॥জাপান থেকে ফিরে খোন্দকার আব্দুল মতিন॥ বিদেশী শ্রমিক নেওয়ার জন্য সম্প্রতি এশিয়ার নয়টি দেশকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করেছে জাপান। এসব শ্রমিককে তারা অবকাঠামো নির্মাণ, রেঁস্তোরা, কৃষি এবং নার্সিংয়ে নিয়োগ দেবে। এসব খাতে আগামী ৫বছরে জাপানে কমপক্ষে ৩লাখ ৪৫হাজার জনবল লাগবে।
জনবল নিয়োগের প্রাথমিক তালিকায় স্থান পাওয়া দেশগুলো হলো ঃ কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মঙ্গোলিয়া, মিয়ানমার, নেপাল, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। তবে কোন দেশ থেকে কত শ্রমিক নেওয়া হবে তা এখনও জানানো হয়নি। এ তালিকায় বাংলাদেশের নাম যুক্ত করার বিষয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত আছে। সম্প্রতি ঢাকায় জাপান দূতাবাসের রাষ্ট্রদূতসহ শীর্ষ কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বাংলাদেশ সরকার আশা করছে, শিগগিরই এ ব্যাপারে তারা সবুজ সংকেত পাবে। জাপান ও বাংলাদেশ কূটনৈতিক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সূত্রে জানা যায়, জাপানের অভিবাসন আইন অত্যন্ত কঠোর। তবে এশিয়ার শিল্পোন্নত এই দেশটির বিদেশী শ্রমিকের প্রয়োজন আছে। ইতিমধ্যে জাপানের শিনজো আবের সরকার বিদেশী শ্রমিকদের নেওয়ার সিদ্ধান্ত সহজ করার বিভিন্ন পদক্ষেপও নিয়েছেন। জাপানে আসার পর শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান যাতে ভালো থাকে এবং দেশটির সংস্কৃৃতির সঙ্গে তারা যেন মানিয়ে নিতে পারেন, সেজন্য সরকার ২২.৪ বিলিয়ন ইয়েন খরচ করার প্রস্তুতি নিয়েছে।
জানা যায়, এতদিন প্রধানত চীন থেকেই দক্ষ জনবলের জোগান পেত জাপান। তবে স্থানীয় চাহিদার কারণে সম্প্রতি চীন সরকার বিদেশে শ্রমিক পাঠাতে অনুৎসাহ দেখাচ্ছে। পাশাপাশি চীনা শ্রমিকরা বিদেশে বেতনও বেশী দাবী করছেন। এতে জাপানে সৃস্টি হয়েছে নতুন শ্রমিকের ব্যাপক চাহিদা। চলতি সালের রাগবি বিশ^কাপ, ২০২০ সালে গ্রীস্মকালীন অলিম্পিক, প্যারা অলিম্পিক ও ২০২২ সালে শীতকালীন অলিম্পিকের আয়োজক দেশ হয়েছে জাপান। নিজ দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং ব্যাপক উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ায় বিপুল শ্রমিকের অভাব বোধ করছে দেশটি। শ্রমিকের চাহিদা পূরণে জাপান বিদেশী শ্রমিক নিয়োগ করতে অভিবাসন আইনে পরিবর্তন এনেছে। দেশটির মন্ত্রীসভা সম্প্র্রতি এ বিষয়ক একটি খসড়া আইন অনুমোদন করেছে। কর্মী সংকট থাকা খাতগুলো, বিশেষ করে কৃষি, নির্মাণ কাজ এবং স্বাস্থ্যখাতে বিদেশী শ্রমিক নিতে পারবে জাপানী উদ্যোক্তারা।
এ বিষয়ে গত ২১শে ফেব্রুয়ারী টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, জাপানে শ্রমিক নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের সুনাম যেন নষ্ট না হয়, সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা জানান, ক্রমবর্ধমান কর্মী সংকটের প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি জাপানে সরাসরি কর্মী নিয়োগের একটি আইন পাশ হয়েছে। যদিও সেখানে কোনো শ্রম নীতি নেই। নতুন জনবল নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে নয়টি দেশকে নির্বাচিত করা হয়েছে। বরাবরই দেশটি আশিয়ানভূক্ত দেশগুলোর নাগরিকদের নেওয়ার বিষয়ে আগ্রহ দেখালেও সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দু’দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে।
