মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২৫ অপরাহ্ন
Logo
সংবাদ শিরোনাম ::
বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আইসোলেশন মেয়াদ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টা ও বিটার তুলনায় তিন গুণের বেশী পুনঃ সংক্রমন ঘটাতে পারে : গবেষণা প্রতিবেদন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে এক বন্দুকধারী গ্রেফতার শান্তি চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে কলম্বিয়া সফর জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণের সাক্ষাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়ায় লকডাউন করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতে নতুন করে ১০ হাজার ৩০২ জন করোনায় আক্রান্ত নভেম্বর মাসজুড়ে করাঞ্চলে কর মেলার সেবা পাবেন করদাতারা ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারী কার্যবিধি যুগোপযোগী হচ্ছে

সেই ইমাম বিবিসি বাংলাকে বললেন ভবিষ্যতে আর কোন যৌনকর্মীর জানাজা পড়ানোর নিয়ত নাই

  • আপডেট সময় বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

॥তাফসীর বাবু, বিবিসি বাংলা॥ প্রথা ভেঙে দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর এক যৌনকর্মীর প্রথম জানাযার নামাজ পড়ানো সেই ইমাম সামাজিক চাপের মুখে ভবিষ্যতে আর কোন যৌনকর্মীর জানাযা না পড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন।
চলতি মাসের গোড়ার দিকে দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর মৃত এক যৌনকর্মীর জানাযার নামাজ পড়িয়ে আলোচনায় এসেছিলেন যে ইমাম, এখন তিনি বলছেন-ভবিষ্যতে আর কখনও কোন যৌনকর্মীর জানাযার নামাজ পড়াবেন না।
দৌলতদিয়া ঘাট রেলস্টেশন জামে মসজিদের ইমাম গোলাম মোস্তফা বলেছেন, হামিদা বেগম নামে ওই যৌনকর্মীর জানাযার নামাজ পড়ানোর পর তিনি স্থানীয়ভাবে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন। যদিও যৌনকর্মীদের জানাজা বা দাফনের ব্যাপারে কোন ধর্মীয় বিধি-নিষেধ আছে কি না, তেমন কিছু উল্লেখ করছেন না ইমাম গোলাম মোস্তফা, কিন্তু তিনি বলছেন, তিনি এই জানাযার নামাজ পড়াতে রাজী ছিলেন না, স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তাদের অনুরোধে তিনি পড়িয়েছিলেন।
তিনি বলছেন, ‘এইখানে তো সমালোচনা হচ্ছে। গ্রামের লোক, দোকানদার সবাই আমার সমালোচনা করছে। এতো দিন জানাযা হয় নাই, আমি কেন হঠাৎ করে জানাযা পড়াইলাম? তাই ভবিষ্যতে আর জানাযা পড়ানোর নিয়ত নাই। বিভিন্ন আলেমের সঙ্গেও কথা বলেছি। তারাও নিষেধ করেছে। পতিতাপল্লীর লোকেরা অন্য কাউকে নিয়ে জানাযা, দাফন করাইতে পারে কিন্তু আমাকে পাবে না।’
প্রথা ভেঙে যৌনকর্মীর জানাযা এবং ধর্মীয় রীতিতে দাফনের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর ঘটনাটি পতিতাপল্লীর বাসিন্দাদের জীবনে কী প্রভাব ফেলেছে তা দেখতে গিয়ে জানা যায়, ইমাম গোলাম মোস্তফা সামাজিকভাবে নিগৃহীত হচ্ছেন। বাংলাদেশে যৌন পেশা বৈধ হলেও এই পেশাজীবীদের খারাপ চোখে দেখা হয়। সমাজ থেকে তারা একরকম বিচ্ছিন্নও থাকেন। নানাভাবে বঞ্চনার শিকার হন। দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে একজন যৌনকর্মীর জানাযার ঘটনা তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে সাহায্য করবে মনে করা হলেও এখন আর তেমনটা মনে হচ্ছে না।
পঁচিশ বছর ধরে দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীতে আছেন রানু বেগম(ছদ্মনাম)। এই পল্লীতেই জন্ম দিয়েছেন একে একে ৪টি সন্তানের। দীর্ঘ জীবনের হিসাব মিলিয়ে প্রাপ্তির খাতায় বঞ্চনা আর অপমান ছাড়া কোন কিছুই দেখেন না তিনি। তিনি বলছিলেন, ‘এই জগৎটা তো দেখা হয়ে গেছে আমার। কিছুই নাই। শুধু অপমান। এখনো যদি আমরা রাস্তায় বা গ্রামের দিকে যাই, মানুষে কয় যে ঐতো অমুক জায়গা থিকা অমুক মানুষ আইছে। আমাগো দেখলে দরজা আটকায়া দেয়। বাড়ীর উপর দিয়ে গেলে বলে এখান দিয়ে যাইবা না। অন্য রাস্তা দিয়া ঘুইরা যাও। আমরা এইসব কথা শুইনাও না শুনার মতোন কইরাই থাকি।’ তিনি জানালেন, আগে গ্রামবাসী নিয়ম করে দিয়েছিল কোন যৌনকর্মী বাইরে বের হলে খালি পায়ে বের হবে। তবে এখন অবশ্য সে নিয়ম আর নেই।
