॥স্টাফ রিপোর্টার॥ রাজবাড়ী শহরের ঐতিহ্যবাহী ইয়াছিন উচ্চ বিদ্যালয়ের অনেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে লেখাপড়া শেষ করে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে বিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধি করে চলেছে।
এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন মেধাবী ছাত্র শহরের বিনোদপুরের সাগর হোসেন। সে দিনের বেলায় পড়াশোনা এবং রাতের বেলায় বাবার সাথে চটপটি বিক্রি করতো। এ বছরই শহরের লক্ষ্মীকোলের পিতৃহারা গরীব মায়ের সন্তান ইয়াকুব হোসেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বালিয়াকান্দি উপজেলার সোনাপুরের অর্ফি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।
গত বছর নদী ভাঙ্গনে নিঃস্ব হওয়া দাদশী ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষকের মেয়ে জেসমিন আরা চান্স পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে রাজবাড়ীতে অন্যের বাড়ীতে লজিং থেকে পড়াশোনা করতো। প্রাইভেট টিউশনির উপার্জন দিয়ে নিজের লেখাপড়ার ব্যয় বহন করতো। গত বছরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে বিনোদপুরের দরিদ্র পরিবারের সন্তান আলাউদ্দিন হোসেন। গাছের চারা বিক্রি করে সে লেখাপড়ার পাশাপাশি পরিবারকে সহযোগিতা করতো।
ইয়াছিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গত বছর কৃতিত্বের সাথে মাস্টার্স শেষ করেছে দাদশী ইউনিয়নের বক্তারপুর গ্রামের সাদ্দাম হোসেন। তার পিতা একজন গরীব ভ্যান চালক। আরেক শিক্ষার্থী চন্দন কুমার পাল কয়েক বছর আগে এসএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স বিভাগে মাস্টার্সে প্রথম শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান অধিকার করে। বর্তমানে সে ময়মনসিংহের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছে। চন্দন কুমার পালের ভাই একই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জীবন কুমার পাল সিলেটের হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করে বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের একটি কলেজে শিক্ষকতা করছে। বিদ্যালয়ের আরেক প্রাক্তন ছাত্র শহরের ধুঞ্চির শহিদুল ইসলাম বর্তমানে সিলেটের হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছে। প্রাক্তন ছাত্র বক্তারপুরের নরেশ পাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স শেষ করে বর্তমানে আমেরিকান পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত রয়েছে।
তাদের মতোই ইয়াছিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে অনেক মেধাবী ছাত্র/ছাত্রী বিগত দিনে দেশের বিভিন্ন নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে কৃতিত্বের সাথে পাস করে নিজেদেরকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন। বিদ্যালয়ের জন্য সুনাম বয়ে আনছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে রেলওয়ের তৎকালীন এসডিও ইয়াছিন সাহেবের উদ্যোগে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইয়াছিন সাহেব পরবর্তীতে রেলওয়ের চিটাগাং ডিভিশনের চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত বিদ্যালয়ে শুধু ছেলেদেরই লেখাপড়ার সুযোগ ছিল। ২০০৩ সাল থেকে সেখানে মেয়েরাও লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ১৫শত। রয়েছেন ৪০ জন অভিজ্ঞ শিক্ষক ও কর্মচারী। রয়েছে একটি ম্যানেজিং কমিটি।
বর্তমানে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সাঈদা খানম এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মোঃ ইকবাল হোসেন।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী। ম্যানেজিং কমিটির কো-অপ্ট সদস্য হিসেবে রয়েছেন জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার। দাতা সদস্য হিসেবে রয়েছেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজবাড়ী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম এবং অভিভাবক সদস্য হিসেবে রয়েছেন গোয়ালন্দের কামরুল ইসলাম সরকারী কলেজের উপাধ্যক্ষ আব্দুল হালিম তালিকদার জাহাঙ্গীর ও বেথুলিয়া মাদ্রাসার প্রভাষক আবুল কালাম প্রমুখ।
বর্তমান ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও অন্যান্য সদস্যবৃন্দ বিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত ও লেখাপড়ার মানোন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। রাজবাড়ী-১ আসনের প্রাক্তন সংসদ সদস্য ও রাজবাড়ী পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আক্কাছ আলী মিয়া দীর্ঘদিন এই বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটিতে ছিলেন। রাজবাড়ী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মরহুম মোহাম্মদ আলী প্রায় ১২ বছর বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে লেখাপড়ার মানোন্নয়ন ও শিক্ষার্থী বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ২০১৩ সাল থেকে বিদ্যালয়টি আধুনিক মডেল স্কুল হিসেবে এবং ২০১৮ সালে অনলাইন কার্যক্রমের আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
রাজবাড়ী জেলার অন্যতম সেরা বেসরকারী এই বিদ্যালয়টিতে রয়েছে শিক্ষক-কর্মচারী ও ছাত্র-ছাত্রীদের ডিজিটাল স্মার্ট হাজিরা কার্ড। অভিভাবকদের মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি/অনুপস্থিতি, ছুটিসহ যে কোন তথ্য জানানো হয়। সিসি ক্যামেরার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি রয়েছে উন্নতমানের শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, যেখানে ছাত্র-ছাত্রীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। রয়েছে ছেলে-মেয়েদের জন্য পৃথক ৩টি মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, নৈতিক শিক্ষার জন্য পৃথক নামাজের জায়গা, মুক্তিযুদ্ধ কর্ণার, বঙ্গবন্ধু কর্ণার, সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, আধুনিক হল রুম (মিলনায়তন), ছেলে-মেয়েদের পৃথক ইনডোর গেমস কক্ষ, আধুনিক যন্ত্রপাতি সমৃদ্ধ বিজ্ঞানাগার, স্বাস্থ্যসম্মত ওয়াশ রুম ও পয়ঃনিষ্কাষণ ব্যবস্থা, ৪০টি কক্ষসহ অত্যাধুনিক অবকাঠামোর ৪টি সংযুক্ত ভবন, সীমানা প্রাচীর, ৩শতাধিক ফুল গাছের মনোরম একটি বাগান। নৈতিক অবক্ষয় থেকে রক্ষা করতে স্কুল ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের মোবাইলে ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা (মেটাল ডিটেক্টরের মাধ্যমে মোবাইল আছে কি না চেক করা হয়) রয়েছে। এছাড়াও বিবাহিতা ছেলে-মেয়েদের বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ দেয়া হয় না।
এ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের মধ্যে রয়েছেন রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী, সাবেক সংসদ সদস্য আলী নেওয়াজ মাহমুদ খৈয়ম, ডাঃ আবুল হোসেন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ এবিএম মঞ্জুরুল আলম দুলালসহ আরো অনেকে। যারা দেশ-বিদেশে মর্যাদার সাথে অধিষ্ঠিত থেকে বিদ্যালয়ের সুনাম বয়ে এনে চলেছেন।
বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও সহযোগিতার মাধ্যমে লেখাপড়ার মানোন্নয়ন, নৈতিক শিক্ষা ও বিদ্যালয়ের সুনাম বৃদ্ধিতে সচেষ্ট রয়েছি। আমাদের যে সমস্ত প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধ্যয়নরত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে সকলের প্রতি আমাদের শুভ কামনা রইলো। তাদের মতো অন্যরাও যাতে এগিয়ে যেতে পারে সেই দোয়া করি। সেই সাথে রাজবাড়ীবাসীর সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি।