চত্রা পলিবাহিত সমতল ভূমি রাজবাড়ীর মানুষ কোমল আর কঠিনে গড়া বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতই উদ্দাম উত্তাল গ্রামীণ জীবনের সংস্কৃতির ধারায় লালিত পালিত। পদ¥া বিধৌত সমতল মাটির মানুষ অগ্রহায়ণের নবান্ন উৎসবে যেমন মেতেছে তেমনি আষাঢ়ের ঘন বর্ষায় প্লাবনের ধারায় উচ্ছ্বসিত হয়েছে। চৈত্রের খরা আর বৈশাখের ঝড় ঝঞ্ঝার দিনে শিরদাড়া খাড়া করে প্রতিকূল পরিবেশকে মোকাবেলা করেছে। জীবন প্রবাহের ধারায় মেতেছে আনন্দ উৎসবে। খেলায়-মেলায় সৃষ্টি করেছে নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব ইতিহাস। তেমনি ক্রীড়াঙ্গনেও রয়েছে রাজবাড়ী জেলার সমৃদ্ধ ইতিহাস।
দৌড়, লম্ফ, রথটানা, ঘোড়া দৌড়, ষাঁড়ের লড়াই, লাঠি খেলা, নৌকাবাইচ, তাস, পাশা, সাঁতার, হাডুডু, দাঁড়িয়াবাধা, ভলিবল, টেনিস ও ফুটবল এ অঞ্চলের মানুষের প্রিয় খেলা। এক সময়ে এ সব ক্রীড়ার মহরত জমে উঠত বিভিন্ন গ্রামীণ মেলা ও পার্বণকে উপলক্ষ্য করে। লক্ষ্মীকোল মেলা, পাঁচুরিয়া মেলা, খানগঞ্জ মেলা, বেলগাছি রথমেলা, মদাপুর মেলা, কালুখালী মেলা, বালিয়াকান্দি হরিঠাকুরের মেলা, ভীমনগর মেলা, বেরুলী মেলা, পাংশা মেলা, যশাই মেলা, গোয়ালন্দ মেলা সে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে।
রাজবাড়ী জেলার ইতিহাস ও প্রবীণদের নিকট হতে জানা যায়, ১৮৭১ সালে রাজবাড়ীতে রেল স্থাপনের পর থেকে রাজবাড়ীর ক্রীড়া জগতে ফুটবল খেলা এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। সে সময়ে বালিয়াকান্দির তৎকালীন ফুটবল তারকা শিব দাস এবং বিজয় দাস মোহনবাগান ফুটবল টীম গঠন করেন। আর মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অন্যতম সংগঠক ছিলেন বালিয়াকান্দি উপজেলার পদমদীর তৎকালীন জমিদার মীর মোহাম্মদ আলী। খানখানাপুরের জোতদার রাম কানাই কুন্ডুর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৩৫ সালে শুরু হয় রাম কানাই শিল্ড ফুটবল টুর্নামেন্ট। এই শিল্ড আইএফএ শিল্ড এর সমান হওয়ায় তা কেটে ২ ইঞ্চি কমানো হয়েছিল বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বেলগাছিতে আলিমুজ্জামান শিল্ড ফুটবল খেলা এক সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। খানখানাপুর রাম কানাই শিল্ড ফুটবল টুর্নামেন্ট ও বেলগাছি আলিমুজ্জামান শিল্ড ফুটবল টুর্নামেন্ট এর খেলায় সে সময়ে কলকাতার নামিদামি ক্লাব অংশগ্রহণ করত। ফুটবলের জাদুকর বলে পরিচিত সামাদ ১৯৩৬ সালে রেলওয়ে ফুটবল মাঠে মোহামেডানের পক্ষে খেলতে এসেছিলেন। তখনকার তারকা ফুটবলার জগদীশ গুপ্ত, অমিয় গুহ, বাদনদাস গুহরায়, নুর হোসেন (সোনাদা)সহ আরও অনেকে ফুটবল খেলায় মাতিয়েছেন। রাজবাড়ীর ফুটবলার নুর হোসেন (সোনাদা) ফুটবল খেলায় ৪-৪-২ পদ্ধতির প্রবর্তন করে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। পরবর্তীতে রাজবাড়ীর কৃতি ফুটবলার হিসেবে ডিএমএন ইসলাম, কে এম রহমান, রোস্তম আলী, অমল চক্রবর্তী, শৈলেন রায়, কাদের নেওয়াজ, এনামুল কবির, আব্দুস সামাদ, প্রফেসর এহিয়া ইসলাম, আব্দুর রাজ্জাক, নিরোদ ভাজন, সমর দাস, কাজী হেদায়েত হোসেন, হাবিবুর রহমান প্রমুখ ফুটবল খেলায় তাঁদের কৃতিত্বের পরিচয় দিয়ে রাজবাড়ীবাসীর হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ডিএমএন ইসলাম ও কে এম রহমান কলকাতা লীগের বেঙ্গল রেলওয়ে দলেও খেলেছেন। রাজবাড়ীতে খেলোয়াড় তৈরির ক্ষেত্রে কালেক্টরেট ক্লাব, রেলওয়ে