॥স্টাফ রিপোর্টার॥ দেশবরেণ্য সাংবাদিক ও সমকাল সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের মরদেহ সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে গতকাল মঙ্গলবার রাত পৌনে ১১টায় সিঙ্গাপুর থেকে হযরত শাহজালাল(রহঃ) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছানোর পর মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তার উত্তরার বাসভবনে।
সেখান থেকে গোলাম সারওয়ারের মরদেহ রাখা হবে বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে। সমকালের নগর সম্পাদক শাহেদ চৌধুরী এই তথ্য জানিয়েছেন।
সমকাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আজ বুধবার গোলাম সারওয়ারের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে তার প্রিয় জন্মভূমি বরিশালের বানারীপাড়ায়। সেখানে শ্রদ্ধা ও জানাজার পর তার মরদেহ ঢাকায় নিয়ে আসা হবে।
সমকালের নগর সম্পাদক শাহেদ চৌধুরী জানান, আগামীকাল বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় গোলাম সারওয়ারের মরদেহ নিয়ে আসা হবে তার প্রিয় কর্মস্থল সমকাল কার্যালয়ে। সেখানে সহকর্মীদের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে পার্শ্ববর্তী বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে তার জানাযা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যবস্থাপনায় সকাল ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ১২টা পর্যন্ত মরহুমের মরদেহ সর্বস্তরের জণগণের শ্রদ্ধার জন্য রাখা হবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। শ্রদ্ধা জানানোর পর সেখান থেকে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হবে জাতীয় প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। দীর্ঘ কর্মময় জীবনের অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন তার এই প্রিয় প্রতিষ্ঠানে। সংবাদকর্মীরা সেখানে গোলাম সারওয়ারের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। এখানে বাদ জোহর তার জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর বাদ আসর মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত হবেন গোলাম সারওয়ার।
উল্লেখ্য, গত ১৩ই আগস্ট বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ২৫মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন গোলাম সারওয়ার। ৭৫বছর বয়সী গোলাম সারওয়ার স্ত্রী, দুই ছেলে, এক মেয়ে, সহকর্মীসহ অগণিত গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
দেশবরেণ্য সাংবাদিক গোলাম সারওয়ারের মৃত্যুতে রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমকাল কার্যালয়ে শোকবই খোলা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সকালে এ শোকবই খোলা হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই শোকবই খোলা থাকবে। এছাড়াও প্রিয় সম্পাদকের মৃত্যুকে কালোব্যাজ ধারণ করেছেন সমকালের কর্মীরা। সকাল থেকে শোকবইয়ে স্বাক্ষর করেছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সিনিয়র সাংবাদিক আবেদ খান, সাংবাদিক নেতা মনজুরুল আহসান বুলবুল, বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি মোঃ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ ও সচিব শ্যামল চন্দ্র কর্মকার, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রমুখ।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে উজ্জ্বল নাম গোলাম সারওয়ার দৈনিক ইত্তেফাকে দীর্ঘ ২৭ বছর বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি সাপ্তাহিক পূর্বাণীর নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। তার নেতৃত্বে সাংস্কৃতিক সাপ্তাহিক হিসেবে পূর্বাণী অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এসব কৃতিত্বের ধারাবাহিকতায় তিনি দেশের দুটি সেরা দৈনিক ‘যুগান্তর’ ও ‘সমকাল’ এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে সাফল্য অর্জন করেন। মৃত্যুর আগ আগ পর্যন্ত তিনি সমকালের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
গোলাম সারওয়ার ১৯৪৩ সালের ১লা এপ্রিল বরিশালের বানারীপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মরহুম গোলাম কুদ্দুস মোল্লা ও মা মরহুমা সিতারা বেগম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান গোলাম সারওয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক সম্মানসহ এমএ ডিগ্রী অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদীর বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে তার সাংবাদিকতা পেশার সূচনা। একই বছর দৈনিক সংবাদের সহসম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পর্যন্ত সংবাদে চাকরীরত ছিলেন। এরপর মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন নিজ এলাকা বানারীপাড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের পর কয়েক মাস বানারীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশনে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। তার পরপরই ১৯৭২ সালে ইত্তেফাকে সিনিয়র সহ-সম্পাদক হিসেবে যুক্ত হন। ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত যথাক্রমে প্রধান সহ-সম্পাদক, যুগ্ম বার্তা সম্পাদক ও বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশের দৈনিক সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকদের সংগঠন বাংলাদেশ সম্পাদক পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও সঙ্গীত জগতে একসময় তিনি ছিলেন ঘনিষ্ঠ। তার লেখা বেশ কয়েকটি গান আজও শ্রোতাহৃদয়ে শিহরণ জাগায়। তার রচিত গ্রন্থের মধ্যে ‘সম্পাদকের জবানবন্দী’, ‘অমিয় গরল’, ‘আমার যত কথা’, ‘স্বপ্ন বেঁচে থাক’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিকতায় জীবনব্যাপী অনন্য ভূমিকার জন্য তিনি ২০১৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।