॥আসহাবুল ইয়ামিন রয়েন/চঞ্চল সরদার॥ রাজবাড়ী জেলা পুলিশের আয়োজনে নানা আয়োজনে কমিউনিটি পুলিশিং ডে পালিত হয়েছে।
দিবসটি উপলক্ষে ‘পুলিশের সাথে কাজ করি, মাদক-জঙ্গি-সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়ি’-শ্লোগানকে সামনে রেখে গতকাল ২৬শে অক্টোবর র্যালী, আলোচনা সভা, পুরষ্কার বিতরণ, রক্তদান কর্মসূচী, চিত্রকর্ম প্রদর্শনী, প্রীতি ফুটবল ম্যাচ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সকাল ১০টায় গেস্ট অব অনার হিসেবে পুলিশ সুপারের কার্যালয় প্রাঙ্গণে বেলুন ও শান্তির প্রতীক কবুতর উড়িয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দিবসটির উদ্বোধন করেন রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য কাজী কেরামত আলী।
এ সময় পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান পিপিএম(বার), জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও রাজবাড়ী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি কাজী ইরাদত আলী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(প্রশাসন ও অপরাধ) মোঃ সালাউদ্দিন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(সদর) মোঃ ফজলুল করিম, আমন্ত্রিত অতিথিবর্গ, জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তাগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃবৃন্দ ও সদস্যগণ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ উপস্থিত ছিলেন।
উদ্বোধনের পর সেখান থেকে বের করা হয় র্যালী। র্যালীটি শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে বড়পুল মোড় হয়ে পুলিশ লাইন্সে গিয়ে শেষ হয়। এরপর পুলিশ লাইন্সের ড্রিলশেডে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা সভা।
আলোচনা সভায় গেষ্ট অব অনার হিসেবে বক্তব্য রাখেন রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী এবং রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুর হাকিম।
পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান পিপিএম(বার) এর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ফকীর আব্দুল জব্বার, জেলা কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ আবুল হোসেন, রাজবাড়ী থানা কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এস.এম নওয়াব আলী, অন্যান্যের মধ্যে জেলা কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সদস্য সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ নিজাম মন্টু ও রাজবাড়ী থানা কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আঃ রহিম মোল্লা প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভা সঞ্চালনা করেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর) মোঃ ফজলুল করিম।
এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) খন্দকার মুশফিকুর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) মোঃ সালাউদ্দিন, রাজবাড়ী সদর থানার ওসি স্বপন কুমার মজুমদার, ডিবির ওসি ওমর শরীফ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হেদায়েত আলী সোহরাব, আমন্ত্রিত অতিথিবর্গ, জেলা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ও সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তাগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের বিভিন্ন ইউনিটের নেতৃবৃন্দ ও সদস্যগণ এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানের রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী বলেন, আমরা এখানে যারা উপস্থিত আছি শুধু তারাই জানতে পারছি কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ভূমিকা কী- অন্যরা কিন্তু জানতে পারছে না। তাই আমি দাবী রাখছি, জেলার ৫টি উপজেলা ও ৩টি পৌরসভাতেও এ ধরনের অনুষ্ঠান করার জন্য। তাহলে মানুষ কমিউনিটি পুলিশিং সম্পর্কে জানতে পারবে। যেসব এলাকায় মাদক-সন্ত্রাস বেশী সেসব এলাকায় এটা করলে অনেক সুফল পাওয়া যাবে। আমরা যদি সবাই মিলেমিশে কাজ করি তাহলে কেউ অন্যায় কাজ করতে পারবে না।