ক্লাব, মার্চেন্ট ক্লাব, রাজবাড়ী কলেজ এবং এম ও ক্লাব উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা পূর্ব ও উত্তর এ সকল ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় রাজবাড়ীতে ফুটবল খেলা জমজমাট ছিল। পরবর্তীতে তৎকালীন আশির দশকে অনুর্ধ-১৪ খেলোয়াড়দের নিয়ে রাজবাড়ী শহরের কাজীকান্দায় আনসার ক্যাম্প ময়দান, রেলওয়ে মাঠ এবং স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত কাজী হেদায়েত হোসেন মেমোরিয়াল শিল্ড ফুটবল খেলা ব্যাপক জনপ্রিয় হয়।
ফুটবলে রাজবাড়ীর কৃতি সন্তানদের অবদানের কথা বলে শেষ করা সম্ভব নয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ফুটবল রাজবাড়ীর বিভিন্ন অঞ্চলে অতি জনপ্রিয় ও গুরত্বপূর্ণ খেলায় রূপ নেয়। সে সময়ে রাজবাড়ী রেলওয়ে মাঠকে কেন্দ্র করে খানখানাপুর, বেলগাছি, বসন্তপুর, কালেক্টরেট ক্লাব, রেলওয়ে ক্লাব, মার্চেন্ট এসোসিয়েশন, স্কুল ও কলেজ টীম গড়ে ঊঠে। সে সময়ে রবিউল আলম, এনায়েতুর রহমান, কালীপদ, অমূল্য চক্রবর্তী, নিখিল নাগ, রোকন চৌধুরী, রঞ্জু চৌধুরী, মঞ্জুর মোর্শেদ বাদশা, গোলাম মওলা, আব্দুল মান্নাফ মোহন, মোয়াজ্জেম হোসেন, গনেশ দাশ, নিমাই, এনামুল কবির বাদল, এডঃ কবির আহমেদ, আঃ সামাদ, আঃ রাজ্জাক, শহীদুন্নবী আলম প্রমুখসহ আরো অনেকে তাদের ক্রীড়া নৈপূন্যে ফুটবল মাঠকে সরগরম করে রাখতেন বলে আমি এলাকাবাসীর কাছে শুনেছি। রাজবাড়ী জেলা ক্রীড়া সংস্থার সভাপতি হিসেবে আমি বর্তমানে যে সকল কৃতি ফুটবলারদের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি এবং যাদের কথা শুনেছি, তাদের নাম না বললে তাদের ছোট করা হবে, তারা হলেন- মঞ্জুরুল আলম দুলাল, শাজাহান, জলিল, কুটি, কাজী মতিন, নিমাই ঘোষ, দীপক, কালি দাস, অখিল রাধাকান্ত, মালেক, বাদল, শ্যামল, হোসেন, রঞ্জু, গৌর, লিয়াকত আলী, মোঃ সফিকুল ইসলাম সফি, শহীদুল ইসলাম শহীদসহ আরো অনেকে।
ফুটবলের ধারাবাহিক ঐতিহ্যকে রাজবাড়ী জেলায় স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৮৭ সালে রাজবাড়ীর ২য় জেলা প্রশাসক মোঃ নাজমুল আহসান জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট প্রবর্তন করেন। জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট প্রবর্তন করে সম্মানিত জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ নাজমুল আহসান রাজবাড়ীবাসীকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন। জেলা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় নিয়মিত জেলা প্রশাসক গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট (পুরুষ ও মহিলা), জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের উদ্যোগে প্রতিবছর বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব প্রাথমিক বিদ্যালয় গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট, জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থানায় আন্তঃ উপজেলা ফুটবল টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
