মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১০:২৫ অপরাহ্ন
Logo
সংবাদ শিরোনাম ::
বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আইসোলেশন মেয়াদ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টা ও বিটার তুলনায় তিন গুণের বেশী পুনঃ সংক্রমন ঘটাতে পারে : গবেষণা প্রতিবেদন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে এক বন্দুকধারী গ্রেফতার শান্তি চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে কলম্বিয়া সফর জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণের সাক্ষাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়ায় লকডাউন করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতে নতুন করে ১০ হাজার ৩০২ জন করোনায় আক্রান্ত নভেম্বর মাসজুড়ে করাঞ্চলে কর মেলার সেবা পাবেন করদাতারা ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারী কার্যবিধি যুগোপযোগী হচ্ছে

বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর গণমানুষের নেতা প্রয়াত কাজী হেদায়েত হোসেন স্মরণে-

  • আপডেট সময় রবিবার, ১৮ আগস্ট, ২০১৯

॥মোহাম্মদ গোলাম আলী॥ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ৩দিন পর ১৮ই আগস্ট রাজবাড়ীতে তৎকালীন গোয়ালন্দ মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও গণপরিষদ সদস্য কাজী হেদায়েত হোসেন দেশদ্রোহী আঁততায়ীর হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন। আজ ১৮ই আগস্ট তার ৪৪তম মৃত্যু বার্ষিকী।
প্রয়াত কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর এবং রাজবাড়ীবাসীর সুখ-দুঃখের সাথী। তিনি ছিলেন গণমানুষের নেতা।
তিনি যেমন সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন, তেমনি তার দলের কথাও ভাবতেন। রাজবাড়ী শহরের সজ্জনকান্দায় তাঁর বাড়িতে(শুভ্রালয়ে) রাজবাড়ী, গোয়ালন্দ, পাংশা, বালিয়াকান্দি, পাবনা অঞ্চলের মানুষের আশ্রয়স্থল ছিল। তাদের ছেলে-মেয়েদের স্কুলে-কলেজে ভর্তি করা, তাদের থাকা-খাওয়া এবং লেখাপড়ার যাবতীয় খরচাদি তিনি বহন করতেন।
রাজবাড়ী গার্লস স্কুল, রাজবাড়ী কলেজ প্রতিষ্ঠা তারই অবদান। গোয়ালন্দ মহকুমায় একটি মাত্র কলেজ(যা বর্তমানে রাজবাড়ী সরকারী কলেজ) তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক(এসডিও) মোঃ আজাহার আলীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল রাজবাড়ীতে গরীব এবং মেধাবী ছেলে-মেয়েদের প্রাথমিক থেকে উচ্চতর শিক্ষার সৃষ্টি করা। অনেক মেধাবী ছেলে মেয়ে এসএসসি পাস করার পর তাদের এইচএসসি পড়ার আর সুযোগ ছিল না। পড়া বন্ধ করে দিত তারা। কিছু কিছু পরিবারের সন্তানেরা বাইরে উচ্চ শিক্ষার জন্য যেত। তাদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। তাঁর অনেক মহৎ গুণাবলির মধ্যে শিক্ষাই ছিল তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ।
রাজবাড়ী ‘শুভ্রালয়ে’ তাঁর বাড়িতে বঙ্গবন্ধু অনেক বার এসেছেন। কেন্দ্রীয় নেতারাও অনেকেই অনেক বার এসেছেন। ফরিদপুর জেলার নেতারা আসতেন প্রায়ই। তাঁর বাড়ির সামনে সুন্দর একটি ফুলের বাগান আছে, ফুল তাঁর প্রিয় ছিল। যা আজও বিদ্যমান। সুন্দর ফুল দিয়ে ঘেরা বাগানের মধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক কাজী হেদায়েত হোসেন ঘুমিয়ে আছে। তিনটি কবর পাশাপাশি। বাবা, স্ত্রী ও কাজী হেদায়েত হোসেন। কবরগুলোর নকশা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কবরের নকশার প্রায় অনুরূপ। আমি(মোহাম্মদ গোলাম আলী) কবরগুলোর নকশা করেছি।