তিনি বলেন, চাঁদাবাজীর কারণে রাজবাড়ী সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে সাব-রেজিস্ট্রার না থাকায় সেখানে কোন জমি রেজিস্ট্রি হচ্ছে না। প্রশাসনের বিষয়টি দেখা উচিত। চাঁদাবাজদের ধরে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা দরকার। সড়ক পরিবহন আইন ও সরকারী নির্দেশনা মোতাবেক সারা দেশের কোন সড়ক-মহাসড়ক থেকে কোন ব্যক্তি, সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের নামে কোন চাঁদা তোলা যাবে না। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে রাজবাড়ীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নামে পুলিশ লাইন্সের সামনে, বড়পুলে, শ্রীপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল-গোয়ালন্দ মোড়সহ জেলার বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের নামে বিভিন্ন যানবাহন থেকে অবাধে চাঁদা তোলা হচ্ছে। যা কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সড়ক-মহাসড়কের যেসব জায়গায় চাঁদা তোলা হচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। পাসপোর্ট অফিসে পাসপোর্ট করতে গেলে বেশী টাকা দেওয়া লাগে, এটা বন্ধ করতে হবে। এ ব্যাপারে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা দুর্নীতি চাই না। রাজবাড়ী জেলাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পুলিশ-জনতা আমরা সবাই একসাথে কাজ করবো।
বক্তব্যের শেষে তিনি বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ভুপেন হাজারিকার কালজয়ী গান ‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কী মানুষ পেতে পারে না’ গেয়ে সবাইকে মুগ্ধ করেন।
সভায় অপর গেস্ট অব অনার রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম বলেন, রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্যের গাওয়া গানের কথাগুলো ধরেই বলছি, ‘মানুষ মানুষের জন্য’- কথাটি চিরন্তন সত্য। আবার এটিও সত্য কথা যে, মানুষ কিন্তু অমানুষের জন্য নয়। আজকে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের এই সুন্দর অনুষ্ঠানে আমি বলতে চাই, আমরা সকলে ভালো মানুষ হবো। কিন্তু সমাজে যে সমস্ত অমানুষ ভালো মানুষের ছদ্দবেশে লেবাস পরে সন্ত্রাস, জুয়া, চুরি, রাহাজানি, নারী নির্যাতন, মাদক ব্যবসা, মানুষ হত্যা করে তারা কখনও মানুষ হতে পারে না। এই অমানুষগুলোকে প্রকৃত মানুষ বানাতে আমাদের চেষ্টা করতে হবে। যাতে তারা সকল খারাপ কাজ থেকে নিজেদের ফিরিয়ে এনে মানুষ হিসেবে সমাজে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। সেই জন্য আমাদের সকলকে তাদের সহযোগিতা করতে হবে। আজকে কমিউনিটি পুলিশের যে চিন্তা-ধারা এটা সুন্দর সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য খুবই কার্যকর একটি বাস্তবসম্মত চিন্তা। পুলিশ কিন্তু পোশাক পরে সব ক্ষেত্রে অপরাধ উদঘাটন করতে পারে না-যদি আমরা কমিউনিটির সাধারণ জনগণ তাদের সহযোগিতা না করি। এই কমিউনিটির জনগণের একটি অংশ নিয়েই গঠিত কমিউনিটি পুলিশিং ফোরাম। এই কমিউনিটি পুলিশিং ফোরামের সাথে যারা কাজ করছেন তাদের প্রত্যেককে জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে, কমিউনিটির প্রতিনিধি হিসেবে সততার সাথে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমরা যারা নেতাগিরি করি তাদেরও জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দুর্নীতিমুক্ত এবং দুর্নীতির চিন্তামুক্ত ভালো মানুষ হতে হবে। সেটি না করে নেতারা যদি নেতা হওয়ার আগেই ক্যাসিনো ব্যবসার মাধ্যমে জুয়া থেকে টাকা আদায় করার চিন্তা করি তাহলে নেতা হওয়ার পর সেই চিন্তাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া ছাড়া অন্য কোন ভালো কাজ মাথায় আসবে না। আবার মানুষ অস্ত্র দিয়ে সন্ত্রাস করে এই কারণে যে, হাতে অস্ত্র থাকলে সাধারণ মানুষ ভয় পায় এবং অস্ত্র দেখিয়ে অনেক বে-আইনী কাজ করতে পারে। আজকে এই অস্ত্রের কারণেই কিন্তু সন্ত্রাস হচ্ছে। ঠিক একইভাবে মাদক সেবনের কারণে মানুষ ভারসাম্য হারিয়ে মনে করে আকাশে উড়ছে আর উড়ন্ত অবস্থায় নীচে তাকালে যেমন ভূ-পৃষ্ঠের জল-স্থল তার কাছে সব সমান মনে হয় তেমনি মাদকের কারণে তার কাছে ভালো-খারাপের কোন ভেদাভেদ থাকে না।
