॥আসহাবুল ইয়ামিন রয়েন/মোক্তার হোসেন॥ জাতীয় ব্যক্তিত্ব, জ্ঞানতাপস, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, খ্যাতিমান দাবাড়ু ও জাতীয় অধ্যাপক মহামনীষী ড. কাজী মোতাহার হোসেনের ১২১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গতকাল ৩০শে জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পাংশা উপজেলার হাবাসপুরে তার নামে প্রতিষ্ঠিত ড. কাজী মোতাহার হোসেন কলেজে অনুষ্ঠিত হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা।
জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক ও ড.কাজী মোতাহার হোসেন কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ড. এম.এ মাজেদ, পুলিশ সুপার আসমা সিদ্দিকা মিলি বিপিএম-সেবা, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার, পাংশার এয়াকুব আলী স্মৃতি পাঠাগারের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আব্দুল ওহাব, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরিদ হাসান ওদুদ এবং পাংশা পৌরসভার মেয়র আব্দুল আল মাসুদ বিশ্বাস।
অনুষ্ঠানে অন্যান্য অতিথিদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রেবেকা খান এবং স্বাগত বক্তব্য রাখেন ড. কাজী মোতাহার হোসেন কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল আজিজ। অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন ডক্টর কাজী মোতাহার হোসেন কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ বিকাশ চন্দ্র বসু।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্যে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা বলেন, বাংলাদেশসহ তদানীন্তন ভারতবর্ষে বিশিষ্ট মনীষীদের মধ্যে ড. কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন অন্যতম। যিনি রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার পদ্মা বিধৌত হাবাসপুর থেকে মেধা ও প্রতিভার মাধ্যমে নিজেকে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছিলেন। আজ সেই জ্ঞানতাপস পন্ডিতের ১২১তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমাকে প্রধান অতিথি হিসেবে জেলা প্রশাসক আমন্ত্রণ করায় স্ত্রীর অসুস্থ্যতাসহ শত ব্যস্ততার মধ্যেও আমি এখানে এসেছি। কারণ এই কলেজের প্রতিষ্ঠা থেকে আজ পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে তার সবকিছুর সাথেই আমি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এলাকাবাসীসহ সকলের সহযোগিতার কারণে এই মহামনীষীর নামে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রাখছে। ড. কাজী মোতাহার হোসেন বাংলাদেশের একজন জাতীয় ব্যক্তিত্ব, জ্ঞানতাপস, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের জনক, পরিসংখ্যানের বিশ্ববিখ্যাত হুসেন রুল তত্ত্বের আবিষ্কারক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা, খ্যাতিমান দাবাড়ু এবং জাতীয় অধ্যাপক হওয়া সত্ত্বেও আজকে তার ১২১তম জন্মবার্ষিকীর এই দিন বাংলাদেশের মাত্র ২টি জায়গায় পালিত হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং আরেকটি এই কলেজ। যা আমাদের জন্য একটি পরিতাপের বিষয়। কারণ এই মনীষীর বিভিন্ন লেখনী ও আবিষ্কারে শুধু বাঙালীই নয়, ভারতবর্ষসহ বিশ্ববাসী উপকৃত হয়েছে। তিনি তার লিখিত বিভিন্ন বইয়ে সমাজের কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামী থেকে মুক্তি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, নিজে জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি অন্যকে জ্ঞান অর্জনে উৎসাহিত করেছেন। তিনি অজোপাড়াগাঁয়ে জন্মগ্রহণ করেও নিজের চেষ্টা ও ভবিষ্যৎ জ্ঞান অর্জনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। আমি বর্তমান প্রজন্মকে বলবো তার এই জ্ঞান অর্জন থেকে শিক্ষা নেওয়ার জন্য। যাতে ড. কাজী মোতাহার হোসেনের নামে প্রতিষ্ঠিত এই কলেজ থেকে তার মতো আরো মনীষী গড়ে ওঠে।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা আরও বলেন, বর্তমানে কলেজটির এইচএসসির রেজাল্টে আমি মোটেও খুশি না। কারণ কলেজের লেখাপড়ায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা মনোযোগী হচ্ছে না। আমি আশা করবো ভবিষ্যতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালনের মাধ্যমে কলেজের রেজাল্ট ভালো হওয়ার জন্য সচেষ্ট থাকবে। আমি আমার জীবনের স্বার্থগত কোন বিষয় নিয়ে কখনো ভাবিনি। শুধু একটি স্বার্থ নিয়েই ভেবেছি, যাতে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জ্ঞান-গরিমায় আরো ভালো করতে পারে। রাজবাড়ীর কিছু বিষয় জানার পর আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। আমি যখন সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বে ছিলাম তখন এই পল্লী এলাকার রাস্তা-ঘাটের উন্নয়ন ও নদী ভাঙ্গন রোধে বাঁধ নির্মাণে সরকারসহ বিভিন্ন বিদেশী সংস্থার অর্থায়নের ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তি নদী থেকে বালু উত্তোলন, স্তুপ ও পরিবহন করে রাস্তাঘাট ও বাঁধ হুমকীর মুখে ফেলেছে। আজ যদি এই বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হবে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষের। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য আমি জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সকল জনপ্রতিনিধিদের আহ্বান জানাচ্ছি। যাতে এই বালু উত্তোলন বন্ধ হয়।
এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার ও পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদকে কলেজের উন্নয়ন কাজে সহযোগিতা করার ধন্যবাদ জানান।
সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী বলেন, ড. কাজী মোতাহার হোসেন শুধু একজন পরিসংখ্যানবিদই ছিলেন না-তিনি একাধারে ছিলেন জ্ঞানতাপস, প্রগতিশীল চিন্তাবিদ, বিজ্ঞানী, খ্যাতিমান দাবাড়ু সর্বোপরি সর্বগুণে গুণান্বিত একজন পন্ডিত ব্যক্তি। শিক্ষাক্ষেত্রে পান্ডিত্যের জন্য একজন মনীষীর যতগুলো ডিগ্রী থাকা দরকার তার সবগুলোই তার ছিল। আর তিনি অজোপাড়াগাঁয়ের একটি গ্রাম থেকে নিজের চেষ্টায় সেখানে পৌঁছেছিলেন। তিনি শিক্ষাক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য স্বাধীনতা পদকসহ বিভিন্ন জাতীয় পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। অতীত থেকেই পাংশা উপজেলায় ড.কাজী মোতাহার হোসেন, এয়াকুব আলী চৌধুরীসহ বিভিন্ন শিক্ষানুরাগী জ্ঞানী ব্যক্তি যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন। বাংলাদেশের ১০টি জ্ঞানসমৃদ্ধ ব্যক্তিদের জন্মস্থানের উপজেলার মধ্যে পাংশা একটি। শুধু তাই নয়, আজকের প্রধান অতিথি প্রশাসনিক ক্যাডার থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়া আবু হেনা স্যারসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্বপ্রাপ্ত অনেক কর্মকর্তাই এই পাংশা উপজেলার। পাংশা উপজেলাকে আমরা একটি জ্ঞানসমৃদ্ধ উপজেলা বলতেই পারি। আজকে ড. কাজী মোতাহার হোসেনের নামে যে কলেজটিতে এই স্মরণসভা হচ্ছে সেটি ১৯৯৩ সালে আজকের প্রধান অতিথি আবু হেনা স্যারের বিশেষ চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আজকে এই কলেজে অনেক শিক্ষার্থী লেখাপড়া করছে। আমি আশা করবো তারা ভালোভাবে লেখাপড়ার মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করবে। প্রধান অতিথির বক্তব্য মতে কলেজের রাস্তা ও অবকাঠামোসহ মাঠ ও হোস্টেল উন্নয়নের জন্য ইতিমধ্যে এলজিইডি, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছি। তারা আমাকে আশ্বস্ত করেছেন স্বল্প সময়ের মধ্যে সমস্যাগুলোর সমাধান করা হবে। এছাড়াও তিনি কলেজকে ২লক্ষ টাকা অনুদান ও আগামী ৭দিনের মধ্যে ড. কাজী মোতাহার হোসেনের রচিত প্রতিটি বইয়ের ৫টি করে কপি দেয়ার ঘোষণা দেন।
তিনি নদী থেকে বালু উত্তোলন করে ও পার্শ্ববর্তী জেলা পাবনা থেকে বালু এনে নদীর তীরে পাহাড়ের মতো স্তুপ করে রেখেছে তাদের প্রতি কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের হুঁশিয়ারী দেন। যদি তারা বালু অপসারণ না করে তবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে বালু বাজেয়াপ্ত করা হবে উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে পাংশা উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার(পাংশা সার্কেল) মোঃ ফজলুল করিম, এনডিসি শাহ্ মোঃ সজীব, শিক্ষানবীশ সহকারী পুলিশ সুপার জাবেদ ইকবাল, পাংশা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আহসান উল্লাহ, হাবাসপুর ইউপির চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল আলিম, বাহাদুরপুর ইউপির চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর শাকিল, বাহাদুরপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুল মান্নান, আইডিয়াল গার্লস কলেজের অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মান্নান, অধ্যাপক নিরঞ্জন কুমার দাস, ড. কাজী মোতাহার হোসেন কলেজের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
আলোচনা সভার শেষে পাংশা উপজেলা শিল্পকলা একাডেমীর শিল্পীরা এবং কলেজের শিক্ষার্থীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। এছাড়াও ড. কাজী মোতাহার হোসেনের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত বিভিন্ন প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে অতিথিরা পুরস্কার বিতরণ করেন।