এক প্রশ্নের জবাবে রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, জাপানে সরাসরি কর্মী নিয়োগ কিংবা টেকনিক্যাল ইন্টার্ন নিয়োগের বিষয়ে বিভ্রান্ত না হয়ে যে কোনো তথ্য জানার জন্য সরাসরি টোকিওতে বাংলাদেশ দহৃতাবাস কিংবা জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাগোগ করতে হবে।
রাবাব ফাতিমা বলেন, জাপানে প্রায় ১৬ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করছেন। এ সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। দেশটিতে আরও জনবল প্রয়োজন। জাপানের জনসংখ্যা বয়স্ক মানুষের ভারে ন্যুয়ে পড়েছে। তাদের সেবার জন্য লোকের প্রয়োজন। এজন্য প্রশিক্ষিত মহিলা-পুরুষ নিয়োগের চেষ্টা চলছে। এজন্য দেশে সংশ্লিষ্টদের ডিপ্লোমা কোর্স ও জাপানী ভাষা শিখতে হবে। পাশাপাশি অবকাঠামো নির্মাণ, রেঁস্তোরা, কৃষি এবং নার্সিংয়ে জনবল প্রয়োজন দেশটিতে।
তিনি জানান, জাপানের শ্রমিক চাহিদা ও এ বিষয়ক নতুন আইন প্রণয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। খসড়া আইনে দুই ধরনের ভিসার কথা বলা হয়েছে। প্রথম ভিসা ক্যাটাগরিতে জাপানে যাওয়া শ্রমিকরা ৫বছর কাজ করতে পারবেন এবং পরিবার নিয়েও বাসবাস করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে তাদের একটি নির্দিষ্ট মানের কাজ করার দক্ষতা কিংবা জাপানি ভাষা কিছুটা আয়ত্বে থাকতে হবে। দ্বি^তীয় ক্যাটাগরির ভিসাতে জাপান যাওয়ার সুযোগ পাবেন উচ্চশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীরা। তাদেরকে সেখানে পরিবারসহ স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ দেওয়া হবে।
রাষ্ট্রদূত আরো বলেন, ট্রেডিশনাল সোর্স কান্ট্রি থেকে জাপান লোক নিচ্ছে। তাদের মধ্যে টেকনিক্যাল ইন্টার্ণকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। এখানে ভারতের ২৫ হাজার, পাকিস্তানের ২০ হাজার শ্রীলংকার ২০হাজার বাংলাদেশের ১৬হাজার ও নেপালের ৮৫হাজার লোক কাজ করছে। আর অধিকাংশই চীন ও অশিয়ানভুক্ত সদস্য দেশের নাগরিকরা কর্মরত আছেন। সেই তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কম নয়।
তিনি আরও বলেন, জাপানে কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সমস্যা ভাষা। এই ভাষা জানতে হবে। এজন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন টিটিসি’তে জাপানী ভাষা শেখার জন্য সহায়তা দেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে জাপান সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারাও আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে জাপান সরকার ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তারা সার্বিক সহযোগিতা করার আশ^াসও দিয়েছে।
উল্লেখ্য, রাবাব ফাতিমা ২০১৬ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারী রাষ্ট্রদূত হিসেবে জাপানের টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগদান করেন। এর আগে তিনি কমনওয়েলথ সচিবালয়ে রিলিজিওয়ান রিপ্রেজেনটেটিভ ফর সাউথ এশিয়া বিভাগে ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মাইগ্রেশন(আইওএম) ৪বছর কাজ করেছেন। হেড অব হিউম্যান রাইটস কমনওয়েলথ সচিবালয়ে ২বছর ৯মাস কাজ করেন। ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়ায় জন্ম নেওয়া এই কূটনীতিক বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সংস্থান সফলতার সাথে কাজ করেছেন।