॥স্টাফ রিপোর্টার॥ আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারী। মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। জাতিসংঘের উদ্যোগে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে ভাষা শহীদদের স্মরণে যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালিত হবে।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালে মহান একুশের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ এবং বিভিন্ন স্থানে আলোচনা সভাসহ নানা কর্মসূচীর মধ্য দিয়ে জাতি একুশের মহান শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাবে।
রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ আজ একুশের প্রথম প্রহরে ১২টা ১ মিনিটে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর পরপরই শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন দিবসটি পালনে বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। অমর একুশে পালনের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। কেন্দ্র্রীয় শহীদ মিনার, আজিমপুর কবরস্থানসহ একুশের প্রভাতফেরী প্রদক্ষিণের এলাকায় বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, প্রণয়ন করা হয়েছে শহীদ মিনারে প্রবেশের রোডম্যাপ।
যে কোন জাতির জন্য সবচেয়ে মহৎ ও দুুর্লভ উত্তরাধিকার হচ্ছে মৃত্যুর উত্তরাধিকার- মরতে জানা ও মরতে পারার উত্তরাধিকার। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী শহীদরা জাতিকে সেই মহৎ ও দুর্লভ উত্তরাধিকার দিয়ে গেছেন। ১৯৫২ সালের এই দিনে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে বাংলার (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ও যুব সমাজসহ সর্বস্তরের মানুষ সে সময়ের শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানী ও প্রশাসনের ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে আসে। মায়ের ভাষা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে দুর্বার গতি পাকিস্তানী শাসকদের শংকিত করে তোলায় সেদিন ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে সালাম, জব্বার, শফিক, বরকত ও রফিক গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন। তাদের এই আত্মদান নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সরদার ফজলুল করিম তার ‘বায়ান্নোরও আগে’ প্রবন্ধে লিখেছেন ‘বরকত সালামকে আমরা ভালবাসি। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা বরকত সালাম আমাদের ভালবাসে। ওরা আমাদের ভালবাসে বলেই ওদের জীবন দিয়ে আমাদের জীবন রক্ষা করেছে। ওরা আমাদের জীবনে অমৃত রসের স্পর্শ দিয়ে গেছে। সে রসে আমরা জনে জনে, প্রতিজনে এবং সমগ্রজনে সিক্ত।’ এদের আত্মদানের মধ্য দিয়ে আমরা অমরতা পেয়েছি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ আমরা বলতে পারি দস্যুকে, বর্বরকে এবং দাম্ভিককে ‘তোমরা আর আমাদের মারতে পারবে না। কেননা বরকত সালাম রক্তের সমুদ্র মন্থন করে আমাদের জীবনে অমরতার স্পর্শ দিয়ে গেছেন।’ বরেণ্য শিক্ষাবিদ আবুল ফজল একুশ নিয়ে তার এক লেখায় লিখেছেন ‘মাতৃভাষার দাবী স্বভাবের দাবী। ন্যায়ের দাবী, সত্যের দাবী- এ দাবীর লড়াইয়ে একুশে ফেব্রুয়ারীর শহীদরা প্রাণ দিয়েছেন। প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন, স্বভাবের ব্যাপারে, ন্যায় ও সত্যের ব্যাপারে কোন আপোষ চলে না, চলে না কোন গোঁজামিল। জীবন-মৃত্যুর ভ্রুকুটি উপেক্ষা করেই হতে হয় তার সম্মুখীন।’ বস্তুতঃ মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ৫২’র একুশে ফেব্রুয়ারী ছিল ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও শাসকগোষ্ঠীর প্রভূসুলভ মনোভাবের বিরুদ্ধে বাঙ্গাালীর প্রথম প্রতিরোধ এবং ভাষার ভিত্তিতে বাঙ্গালীর জাতীয় চেতনার প্রথম উন্মেষ। ভাষা শহীদদের রক্তের বিনিময়ে বাঙ্গালী জাতি সেদিন ‘মায়ের ভাষার’ মর্যাদা অর্জনের পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও পায় নব প্রেরণা। এরই পথ বেয়ে শুরু হয় বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে সংযোজিত হয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম দেশ-‘বাংলাদেশ’। একুশে ফেব্রুয়ারী শোকাবহ হলেও এর যে গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় তা পৃথিবীর বুক অনন্য। কারণ বিশ্বে এ যাবতকালে একমাত্র বাঙ্গালী জাতিই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছে।
