॥স্টাফ রিপোর্টার॥ করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দেশব্যাপী চলমান কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ১৬ই এপ্রিল সকালে তাঁর সরকারী বাসভবন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ঢাকা বিভাগের বিভাগের নয়টি জেলার প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সিভিল সার্জনসহ চিকিৎসক, সশস্ত্র বাহিনী এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করেন।
ভিডিও কনফারেন্সে রাজবাড়ী ছাড়াও ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জ জেলা সংযুক্ত ছিল।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত থেকে সঞ্চালনা করেন। এতে কথা বলার সুযোগ পান জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম, পৌরসভা মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী।
শুরুতে জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সারা দেশের ন্যায় রাজবাড়ী জেলায় করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে রাজবাড়ী জেলায় ৬জন করোনায় আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন রয়েছে। এই ৬জন রোগী ছাড়া আরো বাকী ১জন রোগী ইতিমধ্যে করোনা ভাইরাস মুক্ত হয়ে বাড়ী ফিরেছেন। বর্তমানে জেলায় সরকারী ও বেসরকারী ৪৭টি আইসোলোশন শয্যা নির্ধারণ করেছি। ভবিষ্যতে যদি করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বৃদ্ধি পায় সেই চিন্তাকে মাথায় রেখে কালুখালী উপজেলার ৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালকে শুধু করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। এই হাসপাতালে পর্যাপ্ত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য কর্মীসহ লোকবল বয়েছে। যার কারণে এখানে করোনা রোগীদের কোন প্রকার অসুবিধা হবেনা।
তিনি আরো বলেন, রাজবাড়ী জেলা দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের ২১টি জেলার প্রবেশদ্বার হওয়াসহ করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার কারণে ইতিমধ্যে জেলাকে ১০ দিনের জন্য লকডাউন করা হয়েছে। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে ফেরী চলাচলও বন্ধ করা হয়েছে। আর এই লকডাউনের মধ্যে জেলার সাধারণ মানুষ যাতে কষ্ট না পায় সে জন্য আপনার নির্দেশনা মোতাবেক জেলায় পর্যাপ্ত ত্রাণ মুজদ আছে। রাজবাড়ী জেলা যেহেতু ২১টি জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে দৌলতদিয়া ফেরী ঘাট এলাকায় অনেক শ্রমিক আছে যারা বেকার হয়ে পড়েছে। এই সমস্ত ১২০০ শ্রমিকের তালিকা করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ করছি। পর্যায়ক্রমে আরো বেশী বিতরণ করা হবে। এছাড়া দৌলতদিয়ায় একটি বিশেষায়িত এলাকা(যৌনপল্লী আছে) আছে সেখানে স্বাস্থ্য ঝুঁকি থাকার কারণে জেলা পুলিশের মাধ্যমে মার্চের ২০ তারিখ থেকে সে এলাকায় জনগণের প্রবেশকে বারিত করা হয়েছে এবং যেখানকার অধিবাসী ১৩০০ লোকের ত্রাণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়াও জেলার প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়নে সরকারী/বেসরকারী ভাবে ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে। রাজবাড়ী জেলা যেহেতু একটি কৃষি প্রধান জেলা। পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য় ও পর্যাপ্ত পাট উৎপন্ন হয় এই জেলায়, সেহেতু এই জেলাতে কৃষি পণ্য যাতে কৃষকরা ঠিক মত উঠাতে পারে সে জন্য আগামী ১মাস পরে অন্য জেলা থেকে আমাদের কিছু শ্রমিক আনার ব্যবস্থা করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আপনার দিক নির্দেশনা মোতাবেক আমরা আশা করি আগামীতে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলা করে রাজবাড়ী জেলা তথা দেশের উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারবো।
রাজবাড়ী পৌরসভা মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী বলেন, আমরা সকলে মিলে এই করোনা মহামারী থেকে বের হওয়ার জন্য আপনার দিক নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করছি। পৌরসভার মেয়র হিসেবে আমি পৌর এলাকায় মাইকিং করা, রাস্তায় ব্লিচিং পাউডার ছিটানো পৌরসভার স্বাস্থ্য কর্মীসহ যারা জরুরী সেবায় নিয়োজিত তাদের জন্য সুরক্ষা সামগ্রীর ব্যবস্থা করেছি। আর পৌরসভার মধ্যে যারা দুস্থ ও অসহায় আছে তাদের জন্য জেলা প্রশাসক যে ৩৫ টন চাল দিয়েছেন, সেগুলি বিতরণের ব্যবস্থা করছি বলে উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও তিনি জেলায় দরিদ্র মানুষের জন্য বেশী পরিমাণ ত্রাণ বরাদ্দের জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি দাবী জানান।