রানু বেগম যে মানবিক মর্যাদার সঙ্কটের কথা বলছেন, এই পল্লীর সকলকেই সেই সঙ্কটের মুখোমুখি হতে হয় কোন না কোনভাবে। ফলে এই পেশার সঙ্গে জড়িতরা সবসময়ই চেষ্টা করেন নিজেদের বাইরের জগৎ থেকে আড়াল করে রাখতে। এমনকি বাইরের কোন হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলেও নিজেদের প্রকৃত নাম-পরিচয় গোপন রাখেন।
৬ মাস আগে অপারেশনের মাধ্যমে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছেন বৃষ্টি আক্তার(ছদ্মনাম)। তিনি বলছেন, চিকিৎসা নেয়ার সময়ও নিজে থেকেই পরিচয় গোপন রেখেছিলেন। “আমি ঠিকানা দিছি দৌলতদিয়া কিন্তু আমাদের পল্লী ঠিকানা হইলো পূর্ব পাড়া। আমার নামও দিছি অন্য। আসল পরিচয় যদি আমি দেই তাহলে তারা তো জানবে আমি কে। আমাকে তখন খারাপ জানবে। আর খারাপ জানলে তো খারাপভাবেই দেখবে।
দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীরা শুরু থেকেই ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হলেও তেমন কোন নাগরিক সুবিধা নেই তাদের। বয়স হয়ে গেলে নিদারুণ সমস্যায় পড়তে হয় তাদের অধিকাংশকেই। কিন্তু এসব কিছু ছাপিয়ে মৃত্যুর পরও ধর্মীয়ভাবে দাফন-কাফনের অধিকার না পাওয়ার হতাশা দীর্ঘদিন ধরেই প্রকাশ করে এসেছেন তারা। তবে বছরের পর বছর না হলেও হামিদা বেগমের জানাজা ও দাফন ধর্মীয় রীতি মেনে সম্পন্ন হলে, যৌনকর্মীদের মধ্যে তো বটেই আলোড়ন তোলে পতিতাপল্লীর বাইরেও।
বাংলাদেশে যৌন পেশাকে সামাজিকভাবে খারাপ চোখে দেখা হলেও হামিদা বেগমের ছেলে বলছেন, তারা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে আটকে থাকতে চাননি। ‘আমার মা যেখানেই থাকুক, যে কাজই করুক, তার একটা পরিচয় আছে যে সে মানুষ। আমরাও মানুষ, আমরাও মুসলমান। আমরা চাইছিলাম মৃত্যুর সময়টাতে যেন অন্তত সে মানুষ হিসেবে সম্মান পায়। সেই জন্যই আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন করছিলাম।’
এটা নিয়ে যৌনকর্মীদের মধ্যে উচ্ছ্বাস দেখা গেলেও ধর্মীয় কারণ দেখিয়ে বাইরে এর সমালোচনাও হচ্ছে প্রচুর। যদিও এর কোন যৌক্তিকতা খুঁজে পান না যৌনকর্মীদের একজন নেত্রী।
তিনি বলছিলেন, এদেশের সমাজ পাপের বোঝা শুধু যৌনকর্মীদের উপরই চাপাতে চায়। তিনি বলছেন, ‘পাপতো এখানকার মেয়েরা একলা করতেছে না। তারা করতেছে পেটের দায়ে, ক্ষিদার চাহিদা মেটানোর জন্য। আর আপনি আসতেছেন আপনার মনোরঞ্জন করার জন্যে। তাহলে পাপটা কার হইতেছে? এইখানে যৌনপল্লীতে ধর্মের বিধান ভাইঙ্গা আসে কারা? আপনারা। তাইলে আপনাদের যদি সমাজে মাটি হয়, তাইলে আমাদের হবে না কেন?
দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীরা আশাবাদী যে, হামিদা বেগমের জানাযার পর সেটা হয়তো যৌনকর্মীদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে কাজে দেবে। কিন্তু বাস্তবে পল্লীর বাইরে খোঁজ নিতেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এর উল্টো মনোভাবই দেখা গেলো। পতিতাপল্লীর পাশেই দৌলতদিয়া রেল স্টেশন। সেখানেই স্টেশন মসজিদের কাছে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। এর মধ্যে হামিদুল ইসলাম নামে একজন জানালেন, যৌনকর্মীর পেশাটাই যেখানে ধর্ম সমর্থন করে না সেখানে সারাজীবন সেই পেশায় থেকে শেষ সময়ে ধর্মের দরকার কী? তিনি বলছেন, ‘ঐখানে তো অন্য মানুষজন থাকে। ঐটা তো আলাদা জায়গা। পতিতালয়। সেইখানে ধর্মীয়ভাবে জানাযা হয় কীভাবে? মনির হোসেন নামে আরেকজন বেশ ক্ষিপ্ত। তার ক্ষোভ ইমাম সাহেব কেন জানাজা পড়ালেন সেটা নিয়ে।
তিনি বলছেন, ‘হুজুর তো আগে আমাদের সমাজ থেকেই মত গঠন করবে। জানাযায় নেয়া যাবে কি-না, সেইটা তো গ্রামের লোক বসে পদ্ধতি ঠিক করবে। তারপরে সে আমাদের মর্জি নিয়ে সেখানে যাবে। তাকে তো ইমামের দায়িত্বে রাখছি আমরা। সে একা একাই কেন গেলো? এবার বোঝা গেল ইমাম গোলাম মোস্তফা কোন পরিস্থিতিতে ভবিষ্যতে আর কখনো কোন যৌনকর্মীর জানাযা না পড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুত্র ঃ বিবিসি’র নিউজ বাংলার অনলাইনে গতকাল ১৮ই ফেব্রুয়ারী প্রকাশিত।

নিউজটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
error: আপনি নিউজ চুরি করছেন, চুরি করতে পারবেন না !!!!!!