॥শিহাবুর রহমান॥ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর ওপর প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল বাংলাদেশ পুলিশ। অথচ সেই বাংলাদেশ পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর প্রণব বন্ধু চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েও স্বাধীনতার ৪৫বছরেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ পায়নি। মেলেনি স্বাধীনতা যুদ্ধের স্বীকৃতি। আর তাই জীবনের পরন্ত বেলাতেও জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি চান এ বীরযোদ্ধা।
প্রণব বন্ধু চৌধুরী বলেন, তার বাড়ী রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি গ্রামে। তার বাবার নাম কুমুদ বন্ধু চৌধুরী। তবে তিনি বর্তমানে রাজবাড়ী শহরের পুলিশ লাইন এলাকায় বসবাস করছেন। তিনি ১৯৭০ সালে তৎকালীন(ইপিপি) ইষ্ট পাকিস্তান পুলিশে চাকুরীতে যোগদান করেন। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত ১২টার পর পাক হানাদার বাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ইপিআর হেড কোয়াটার(বিডিআর পিলখানা) এক সঙ্গে ট্যাংক, মেশিনগান, কামান ইত্যাদি নিয়ে আক্রমন করে। আমি তখন ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনে ছিলাম। এই রাতেই আমরা ময়মনসিংহ তৎকালীন ইপিআর(বিডিআর) ক্যাম্পে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পাই। তখন ময়মনসিংহ পুলিশ লাইনের ম্যাগজিন গার্ডে(বিপদ সংকেত) জরুরী এ্যালার্ম বেজে উঠে। আমরা পুলিশ বাহিনীর সমস্ত সদস্য দ্রুত সরকারী পোষাক পরে অস্ত্রাগার হতে অস্ত্র, গুলি নিয়ে ইপিআর ক্যাম্পের দিকে গুলি করতে করতে অগ্রসর হই। আমাদের দায়িত্বে তখন হাবিলদার আব্দুল আজিজ ছিলেন। তিনি ৩টি প্লাটুনে ভাগ করে তিন দিক থেকে আক্রমন করার নির্দেশ দেন। এই আক্রমনের সময় হাবিলদার মেজর আব্দুল জব্বার যথেষ্ট সহযোগিতা করেন। ইপিআর ক্যাম্পের গোলাগুলির ঘটনায় পাকিস্তানী ইপিআর সদস্যরা বাঙ্গালী ইপিআরদের ওপর অর্তকিত ব্রাশ ফায়ার শুরু করে এবং বেশ কিছু বাঙ্গালী ইপিআর সদস্যকে মেরে ফেলে। আমরা ইপিআর ক্যাম্পের ৩দিক থেকে আক্রমন করে জীবিত ইপিআরদের রক্ষা করি এবং পাকিস্তানী ইপিআর’র ১২জন সদস্যকে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করি। এদের সঙ্গে একজন সুবেদার মেজরও ছিলো। তাদেরকে আমরা পুলিশ লাইনে নিয়ে আসি। পরে পুলিশ লাইনের উত্তর দিকে ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে গুলি করে তাদের মেরে ফেলি। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে ইপিআর বিহারী পাঞ্জাবী পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জন মারা যায়। বাকিরা রাতের অন্ধকারে পালিয়ে টাঙ্গাইল জেলার দিকে মধুপুর গড় অভিমুখে রওনা দেয়।
তিনি আরো বলেন, ১৩ই এপ্রিল আমরা জানতে পারি পাক বাহিনী টাঙ্গাইল থেকে ময়মনসিংহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তখন আমরা ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন হতে হাবিলদার আব্দুল আজিজসহ ১৪০জন ট্রাক যোগে মধুপুর গড়ের দিকে রওনা হই। মধুপুর পৌছানোর পর বেলা অনুমান ২টার দিকে আমরা দেখতে পাই পাক বাহিনীর একটি জীপ ও দুইটি ট্রাক পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে মধুপুর গড়ের দিকে আসছে। আমরা তৎক্ষনাৎ উক্ত গাড়ীর উপর আক্রমন করি। আমাদের আক্রমনে পাক বাহিনীর ৫জন সেনা মারা যায় এবং বাকি হানাদার বাহিনীর সদস্য টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতির দিকে চলে যায়। আমরা পাক বাহিনীর ৩টি গাড়ী ও বেশ কিছু রাইফেল ও গুলি তাদের কাছ থেকে জব্দ করি। ওই