বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ১২:৫৫ পূর্বাহ্ন
Logo
সংবাদ শিরোনাম ::
বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আইসোলেশন মেয়াদ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টা ও বিটার তুলনায় তিন গুণের বেশী পুনঃ সংক্রমন ঘটাতে পারে : গবেষণা প্রতিবেদন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে এক বন্দুকধারী গ্রেফতার শান্তি চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে কলম্বিয়া সফর জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণের সাক্ষাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়ায় লকডাউন করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতে নতুন করে ১০ হাজার ৩০২ জন করোনায় আক্রান্ত নভেম্বর মাসজুড়ে করাঞ্চলে কর মেলার সেবা পাবেন করদাতারা ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারী কার্যবিধি যুগোপযোগী হচ্ছে

কমিউনিটি ক্লিনিক ঃ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নির্ভরতার প্রতীক

  • আপডেট সময় সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৯

 সাদেকুর রহমান  বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে আমির হামজাপাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক। সেখানে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন সরকারী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য কর্মীরা। কয়েক বছর আগেও এলাকার লোকজনকে চিকিৎসা সেবা নিতে উপজেলা সদর কিংবা জেলা সদরে যেতে হতো। কমিউনিটি ক্লিনিকের কল্যাণে এখন বাড়ীর পাশেই চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন তারা।
নড়াইলের তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখছে জেলার ৯১টি কমিউনিটি ক্লিনিক। এসব ক্লিনিকে প্রতি মাসে প্রায় ১লাখ মানুষ চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। এসব ক্লিনিকগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে ৩২ প্রকার ওষুধ দেয়া হচ্ছে। নড়াইল সদর উপজেলার বনগ্রামের বাসিন্দা অনিতা বিশ্বাস ও শিপ্রা বিশ্বাস বলেন, ‘আগে আমাদের সামান্য জ্বর হলে হাতুড়ে ডাক্তার বা সদর হাসপাতালে যেতে হতো টাকা ও সময় ব্যয় করে। কমিউনিটি ক্লিনিক থাকায় আমরা এখন সহজেই সেখান থেকে চিকিৎসা সেবা ও ওষুধ পাচ্ছি।’
কেবল বান্দরবান ও নড়াইল নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপন করা কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এভাবেই চিকিৎসা সেবাকে করেছে সহজ ও কার্যকর। তৃণমূলের সব মানুষের দরজা খোলা এসব ক্লিনিকে। ইতিমধ্যেই এসব ক্লিনিক ‘গ্রামীণ হাসপাতাল’ হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গ্রামীণ জনপদে শ্রেণী-বৈষম্যের ঊর্ধ্বে উঠে রোগীদের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো। সেবার মান উত্তরোত্তর বৃদ্ধি ও প্রচার পাওয়ার সুবাদে এখন চিকিৎসা প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। একসময় যেভাবে নাক সিটকানো হতো, সেখানে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো এখন সেবা কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের ইতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরী করেছে। যৌক্তিকভাবেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো হয়ে উঠেছে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নির্ভরতার প্রতীক।
জনমুখী ও আন্তর্জাতিক মহলের প্রশংসা কুড়ানো কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রমটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শীতার ফসল। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যেই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে সূচারুভাবে পরিচালনা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের আগস্ট পর্যন্ত কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো থেকে ৭৭ কোটি ৫৫ লাখ ভিজিটের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণ সেবা গ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে ৩ কোটি ৬৯ লাখ জরুরী ও জটিল রোগীকে উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্রে রেফার করা হয়েছে। প্রতি মাসে গড়ে ১ কোটি ভিজিটের মাধ্যমে কমিউনিটি ক্লিনিকে জনগণ সেবা গ্রহণ করে। প্রতিদিন প্রতি ক্লিনিকে গড়ে ৪০-৪২ জন রোগী সেবা গ্রহণ করে। রোগীদের শতকরা ৮০ ভাগ নারী ও শিশু। সারা দেশে ৩ হাজার ৫৮টি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসব করানো হচ্ছে এবং ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের নভেম্বর পর্যন্ত কোনরকম জটিলতা ছাড়াই ৬৫ হাজার ৯১৯টি স্বাভাবিক প্রসব সম্পন্ন হয়েছে। সব ক্লিনিকে মাসে একবার মহিলা ও শিশুদের টিকা দেওয়া হয় এবং প্রতিবছর প্রায় ২শ’ কোটি টাকার ওষুধ সরবরাহ করা হয়। ‘শেখ হাসিনার অবদান, কমিউনিটি ক্লিনিক বাঁচায় প্রাণ’-শ্লোগানটি আজ সত্যরূপ লাভ করেছে। প্রতিটি ক্লিনিকে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ সরবরাহ করা হয়েছে, যাতে অনলাইনে রিপোর্টিং করা হয়।