এছাড়া তিনি তার বক্তব্যে, সারা বাংলাদেশের সকল পৌরসভার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানান।
রাজবাড়ী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার ১৯৬৭ সালের ১৬ই এপ্রিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কারাগারের চিঠির কিছু অংশ উল্লেখ করে বলেন, রাজবাড়ী জেলাতে কয়েকজন করোনা রোগী ধরা পড়লেও সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অবস্থা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইতিমধ্যে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণের জন্য ২০ লক্ষ টাকার অনুমোদন পেয়েছি। যা জেলা পরিষদের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করে ত্রাণ বিতরণ করা হবে। এছাড়া আমি নিজে উপস্থিত থেকে রাজবাড়ী জেলার উপজেলা পর্যায়ে জীবানু নাশক স্প্রে করাসহ লিফলেট বিতরণ করছি। সর্বোপরি আমরা সকলে মিলে রাজবাড়ী জেলায় করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কাজ করছি।
রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বলেন, রাজবাড়ী জেলায় করোনা আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হওয়ার কারণে বর্তমানে এই জেলা খুব ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তবে আপনার সঠিক দিক নির্দেশনার কারণে ও সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টার কারণে আমরা ঝুকি অনেকটা কমিয়ে আনতে পেরেছি। রাজবাড়ীতে জেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ব্যাপকভাবে মুজিববর্ষের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে আপনার নির্দেশনায় ১৭ই মার্চ স্বল্প পরিসবে মুজিবর্ষের আয়োজন সম্পন্ন করি। এরপর থেকে চলছে করোনার বিরুদ্ধে আমাদের অবিরাম যুদ্ধ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জনসাধারণ উদ্বুদ্ধ করতে আমরা টানা ২২দিন জেলাব্যাপী মাইকিং পরিচালনা করেছি এবং কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আদলে ১লক্ষ লিফলেট ছাপিয়ে আমরা বিতরণ করেছি। তিনি বলেন, কোন মানুষ অভূক্ত না থাকে সেজন্য রাজবাড়ী জেলার অসহায় ও কর্মহীন মানুষের তালিকা প্রস্তুত করে দলীয় নেতাকর্মীকে কাজে লাগিয়ে আমি রাজবাড়ী সদর ও গোয়ালন্দ উপজেলার ১২ হাজার অসহায় মানুষের মাঝে খাদ্য সহায়তা পৌছে দিয়েছি। আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগে জুট মিলের সহস্রাধিক শ্রমিকের মধ্যে ১মাসের খাদ্য সহায়তা প্রদান করেছি। মধ্যবিত্তরা যাতে খাদ্য কষ্টে না থাকে সেজন্য গোপনীয়তা রক্ষা করে রাতে অনেককে খাদ্য সহায়তা পৌছে দিচ্ছি। এ জন্য একটি হটলাইন নম্বর আমরা চালু করেছি।
তিনি আরো বলেন, জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি ও রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য মোঃ জিল্লুল হাকিম পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী এলাকায় খাদ্য সহায়তা প্রদান করছেন। জনসাধারণের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে ৩টি ভ্রাম্যমান মেডিক্যাল টিম গঠন করেছেন।
তিনি বলেন, রাজবাড়ী জেলায় ১০দিনের লকডাউন চলছে। এরমধ্যে জনসাধারণ যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে কাঁচা বাজারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারে সেজন্য অস্থায়ী ভাবে বাজার তৈরী করা হচ্ছে। সরকারী সহায়তা ও প্রশাসনিক উদ্যোগের পাশাপাশি আমরা সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সাথে নিঃস্ব মানুষকে সবধরণের সহায়তা অব্যাহত রেখেছি। দেশের এই সংকটকালে তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের কার্যক্রমের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে স্থাপিত আইসোলেশন ইউনিট চালু হয়েছে কিন্তু পূর্ণাঙ্গ চিকিৎসা নিয়ে শংকায় আছি। আমরা বিশ্বাস করি মহান আল্লাহতায়ালার উপর ভরসা রেখে আপনি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন আমরা স্বল্প সময়ে এই সংকট উত্তোরন করতে পারবো ইনশাআল্লাহ। মহান আল্লাহতায়ালার কাছে আপনার দীর্ঘায়ু জীবন কামনা করে শেষ করছি।
ভিডিও কনফারেন্সে রাজবাড়ীর পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান,পিপিএম(বার), সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ নুরুল ইসলাম, সেনা বাহিনীর প্রতিনিধি যশোর সেনানিবাসের ১০ ইষ্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর মীর্জা ইমরান হোসেন ও সদর হাসপাতালের তত্ত্বধায়কসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।