॥আসহাবুল ইয়ামিন রয়েন॥ রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গতকাল ৮ই সেপ্টেম্বর সকাল ১০টায় জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সভা জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলীর সভাপতিত্বে কালেক্টরেটের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ রহিম বক্স, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার(ক্রাইম) মোঃ আছাদুজ্জামান, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডঃ এম.এ খালেক, বালিয়াকান্দি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ, গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবিএম নুরুল ইসলাম, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই’র উপ-পরিচালক মোঃ জিল্লুর রহমান, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ মাজিনুর রহমান, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সৈয়দা নুরমহল আশরাফী, বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার এইচ.এম রাকিব হায়দার, গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ হাসান হাবিব, মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের রাজবাড়ী সার্কেলের সহকারী পরিচালক রাজিব মিনা, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হেদায়েত আলী সোহ্রাব ও জেলা জাসদের(আম্বিয়া) আহ্বায়ক স্বপন কুমার দাস প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভায় পূর্বের সভার কার্য বিবরণী পাঠ করেন ও সভা পরিচালনায় সভাপতিকে সহযোগিতা করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ আব্দুর রহমান।
এ সময় এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী খান এ শামীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোঃ আব্দুল হামিদ খান, জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রুবাইয়াত মোঃ ফেরদৌস, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা নূরে সফুরা ফেরদৌস, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার সৈয়দ সিদ্দিকুর রহমান, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ তৌহিদুল ইসলাম এবং বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী বিভাগের কর্মকর্তাগণসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী বলেন, আপনারা সকলেই অবগত আছেন জাতীয় মাছ ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকার ইলিশের প্রজনন মৌসুম হওয়ায় গত ১লা অক্টোবর থেকে আগামী ২২শে অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে ইলিশ ধরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। যার আলোকে জেলার মৎস্যজীবী, জনপ্রতিনিধিসহ নদীর তীরবর্তী এলাকায় ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। এতো কিছু করার পরও বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, সরকারের এই নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কটিয়ে জেলেসহ অনেকে লোভের বশবর্তী হয়ে নদী থেকে মা ইলিশ শিকার করছে এবং নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন বাড়ীতে, মাঠে, আঁখের ক্ষেতসহ বিভিন্ন জায়গায় গোপনে মাটির নীচে ইলিশ মাছ রেখে অল্প অল্প করে বিক্রি করছে। আবার অনেক মানুষ যারা নিজেদেরকে সমাজের সচেতন মানুষ বলে দাবী করে তারা খুব সকালে বা দিনের বিভিন্ন সময়ে সেই মাছ ক্রয় করে ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণ করছে, যা মোটেও কাম্য হতে পারে না। গোপন সংবাদ থেকে জানাযায়, ইলিশ মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময়ের আগেই অনেক অপেশাদার জেলে এই সময়ে ইলিশ মাছ ধরার জন্য গোপনে ছোট ছোট নৌকা তৈরী করেছে। বিভিন্ন সুত্র মতে, বর্তমানে নদীতে যে পরিমাণে হাজার হাজার জেলে মাছ ধরছে তার তুলনায় আমরা মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মাত্র ৫শত জনকে ধরতে পেরেছি। এ ক্ষেত্রে ১০ শতাংশের বেশী সাফল্য আসেনি। আমি নিজে গতকাল ৭ই অক্টোবর নদীতে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে বাস্তব চিত্র দেখেছি। এক পাশ দিয়ে মোবাইল কোর্ট ধাওয়া দিলে তারা পালিয়ে যাচ্ছে, কিছুক্ষণ পর যেই মোবাইল কোর্ট অন্য পাশে যাচ্ছে তারা আবার মাছ ধরছে। আমি নদীতে অভিযানের সময় জেলেদের নৌকা ধাওয়া করলে একটি সরু ছোট নৌকা আমার কেবিন বোটকে আঘাত করেছে, যাতে আমি ও আমার সঙ্গে থাকা অফিসারগণ অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পেয়েছি। ওই নৌকার আঘাতে কেবিন বোটের ২টি ইঞ্জিনই নষ্ট করে দেড় লক্ষ টাকার ক্ষতি করতেও তারা পিছপা হয়নি। শুধু সেটাই নয়, পোশাক পরিহিত পুলিশ বাহিনীর টিমকেও তারা ডাকাত ডাকাত বলে আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। যা নিঃসন্দেহে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে ও সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে। আমি জেলা প্রশাসক হিসেবে কোন অবস্থাতেই এ বিষয়ে ছাড় দিতে পারি না। এখন থেকে নদীতে চুরি করে মাছ শিকারীদের বিরুদ্ধে আরো কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। এই সময়ে যারা মাছ শিকার করতে যেয়ে মোবাইল কোর্টের হাতে ধরা পড়বে তাদের আর কোন জরিমানা করা হবে না, সরাসরি জেল দেওয়াসহ তাদের নৌকা বাজেয়াপ্ত করা হবে।
তিনি আরো বলেন গোপন সুত্রের ভিত্তিতে জানাযায়, এই কার্যক্রমের সাথে কিছু অসৎ লোক যারা মোবাইল কোর্টের সাথে সংশ্লিষ্ট তারা কিছু কিছু এলাকায় জেলেদের সাথে বিভিন্ন গোপন আঁতাতের মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা নিয়ে মোবাইল কোর্ট বা অভিযান পরিচালনার আগেই মোবাইলের মাধ্যমে জেলেদের সতর্ক করছে। এতে অনেক জেলে ধরা পড়ছে না। এই সকল আঁতাতকারীদের ব্যাপারে বিভিন্নভাবে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
তিনি জনপ্রতিনিধি, সমাজের সচেতন ব্যক্তিসহ সকলকে মা ইলিশ রক্ষায় একসাথে কাজ করার আহবান জানান। এছাড়াও যারা এর সাথে জড়িত তাদের বিষয়ে কোন তথ্য থাকলে তিনি তাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করেন। প্রয়োজনে দিনে-রাতে যে কোন সময় নিজে উপস্থিত থেকে অভিযান পরিচালনা করবেন বলে উল্লেখ করেন।
তিনি জেলে সম্প্রদায়সহ যারা অতি উৎসাহী হয়ে মাছ ধরছেন তাদেরকে এই নিষিদ্ধকালীন সময়ে নদীতে আর মাছ না ধরার আহবান জানান। যদি এরপরও কেউ না মানে তবে নদীতে যাকে পাওয়া যাবে তাকে জেলসহ তার নৌকা বাজেয়াপ্ত করা হবে বলে তিনি কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করেন।
জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী আরো বলেন, বালিয়াকান্দিতে গড়াই নদী থেকে অবৈধভাবে উত্তোলন করা যে বালুর পাহাড় ছিল তা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের তথ্য মতে তিনি ও উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রচেষ্টায় সেটি সরানো ও যে স্তুপ সরানো হয়নি সেগুলো বাজেয়াপ্ত করে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। জনস্বার্থে এই কাজ করার জন্য আমি বালিয়াকান্দি উপজেলা চেয়ারম্যান ও নির্বাহী অফিসারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সদর উপজেলার ধাওয়াপাড়ায় পদ্মা নদীতে ইলিশ শিকারী জেলেদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে ঐ এলাকায় নদীর পাড়ে ২০টির বেশী বালুর পাহাড় দেখেছি। এই বিশাল বালুর পাহাড়ের লোডে নিঃসন্দেহে যে কোন সময় নদীর পাড় ভয়াবহ ভাঙ্গনের সম্মুখীন হতে পারে। পূর্বের সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে এই বালুর পাহাড় সরানোর জন্য সংশ্লিষ্টদের বলাসহ প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে বালু পাহাড় বাজেয়াপ্ত করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সেই মোতাবেক সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার বালুর পাহাড়ের সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এক মাস সময় দিয়েছিলেন। এর মধ্যে তারা যদি বালু না সরিয়ে নেয় তবে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে উক্ত বালুর পাহাড় বাজেয়াপ্ত করাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