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে এমোক্সিসিলিন ২৫০, পেনিসিলিন, কট্রিম, প্যারাসিটামল, এন্টাসিড, মেট্রোনিডাজল, জিংক, নিয়োমাইসিন অয়নমেন্ট, জেনসন ভায়োলেন্ট, ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, আয়রন ট্যাবলেট, খাবার স্যালাইনসহ ২৯ প্রকার ওষুধ বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়া পরিকল্পিত জনসংখ্যার লক্ষ্যে পরিবার পরিকল্পনা সংশ্লিষ্ট তিন ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হয়ে থাকে এখান থেকে। এর পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শও দেওয়া হয়। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫ জন রোগীকে স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়। একসময় গ্রামাঞ্চলে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসায় ঝাড়-ফুঁক কিংবা হাতুড়ে ডাক্তারের ওপর নির্ভর করতে হতো। সামান্য সর্দি-জ্বরেও প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষগুলো অসহায় হয়ে যেতো। কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার পর সে অবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছে।
প্রতিটি ক্লিনিকে একজন করে নিয়োগকৃত প্রশিক্ষিত সেবাদানকারী(সিএইচসিপি) দায়িত্ব পালন করেন, যিনি শুক্র ও শনিবার ছাড়া সপ্তাহের বাকি দিনগুলোতে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত সেবা দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্য সহকারী(এইচএ) ও পরিবার কল্যাণ সহকারী (এফডব্লিউএ) সপ্তাহে তিন দিন সেবাদানকারীকে সহযোগিতা করেন। স্বাভাবিক প্রসব পরিচালনার লক্ষ্যে কর্মরত সকল নারী সিএইচসিপিকে পর্যায়ক্রমে ৬ মাসব্যাপী ধাত্রী (কমিউনিটি স্কিলড বার্থ এটেনডেন্ট-সিএসবিএ) প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে ১হাজার ৯৩৫ জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে সময়মতো প্রতিষেধক টিকাদান যেমন- যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুষ্টংকার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়াসহ শিশু ও বয়ষ্কদের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবা দেওয়া হয়। পাশাপাশি মহিলা ও শিশুদের অপুষ্টি কমাতেও সেবা দেন স্বাস্থ্য কর্মীরা। ম্যালেরিয়া, যক্ষা, কুষ্ঠ, কালাজ্বর, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসার সুবিধাও রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে। এছাড়া সাধারণ জখম, জ্বর, ব্যথা, কাটা, পোড়া, দংশন, বিষক্রিয়া, হাঁপানী, চর্মরোগ, কৃমি, চোখের রোগ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসা কমিউনিটি ক্লিনিকে দেওয়া হয়। অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণ, যেমন- কনডম, ইসিপি(ইমার্জেন্সি কন্ট্রাসেপটিভ পিল) ইত্যাদি সার্বক্ষণিক সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করা হয়ে থাকে এসব ক্লিনিকে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর সারা দেশে সাড়ে ১৩ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এলে প্রকল্পটি আবারও চালু করা হয়।
সবর্শেষ প্রকাশিত পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ইউনিয়ন পর্যায়ে ১৩ হাজার ৮৬১টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু রয়েছে। আরও ১ হাজার ২৯টি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। সবমিলিয়ে ১৪ হাজার ৮৯০টি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবার কাজ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার।
এদিকে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোকে আরও মজবুত ভিত্তি দিতে ইতিমধ্যে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্ট আইন-২০১৮’ পাস হয়েছে। এ আইনে কর্মীদের চাকরী স্থায়ীকরণ, বেতন বৃদ্ধি, পদোন্নতির সুযোগ, গ্রাচুইটি এবং অবসর ভাতার সুবিধা রাখা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ট্রাস্টে সরকারী থোক বরাদ্দ ও অনুদান থাকবে। পাশাপাশি বেসরকারীভাবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে, স্থানীয় সামাজিক সংগঠন বা ব্যক্তি বিশেষ এখানে দান করতে বা অনুদান দিতে পারবেন।
কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম জাতিসংঘের সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা(এমডিজি)-৪ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার এ সংশ্লিষ্ট টার্গেট এসডিজি-৩ : সব বয়সের সবার জন্য সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ নিশ্চিতকরণ অর্জনের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে অবদান রেখে চলেছে।
বিভিন্ন জরীপে দেখা গেছে, যেসব মানুষ এ ক্লিনিকগুলো থেকে সেবা গ্রহণ করছেন তাদের মধ্যে ৮০-৯৮ শতাংশ মানুষই সেবার বিষয়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। সরকারের নানামুখী উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হলো স্বাস্থ্য সেবা। আর এ ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক সরকারের প্রতিশ্রুত স্বাস্থ্য সেবা জনে জনে নিশ্চিত করার মহান লক্ষ্য নিয়ে কার্যকরভাবে অগ্রসর হচ্ছে -পিআইডি ফিচার।

নিউজটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
error: আপনি নিউজ চুরি করছেন, চুরি করতে পারবেন না !!!!!!