রাজবাড়ী জেলার ভলিবল দলের সুনাম সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। অতীতের উল্লেখযোাগ্য ভলিবল খেলোয়াড়দের মধ্যে মিলু, জুলফিকার, মোয়াজ্জেম, নিমাই, শাহজাহান, দুলাল, পিকু, তোজাম্মেল, রোকন, সিয়াদত আলী টগর, কুদ্দুস, পাপিন, রনজিত, হায়দার, রনি, গনি, জাফর, আলম উল্লেখযোাগ্য। যুব ভলিবলে রাজবাড়ী জেলা ১৯৮৬ সাল থেকে জাতীয় পর্যায়ে ৮(আট) বার চাম্পিয়ান এবং ৭(সাত) বার রানার্স আপ হয়। রাজবাড়ীর মহিলা ভলিবল দল ৯০ এর দশকে এবং তার পরবর্তীতে বার বার জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে এবং রাজবাড়ীর মহিলা ভলিবল দলের খেলোয়াড়েরা জাতীয় দলের পক্ষ হয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। এদের মধ্যে নিবেদিতা দাস, ডলি আক্তার, নিস্কৃতি, মিতা, রূপা, পুতুল ঘোষ, আলেয়া, শুভ্রা, ছালমা, ফারহানা, ইভা, সোহেলী প্রমুখ জাতীয় দলের খেলোয়াড় ছিলেন। বর্তমানে নিয়মিতভাবে জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থানায় আন্তঃ উপজেলা ভলিবল টুর্নামেন্ট ও প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে রাজবাড়ীতে ক্রিকেট খেলাও জমজমাট হয়ে আছে। এক সময়ের উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় ছিলেন বাদশা, কবির, বাবলু, জকি, নিজাম মন্টু, আজাদ কুটি, মঞ্জু কমল, তসলিম আহমেদ(তপন), অমরেন্দ্র মজুমদার(বিষু), ইমানুল করিম(জকি), আব্দুল গাফফার হাজী, পরাগ, এনামুল, ইমরুল, সানী, মিলন, রিপন, সুজন,সাদী, তারেক আজিজ প্রমূখসহ আরও অনেকে। বর্তমানে রাজবাড়ী ক্রিকেট দল অত্যন্ত শক্তিশালী। সম্প্রতি মাদারীপুর ও টাঙ্গাইল ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত সাঊস এন্ড নর্থ সাউথ অনুর্ধ-১৬ ক্রিকেট চাম্পিয়ান প্রতিযোগিতায় এবং কুষ্টিয়া ভেন্যুতে অনুষ্ঠিত ৩৯তম জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় রাজবাড়ী জেলা চাম্পিয়ান হওয়ার গৌরব অর্জন করে। বর্তমানে জেলা ক্রীড়া সংস্থার পথ থেকে বিভাগীয় পর্যায়ে অনুষ্ঠিত অনুর্ধ-১৪, ১৬, ১৮ ক্রিকেট প্রতিযোগিতা এবং জাতীয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় রাজবাড়ীর খেলোয়াড়রা অংশগ্রহণ করছে। এ ছাড়া জেলা ক্রীড়া সংস্থা ক্রিকেট কার্নিভাল বাছাই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আসছে। বর্তমান সময়ে রাজবাড়ী পৌরসভা মেয়র কাপ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এবং পাংশায় আবুল মাহমুদ স¥ৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। জেলা সদরে মোখাফফর হোসেন বাবলু স্মৃতি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট এবং গোলাম ফাত্তাহ স¤্রাট ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সাঁতারে রাজবাড়ী জেলার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস রয়েছে। সাঁতারে রাজবাড়ীর সাঁতারুরা বিশেষ করে মেয়েরা দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে রাজবাড়ী জেলার বিশেষ পরিচিতি এনে দিয়েছে। মহকুমা আমলে বিশিষ্ট সাতারুদের মধ্যে জনাব এটিএম রফিক উদ্দিন(অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও সাংবাদিক), আঃ রাজ্জাক, কে এম সহিদুন্নবী(যুদ্ধকালীন কমান্ডার), এরশাদুন্নবী সেলু, শের আলী শরীফদের নাম উল্লেখযোগ্য। রাজবাড়ী জেলা সৃষ্টির পর লায়লা নুর, শিলু, মিলু, ডলি আক্তার মুন্নী, শের আলী শরিফ(প্রাক্তন সেনা সদস্য), নিবেদিতা দাস, মানষী, পুতুল, মিতা, সীমা, সোনালী আক্তার, রূপালী আক্তার, কৃতি সাতারুরা সাঁতারে বিশেষ অবদান রেখেছে। এদের মধ্যে ডলি আক্তার মুন্নী বাংলাদেশের পক্ষে অস্ট্রেলিয়ার সিডনী, গ্রিস, ইন্দোনেসিয়া, ভারত, শ্রীলংকা, চীন এ অনুষ্ঠিত বিশ্ব অলিম্পিক ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। নিবেদিতা দাস ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত ইসলামিক গেমস এ অংশগ্রহণ করে। কৃতি এ সাতারু এক নাগারে ১৫ বছর ডাইভিং এ জাতীয় চ্যাম্পিয়ান ছিলেন। ক্ষদে সাতারু সোনালী আক্তার বয়সভিত্তিক সাতারে ২০০৭ সালে ২টি স্বর্ণ পদক লাভ করে। ডলি আক্তার মুন্নী ৭বার স্বর্ণ পদক, রূপালী আক্তার ৩বার স্বর্ণ পদক লাভ করেছে। বর্তমানে জাতীয় জুনিয়র সাঁতার প্রতিযোগিতায় সামিউল ইসলাম রাফি অংশগ্রহণ করে কৃতিতে¦র স্বাক্ষর রেখেছে।