তিনি বলেন, জেলায় বর্তমানে মাদক নিয়ন্ত্রণে রেল পুলিশ ছাড়া সকল বিভাগ ভালো কাজ করছে। তবে এলিট ফোর্স হিসেবে তিনি র্যাবকে মাদক নিয়ন্ত্রণে আরো বেশী কাজ করার আহবান জানান। রেল পুলিশ কর্তৃক জেলা প্রশাসনে প্রেরিত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তারা শুধু এক পুরিয়া হেরোইন ছাড়া আর কিছু ধরতে পারে না। বিষয়টি কোনভাবেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও কুষ্টিয়া এই তিনটি জেলার বর্ডার এলাকার সাথে রেলের সরাসরি যোগাযোগ আছে। এই সকল জেলা থেকে রেলে প্রতিনিয়ত মাদক আসছে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে রেল পুলিশ সেটা ধরতে পাড়ছে না। প্রয়োজনে রেলে মাদক ধরতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হবে। পাশাপাশি রেল পুলিশকে এ বিষয়ে আরো সতর্ক হয়ে অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে মাদক নিয়ন্ত্রণে আন্তরিক হয়ে কাজ করতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
দেশের বর্তমান রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনায় জেলা প্রশাসক বলেন, মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের সেনা বাহিনীর নিপীড়নের কারণে আজকে আমাদের দেশে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা(মিয়ানমার নাগরিক) আশ্রয় নিয়েছে। মানবিক কারণে সরকার তাদেরকে কক্সবাজার জেলার উখিয়াসহ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় প্রদান করেছে। কিন্তু এসব আশ্রয় কেন্দ্র থেকে অনেক রোহিঙ্গা দেশেরে বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। কিছুদিন আগে মানিকগঞ্জ ও যশোর জেলা থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গাকে উদ্ধার করে আশ্রয় কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। যদি মানিকগঞ্জ ও যশোর থেকে রোহিঙ্গা পাওয়া যায় তাহলে তারা যে আমাদের জেলায় আসেনি বা আসবে না সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে না। আবার আমাদের জেলায় দেশের বৃহৎ পতিতালয় রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দালালদের খপ্পড়ে পড়ে রোহিঙ্গা নারীরা পতিতালয়ে বিক্রি হতে পারে। এ প্রেক্ষিতে আমাদের সকলকে এই রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যদি জেলায় রোহিঙ্গাদের আসা বা তাদের নারীদের দালালদের মাধ্যমে পতিতালয়ে আনার কোন তথ্য থাকে তাহলে তা জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, জেলা পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের(আশ্রিত মিয়ানমার নাগরিক) ব্যাপারে সচেতন থাকার জন্য সকলের প্রতি আহবান জানান।
তিনি রাজবাড়ীবাসীর জন্য একটি সুখবর দিয়ে বলেন, রাজবাড়ীতে যে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র বা গ্রীড স্টেশন নির্মাণ করা হবে তার প্রকল্প কর্মকর্তার তথ্য মতে এই গ্রীড স্টেশন নির্মাণে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করবে জার্মানীর বিশ্বখ্যাত কোম্পানী সিমেন্স, যাতে কাজের মান নিঃসন্দেহে অনেক ভালো হবে।
এছাড়াও সভায় জেলার আইন-শৃঙ্খলার বিভিন্ন বিষয়, মাদক, সন্ত্রাস, ইভটিজিং, নারী-নির্যাতন, রোহিঙ্গা ইস্যু ও বাল্য বিবাহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়।
সভায় জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হেদায়েত আলী সোহরাব বর্তমানে দেশের চালের বাজারে দামের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্য যে সিন্ডিকেট কারসাজি করে দাম বাড়িয়েছে তার জন্য খাদ্য মন্ত্রীর দুরদর্শীতার অভাব ও খাদ্য অধিদপ্তরের উর্ধ্বতন কর্মকর্তার কারসাজিকে দায়ী করেন।
সভায় গাজীপুরের সহকারী কমিশনার(ভূমি) মোঃ মাছুদ রেজা বালিয়াকান্দি উপজেলার নতুন উপজেলা নির্বাহী অফিসার হিসেবে যোগদান উপলক্ষে জেলা প্রশাসক তাকে উপস্থিত সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।