তিনি আরো বলেন, আমরা নিজেরা যদি দুর্নীতি করি তাহলে মানুষ আমাদের উপদেশ শুনবে কেন। বরং তারা মনে মনে বলবে তুমি আগে দুর্নীতিমুক্ত ভালো মানুষ হও তারপর আমাকে উপদেশ দিও। কারণ তারা জানে আমরা ভালো কাজ করছি না। সুতরাং কোন মানুষকে খারাপ বলার আগে নিজে ভালো হতে হবে, তারপর অন্যকে খারাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে মানুষ করতে হবে। যাতে সে সমাজে ভালো মানুষ হয়ে বাঁচতে পারে। এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশকে উন্নত দেশে রূপান্তর করার লক্ষ্যে সকলকে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানান।
জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, আমরা জানি রাজবাড়ী জনসংখ্যা প্রায় ১১ লক্ষ-কিন্তু পুলিশ আছে ৮২০ জন। তাই প্রায় সাড়ে ১৩শ লোকের জন্য মাত্র ১জন করে পুলিশ। আমরা যদি ভালোভাবে থাকতে চাই, নিরাপদে থাকতে চাই শুধুমাত্র একটা বাহিনীর উপর নির্ভর করি তাহলে সেটা কিন্তু ভালোভাবে কখনোই সম্ভব না। এবারের প্রতিপাদ্যটা আমার মনে হয় বর্তমানে পেক্ষাপটে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মাদক-জঙ্গী-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমরা কথা বলতে চাই। যখন মানুষ অপরাধ থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখবে তখনই সত্যিকার অর্থে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা হবে। আমরা রাজবাড়ীতে ভালো আছি, ভালো থাকতে চাই। কোনভাবেই কোন অন্যায়কে আমরা এখানে প্রশ্রয় দিব না।
সভাপতির বক্তব্যে পুলিশ সুপার মোঃ মিজানুর রহমান পিপিএম (বার) বলেন, আজকে সারা দেশের ন্যায় রাজবাড়ী জেলাতেও কমিউনিটি পুলিশিং ডে পালন করা হচ্ছে। এই কমিউনিটি পুলিশিং ডে পালন করার আগে আমাদের কমিউনিটি পুলিশিং এর ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হবে। আজকে সারা বিশ্বের অনেক দেশে যে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা রয়েছে সেটি সর্বপ্রথম ১৮২৯ সালে যুক্তরাজ্যের পুলিশ কমিশনার স্যার রবার্ট হুইলের দূরদর্শী চিন্তা থেকে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। তিনি একটি ডাকাতি ঘটনার রহস্য উদঘাটন করতে জনগণের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ ও তাদেরকে সকল অপরাধমূলক কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী করতে এই কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থার সূচনা করেছিলেন। শুধু সেটাই নয়-তিনি পর পর দুইবার গ্রেট বৃটেনের প্রধানমন্ত্রীও হয়েছিলেন। তার এই কমিউনিটি পুলিশিংয়ের ধারণা পরবর্তীতে জাতিসংঘ ভালো উদ্যোগ বলায় বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু হয়েছে। যার মাধ্যমে জনগণ সুফল পাচ্ছে। আমাদের রাজবাড়ীতে এই কমিউনিটি পুলিশিং এর কার্যক্রম খুব শক্তিশালী অবস্থায় রয়েছে। যার মাধ্যমে অতীতের ন্যায় বর্তমানেও সমাজের বিভিন্ন ধরেনের অপরাধ দমনসহ যারা অপরাধমূলক কাজকর্মের সাথে জড়িত তাদেরকে শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে। আমি আশা করি রাজবাড়ীতে বর্তমানে যে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু আছে সেটা ভবিষ্যতে আরো বেশী শক্তিশলী হবে।
আলোচনা পর্বের শেষে দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে চিত্রাংকন, বিতর্ক ও রচনা প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মধ্যে পুরষ্কার বিতরণ করা হয়। এছাড়া ড্রিলশেডে রক্তদারন কর্মসূচী, বিকালে পুলিশ লাইন্সের মাঠে প্রীতি ফুটবল প্রতিযোগিতা ও সন্ধ্যায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।