দিন নালিতা বাড়ী বর্ডার হয়ে ভারত থেকে একজন বিএসএফ ক্যাপ্টেন যার নাম ছিল বালজিৎ সিং তার সঙ্গে ইপিআর’র একজন সুবেদার ছিলো। তারা মধুপুর এসে আমাদের সহযোগিতায় মধুপুর বাজারের ব্রীজ ভাঙ্গার জন্য ভারতের ও ইপিআর এর আর্টিলারি ইঞ্জিনিয়ারদের সঙ্গে ১৫/২০জন বাঙালী ইপিআর নিয়ে এ্যাক্সপ্লোজিব দিয়ে মধুপুরের ব্রীজ ভেঙে ফেলা হয়। যাতে পাক হানাদার বাহিনী ওই রাস্তা দিয়ে ময়মনসিংহ জেলায় প্রবেশ করতে না পারে। রাতে আমরা মধুপুরে অবস্থান করি। পরদিন ১৪ই এপ্রিল সকালে আমরা লোক মারফত জানতে পারি পাক বাহিনী কালিহাতি থেকে টাঙ্গাইল জেলার দিকে অগ্রসর হয়েছে। এই সংবাদ পাওয়ার পর আমরা অস্ত্র, গুলি নিয়ে টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা হই। কালিহাতি পৌছালে ওই এলাকার লোকজন জানায় আর সামনে অগ্রসর হওয়া যাবে না। আমরা তখন কালিহাতি বাজার ও ব্রীজের ডান এবং বাম পাশের বাংকার তৈরী করতে থাকি। তখন গ্রামবাসী আমাদের রুটি, কলা, ডিম, মুড়ি, চিড়া এনে খাওয়ায়। রাতে আমরা কালিহাতি বাংকারে অবস্থান করি এবং বিভিন্ন জায়গায় মাটির মরিচা তৈরী করি। পরের দিন ১৫ই এপ্রিল কালিহাতি ব্রীজের দুই পাশে ইপিআরদের মাধ্যমে দুইটি রকেট রেঞ্জার ও মেশিনগান সেট করি। আমরা ব্রীজ থেকে অনুমান দুইশত গজ সামনের দিকে ডিফেন্সে থাকি। বেলা ১১টার দিকে আমাদের মাথার উপর দিয়ে পাক বাহিনীর ২টি বিমান উড়ে যায়। এরপর হঠাৎ একটি পাক বাহিনীর জীপ পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে ধীর গতিতে কালিহাতি ব্রীজের দিকে আসতে থাকে। তার পিছনে আনুমানিক ২০/২৫টি গাড়ী ভর্তি পাক হানাদার বাহিনী দেখতে পাই। সবার হাতেই বিভিন্ন ধরণের অস্ত্র। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের রেঞ্জার রকেট থেকে গুলি ছোঁড়া হয়। আমাদের আক্রমনের কারণে রকেটের গোলার আঘাতে একটি জীপ ও একটি ট্রাক উল্টে রাস্তার নিচে পড়ে যায়। এরপর শুরু হয় প্রচন্ড গোলাগুলি। বেশকিছু সময় গোলাগুলি চলতে থাকে। তখন পাক বাহিনী আমাদেরকে চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তখন আমাদেরও গুলি শেষ হয়ে যায়। আমাদের পুলিশসহ বেশ কিছু ইপিআর সদস্য আহত ও নিহত হন। আমরা প্রাণ রক্ষার্থে যে যে দিকে সম্ভব সরে পড়ার চেষ্টা করি। পাক বাহিনীর গোলাগুলির মধ্যে দিয়ে দৌড়াইয়া কালিহাতি থেকে প্রায় ৩কিলোমিটার যেয়ে আমি কুষ্টিয়া নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিই। পরদিন সকাল ৬টার দিকে আমি ময়মনসিংহ জেলার উদ্দেশ্যে রওনা হই। পথিমধ্যে হাবিলদার আব্দুল আজিজসহ সঙ্গীয় পুলিশ সদস্য চিত্তরঞ্জন সরকার, পরেশ কান্তি সাহা, আবুল কালাম, রঞ্জন আরো কয়েকজন একসঙ্গে ময়মনসিংহ জেলার উদ্দেশ্যে পাহাড়ী পথ দিয়ে পুলিশ লাইনে পৌছাই। পুলিশ লাইনে পৌছানোর পর সেখানে জনশূন্য দেখতে পাই। এ সময় ময়মনসিংহ শহরের পাশে শম্ভগঞ্জে বিকট আওয়াজে বোমা বর্ষণ চলতে থাকে। তখন আমি চিত্তরঞ্জন সরকার, দিপক কুমার বিশ্বাস, দিলীপ কুমার ঘোষ, শরিফুল ইসলাম, আনোয়ার হোসেন, পবিত্র কুমারসহ আরো কয়েকজন এক সঙ্গে জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালার ব্রহ্মপুত্র নদের ঘাট নৌকাযোগে পাড় হয়ে পায়ে হেঁটে গ্রামের ভিতর দিয়ে হালুয়াঘাট থানার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। হালুয়াঘাট থানায় কয়েকদিন অবস্থান করে হালুয়াঘাট বাগমারা বর্ডার দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি। তারপর ঢালু থানার(বারেঙ্গাপাড়া) পুলিশ আমাদেরকে থানায় নিয়ে যায় এবং আমাদের কাছে বিস্তারিত ঘটনা জানতে চায় এবং থানায় ঘটনাগুলি জিডিতে লিপিবদ্ধ করে। এরপর ঢালু