এ্যাথলেটিক্স এ রয়েছে রাজবাড়ীর গৌরবময় ইতিহাস। শহিদুন্নবী আলম ও মোছলেহ উদ্দিন বিশেষ ভাবে এ কৃতিত্বের দাবীদার। দৌড়ে শহিদুন্নবী আলম(যুদ্ধাকালীন কমান্ডার) প্রথমবার পূর্ব পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন হন এবং ২য় বার ৮০০ মিটার দৌড়ে পূর্ব পাকিস্তান অলিম্পিকে ৩য় স্থান অধিকার করেন। মোসলেহ উদ্দিন নৌবাহিনীর হয়ে হাই জাম্পে তৎকালীন পাকিস্তান অলিম্পিকে অংশ নিতেন। শের আলী পাকিস্তান অলিম্পিকে প্রতিবারই ১ম হতেন। ১৯৯০-৯১ এ অনুষ্ঠিত বিভাগীয় এ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায় কৃষ্ণা সরকার এবং নিস্কৃতি দেশমুখ্য যথাক্রমে বর্শা নিক্ষেপ এবং লৌহ গোলক নিক্ষেপে সোনা জয় করেন। এ ছাড়াও আরও অনেক এ্যাথলেট ছিলেন যারা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতেন।
লন টেনিস খেলা বৃটিশ আমলে পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে বৃটিশরা শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে রেলওয়ে হোসনেবাগ সিনেমা হলের সামনে নিয়মিত খেলা হতো। রাজবাড়ীর বেলগাছির দুই কৃতি সন্তান হিরালাল এবং শিবলাল এক সময়ে বাংলাদেশের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন। বর্তমানে অফিসার্স ক্লাবে নিয়মিত লনটেনিস খেলা অনুষ্ঠিত হয়। লন টেনিসে অফিসার্স ক্লাবের প্রতিযোগীরা বর্তমানে বিভিন্ন জেলায় অংশগ্রহণ করে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
নৌকা বাইচ প্রাচীনকাল থেকেই এখানকার ঐতিহ্যবাহী খেলা। এটি রাজবাড়ীর গ্রামেগঞ্জে খুবই জনপ্রিয়। রাজবাড়ীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে গোদারবাজারে পদ্মা নদীতে এই প্রতিযোগিতা প্রতি বছরই অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ এই প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন। সাম্প্রতিক সময়ে রাজবাড়ী রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন জলাশয়ে ভেলা বাইচ প্রতিযোগিতাও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
দেশের একমাত্র অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রাজবাড়ী জেলায় অবস্থিত। ১৯৯৪ সালে গড়ে উঠা এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে একটি প্রকল্পের আওতায় চীন ও কোরিয়া থেকে বিশেষজ্ঞ এনে কয়েকজন শিশু শিল্পীকে অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। প্রশিক্ষিত শিল্পীরা ২০০০ সাল পর্যন্ত কয়েকটি প্রদর্শনী করে। পরে আর্থিক বরাদ্দের অভাবে এ প্রতিষ্ঠানটি ২০১১ সাল পর্যন্ত বন্ধ থাকে। পরবর্তীতে ২০১২ সাল থেকে অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কার্যক্রম চালু হয়। অ্যাক্রোবেটিক শিল্পীগণ ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৩ শতাধিক প্রদর্শনী করেছে এবং এবং নতুন শিল্পী তৈরি করছে। এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ২০১৬ সালে ১০ জন এবং ২০১৭ সালে ১০ জন শিশু চীনে গিয়ে অ্যাক্রোবেটিক প্রশিক্ষণ নিয়েছে।