২১শে ফেব্রুয়ারী জাতীয় ছুটির দিন। এদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সকল সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্তশাসিত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বেসরকারী ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। ২১শে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র এবং বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেসরকারী স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো একুশের বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করবে।
আওয়ামী লীগের দু’দিনব্যাপী কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- রাত ১২টা ১ মিনিটে (রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর শ্রদ্ধা নিবেদনের পর) কেন্দ্র্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ, সকালে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় বঙ্গবন্ধু ভবনসহ সংগঠনের সকল শাখা কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। সকাল ৭টায় কালো ব্যাজ ধারণ, প্রভাতফেরী সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে শহীদদের কবরে ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ ও শ্রদ্ধা নিবেদন। এছাড়াও ২২শে ফেব্রুয়ারী বিকাল ৩টায় রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটশন মিলতনায়তনে এ উপলক্ষে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আজ এক বিবৃতিতে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকল কর্মসূচী যথাযথভাবে পালনের জন্য দলের নেতা-কর্মীসহ সংগঠনের সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়াও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যদায় উদযাপন উপলক্ষে বাংলা একাডেমী, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী, নজরুল ইনিস্টিটিউট, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, জাতীয় জাদুঘর, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, শিশু একাডেমীসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে- সকাল ৬টা ৩০ মিনিটে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামানের নেতৃত্বে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশ থেকে প্রভাতফেরী সহকারে আজিমপুর কবরস্থান হয়ে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গমন ও পুষ্পস্তবক অর্পণ, বাদ জোহর অমর একুশে হলে শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনায় বিশেষ মোনাজাত, বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদুল জামিয়া, সকল হলের মসজিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকার মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত/শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত/প্রার্থনা।
রাজবাড়ীর কর্মসূচী ঃ দিবসটি যথাযথ মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে রাজবাড়ী জেলা প্রশাসন চার দিনব্যাপী একুশে বইমেলাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে। এর অংশ হিসেবে গত ১৯শে ফেব্রুয়ারী বিকাল সাড়ে ৪টায় রাজবাড়ী শহরের বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খুশি রেলওয়ে ময়দানে ‘অমর একুশে বইমেলা-২০১৯’ এর উদ্বোধন করা হয়েছে। গতকাল ২০শে ফেব্রুয়ারী বিকালে বইমেলার মঞ্চে আলোচনা সভা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। আজ ২১শে ফেব্রুয়ারী রাত ১২টা ১ মিনিটে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খুশি রেলওয়ে ময়দানের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের জনগণ কর্তৃক পুষ্পস্তবক অর্পণ, সূর্যোদয়ের সাথে সাথে সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন ভবনে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতভাবে উত্তোলন, বাদ যোহর ভাষা শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে সকল মসজিদে বিশেষ মোনাজাত, ভাষা শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে সকল মন্দির, গীর্জা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ প্রার্থনা, বিকাল ৩টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খুশি রেলওয়ে ময়দানে ডাঃ আবুল হোসেন কুইজ প্রতিযোগিতা, বিকাল ৪টায় একই স্থানে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচী, বিকাল সাড়ে ৪টায় মেলার মঞ্চে ‘একুশের প্রেক্ষিত’ শীর্ষক আলোচনা, বিকাল ৫টায় অতিথিগণ কর্তৃক বইমেলার স্টল পরিদর্শন এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় বইমেলার মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে। আগামীকাল ২২শে ফেব্রুয়ারী বিকাল সাড়ে ৫টায় বইমেলার মঞ্চে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সমাপনী ও পুরষ্কার বিতরণ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হবে।