হাইস্কুলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। ক্যাম্প থেকে ময়মনসিংহের (বর্তমান শেরপুর) নালিতাবাড়ীর হলদীগ্রাম, বাতকুচি বারমারি, শ্রীবদ্দি থানার তাওয়াকুচা, নকসি, ভায়াডাঙ্গা, ধনিয়া কামালপুর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। এরপর আমাদের তিনটি ভাগে ভাগ করে আমাকে ও বিডিআর সদস্য দুইজন এবং পুলিশের আরো ৮জন এবং ১০জন অন্যান্য লোক মোট একুশ জনের গ্র“প করে আমাকেসহ তুরা জেলা হয়ে গোহাটি ও শিলং শহরের ভিতর দিয়ে সিলেট ৫নং সেক্টরে পুলিশের গাড়ীতে করে পৌছাইয়া দেয়। প্রথমে ডাউকি শহরে, পরে সংগ্রামপুর বাংলাদেশের তামাবিল জাফলং এর বিডিআর ক্যাম্পে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করি। প্রায় ১৫দিন পর আমি অসুস্থ্য হয়ে পড়লে আমাকে ডাউকি হাসপাতালে ও পরে শিলং চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়। শিলং থেকে সুস্থ্য হয়ে গোহাটি কাটোয়া শিলিগুড়ি হয়ে পশ্চিম বাংলায় পৌছাই। তারপর বাংলাদেশ মিশন কলিকাতার পাক সার্কাসে রিপোর্ট করি। তখন পাক সার্কাসের মিশনের দায়িত্বে ছিলেন আইজিপি খালেক আহম্মদ ও ডিআইজি এস.কে চৌধুরী। সেখান থেকে আমাকে একটি আইডি কার্ড দেওয়া হয়। যা মুজিবনগরের ইস্যুকৃত। যার নম্বর-১০০৪, তারিখ-২৪/১২/১৯৭১।
প্রণব বন্ধু চৌধুরী আরো বলেন, ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পর আমি দেশে ফিরে আসি ও ১৯৭২সালের ৯ই জানুয়ারী পুনরায় ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ লাইনে চাকুরীতে যোগদান করি। পরবর্তীতে ২০০৭ সালের ১০জুন তারিখে গাজীপুর জেলা হতে ইন্সপেক্টর পদে অবসর গ্রহণ করি।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার যুদ্ধে দেশের জন্য জীবন বাজী রেখে শক্রদের মোকাবেলা করেছি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাইনি। অথচ বাংলাদেশ পুলিশ হেড কোয়ার্টার্স থেকে প্রকাশিত “মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা” শীর্ষক বইতেও মুক্তিযুদ্ধ চলকালীন পুলিশ সদস্যদের অনুপস্থিতিদের নামের তালিকায় তার নাম রয়েছে। এমনকি রাজবাড়ী জেলা পুলিশের উদ্যোগে “মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা” শীর্ষক বইতেও দুইজন মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে তার অবদানের কথা স্মৃতি চারণ করেছেন।
তিনি বলেন, বিএনপি সরকার আমলে ১৯৯০ সালে প্রথম তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসলে ২০১৪ সালে তিনি আবারো মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে গেজেটভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেন। সেই আবেদনটি জামুকাতে প্রেরণ করেন মন্ত্রণালয়। কিন্তু এরপরও তিনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি। এ ব্যাপারে তিনি প্রধানমন্ত্রীর শুদৃষ্টি কামনা করেন।
এ ব্যাপারে অবসরপ্রাপ্ত(আর.আই) মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল আজিজ বলেন, প্রণব বন্ধু চৌধুরী তার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে এবং বড় বড় অপারেশন করেছেন। সে মুক্তিযোদ্ধা সনদ পায়নি। এটা খুবই দুঃখজনক। সনদ পাওয়া তার প্রাপ্ত।
১১নং সেক্টরের সাবসেক্টর কমান্ডার কে.এম শামসুল আলম বলেন, প্রণব বন্ধু চৌধুরী ২৫শে মার্চ হতে ১৭ই এপ্রিল পর্যন্ত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের সাথে মধুপুর গড়ে ও কালিহাতিতে সম্মুখ যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্ত রঞ্জন সরকার বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ সদস্য প্রণব বন্ধু চৌধুরী তার সাথে সাহসীকতার সাথে যুদ্ধ করেছেন।