ক্রীড়াঙ্গনে বিশেষ করে সাঁতারে রাজবাড়ী জেলার বিশেষ অবদানের কারণে সরকার শহরের পুলিশ লাইন সংলগ্ন ৩ একর জমির উপর জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের তত্ত্বাবধানে রাজবাড়ী শহরের প্রাণকেন্দ্রে একটি আধুনিক মানের সুইমিং পুল নির্মাণ করে। উক্ত সুইমিং পুলটি বিগত ২৭/০৭/২০০৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ কর্তৃক রাজবাড়ী জেলা ক্রীড়া সংস্থার অনুকূলে হস্তান্তর করা হয়। বিগত ২০/৯/২০০৩ খ্রিস্টাব্দ তারিখে সুইমিং পুলটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করার পর জেলা প্রশাসন ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় সুইমিং পুলে সাঁতার প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতা আয়োজনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়।
রাজবাড়ী জেলা সদরে অবস্থিত কাজী হেদায়েত হোসেন স্টেডিয়ামে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের অর্থায়নে প্যাভেলিয়ান ভবন নির্মাণ করা হয়েছে যা বিগত ১১ মার্চ, ২০১৭ তারিখ উদ্বোধন করেন সাবেক যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ড. শ্রী বীরেন শিকদার,এমপি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলায় শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়াম এবং রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানখানাপুরে শেখ রাসেল নির্মাণ কাজ শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২১ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখ ভিডিও কনফারেন্সিং এর মাধ্যমে শুভ উদ্বোধন করেন।
আমাদের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজকে মাদকমুক্ত ও অসৎসঙ্গ থেকে বিরত রাখতে বর্তমানে খেলাধুলাকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এজন্য গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিভিন্ন ক্রীড়া অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত স্টেডিয়াম নির্মাণ, অবকাঠামো উন্নয়নসহ উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টি করা হচ্ছে। বর্তমানে জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় এ্যাথলেটিক্স, সাঁতার, বাাডমিন্টন, ক্রিকেট, ভলিবল, কাবাডি খেলোয়াড় সৃষ্টির লক্ষ্যে বালক-বালিকাদের নিবিড় প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। খেলাধুলার প্রসারে আর্থিক অনুদান বৃদ্ধি করা হয়েছে। বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাব/সংগঠন, স্কুল ও মাদরাসাসমূহে ক্রীড়ার সুযোগ সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। ফলে ক্রীড়া প্রশিক্ষণ ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীর সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। রাজবাড়ীর খেলোয়াড়রা বিভাগীয় ও জাতীয় পর্যায়ে ভলিবল, সাঁতার, এ্যাথলেটিক্স, কারাত, সেপাক, ব্যাডমিন্টন, হকি, কাবাডি(পুরুষ ও মহিলা) প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করছে এবং কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছে। রাজবাড়ী জেলার সর্বত্র এখন ক্রীড়ার অনুকূল পরিবেশ বিরাজ করছে।
বর্তমান সরকার দেশীয় খেলাধুলার উন্নয়ন ও সংরক্ষণে গুরুত্ব দিয়েছে। সে কারণে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একাধিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। রাজবাড়ী জেলার ক্রীড়াঙ্গনেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। স্কুল ও মাদরাসার পাশাপাশি তৃণমূল পর্যায়ে শিশু-কিশোর তরুনদের ক্রীড়ায় উদ্বুদ্ধ করে বিভিন্ন ক্রীড়া ক্লাব ও প্রতিষ্ঠান সমূহের ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ক্রীড়া সচেতনতা সৃষ্টি ও ক্রীড়ার মানসিকতার উন্মেষ সাধন এবং কিশোর ও যুব সমাজকে মাদক, ইভটিজিং ও বাল্য বিবাহের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত রাখতে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসন, জেলা ও উপজেলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা মহিলা ক্রীড়া সংস্থা, জেলা ক্রীড়া অফিস, রাজবাড়ী কালেক্টরেট ক্লাবসহ বিভিন্ন ক্লাব ও প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশ কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডের উদ্যোগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাঁদের সন্তানদের খেলাধুলার উন্নয়ন এবং পারস্পরিক সৌহার্দ বৃদ্ধির জন্য বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় রাজবাড়ী জেলার প্রতিযোগীরা প্রতিবছর অংশগ্রহণ করছে। প্রতিবারের ন্যায় এবারও রাজবাড়ী জেলার প্রতিযোগীরা বিভিন্ন ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে ৪(চার) টি পুরস্কার লাভ করেছে।
বলাই বাহুল্য, সুস্থ-সবল দেহ-মনের জন্য খেলাধুলার বিকল্প নেই। খেলাধুলা শৃঙ্খলাবোধ, অধ্যাবসায়, দায়িত্বজ্ঞান, কর্তব্যপরায়ণতা ও সহনশীলতার শিক্ষা দেয়। সাংস্কৃতিক বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। অপরাধ প্রবণতা কমায়। মাদকাসক্তিসহ অন্যান্য নেতিবাচক প্রভাব থেকে তরুণ সমাজকে মুক্ত রাখে। সে লক্ষ্য নিয়েই জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্বাবধানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ক্লাব/সংগঠনে বিভিন্ন ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীসহ তরুণ সমাজের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী, প্রতিযোগিতা ও দলগত মনোভাব, ঐক্য ও শৃঙ্খলাবোধ গড়ে উঠছে।
এককথায় রাজবাড়ীর ক্রীড়াঙ্গন নিয়ে রাজবাড়ীবাসী গর্ব করে। এ জেলা জন্ম দিয়েছে অনেক খ্যাতনামা খেলোয়াড়, যাঁরা দেশ-বিদেশে রাজবাড়ী জেলার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। ছেলেদের পাশাপাশি রাজবাড়ীর মেয়েরাও জেলার ক্রীড়াঙ্গনৎনকে দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ক্রীড়া ক্ষেত্রে অর্জিত সাফল্যকে ধরে রেখে বর্তমান সরকার ঘোষিত রূপকল্প-২০২১ ও রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাজবাড়ীর খেলোয়াড়েরা ভবিষ্যতে রাজবাড়ীর ক্রীড়াঙ্গনকে আরও সমৃদ্ধ করবে তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
তথ্য সূত্র ঃ রাজবাড়ী ক্রীড়া ঊৎসব, ২০০৩ উপলক্ষে জেলা ক্রীড়া সংস্থা কর্তৃক প্রকাশিত স¥রণিকা, প্রফেসর মতিয়র রহমান লিখিত ‘রাজবাড়ী জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’, তৃতীয় সংস্করণ, রাজবাড়ী পাবলিক লাইব্রেরির শতবর্ষ উৎসব-২০১৩ এবং রাজবাড়ী প্রশাসন কর্তৃক প্রকাশিত জেলা ব্র্যান্ড বুক ‘পদ্মা কন্যা রাজবাড়ী’, প্রকাশকাল- জুন, ২০১৮ খ্র্রিস্টাব্দ। লেখক ঃ মোঃ শওকত আলী, জেলা প্রশাসক, রাজবাড়ী।