আমি কাজী হেদায়েত হোসেন সাহেবকে যে ভাবে দেখেছি; তাঁর আদর্শ, তাঁর রাজনীতি কর্মকান্ড, তাঁর সততা ও মহানুভবতা। আমি তাঁকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার বেশ ক’বছর পূর্বে একদিন একান্তভাবে কাছে বসে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মামা, আপনি মানুষের জন্য এতকিছু কিভাবে করেন? আপনার বাড়িতে প্রতিদিন কত মানুষ খাবার খাচ্ছে; কাউকে না খেয়ে আপনি যেতে দেন না। হিন্দু, কি মুসলিম কোন পার্থক্য ছিল না। এ সবের পিছনে যিনি সব সময় সহযোগিতা করতেন, তিনি হলেন কাজী হেদায়েত হোসেনের সহধর্মিনী(আমার মামীমা) মোনাক্কা বেগম। দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করতেন তিনি। পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের পড়াশুনা, এলাকাবাসীর সুবিধা-অুসবিধা, সুখ-দুঃখের সাথী হয়ে মিশে যেতেন তাদের মাঝে।
কাজী হেদায়েত হোসেন মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজবাড়ী ফরিদপুর অঞ্চলের একজন সংগঠক ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের পর তিনি খোকশা-কুষ্টিয়ার আকামুদ্দিন চেয়ারম্যানের বাড়ীতে পরিবারের সবাইকে রেখে ভারতের উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতিতে চলে যান। কলকাতা হয়ে ফিরে আসেন কল্যাণী ক্যাম্পে। সেখান থেকেই তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যাঁরা সেইদিন ভারত ও বাংলাদেশের একটি মুক্ত অঞ্চলে অস্থায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার দপ্তর করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, কর্নেল এম.এ.জি ওসমানীসহ আরো অনেকের সঙ্গে তাঁর(কাজী হেদায়েত হোসেনের) ভূমিকা ছিল প্রত্যক্ষ। মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা ট্রেনিং, তাদের হাতিয়ার যোগার করে ছোট ছোট এক একটি গ্রুপে ভাগ করে যার যার এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া। কল্যাণী ক্যাম্পের দায়িত্বে থাকা কাজী হেদায়েত হোসেন ছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন অন্যতম সংগঠক বা এলাকা ভিত্তিক পরিচালক।
দেশ স্বাধীনের পর জাসদের গণবাহিনী অনেকদিন ধরে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে আসছিল। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর, রাজবাড়ীতে গণবাহিনী বাহিনী সক্রিয় হয়ে উঠে। যে কোন মূল্যে তাকে হত্যা করা যায়, প্রতিদিন তাদের লোকজন তাঁকে হত্যা করার জন্য অনুস্মরণ করতে থাকে। কাজী হেদায়েত হোসেন সুদৃষ্টি সম্পন্ন একজন অভিভাবক ছিলেন। তাই তিনি তাঁর পরিবারের সবাইকে(বড় ছেলে কাজী কেরামত আলী(বর্তমান এমপি) ঢাকায় একটি বাসা ভাড়া করে স্থানান্তর করেন। শুধু তাঁর মেঝো ছেলে(বর্তমানে রাজবাড়ী জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক) কাজী ইরাদত আলীকে সঙ্গে রেখে তিনি রাজবাড়ীতে থেকে যান দলের স্বার্থে। কাজী ইরাদত আলী ছোট বেলা থেকেই সাহসী ও বুদ্ধিমান। সংসার, বাবার ব্যবসা ও রাজনীতি সব যেনো বাবার মতই অভ্যাস- অর্জন করতে থাকে।
কাজী হেদায়েত হোসেন ১৮ই আগস্ট সকাল ১০টার পর বাসা থেকে নাস্তা সেরে বের হন এবং এসডিও সাহেবের অফিসে যান। সঙ্গে ছিল ব্যবসায়ী বন্ধু বাদশা মিয়া। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে আবার রিক্সায় চেপে রাজবাড়ী বাজার হয়ে রাজবাড়ী কলেজের পশ্চিম পাশেই তাঁর ইটের ভাটা ও পুকুর দেখতে যান। রিক্সা রেখেই ইট-ভাটা ও পুকুরে মাছের খোঁজ-খবর নেন। সেখান থেকে কিছুক্ষণ পর তিনি বাদশা মিয়াকে সঙ্গে নিয়েই রিক্সায় উঠে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ভাটার সাইট থেকে মেইন রোডে উঠে আসতেই রেলের পরিত্যাক্ত ঘুম্টি ঘর ও রাস্তার ওপর ছোট একটি কালভার্টের কাছে রিক্সা আসতেই ঐ ঘুম্টি ঘরের আড়াল থেকে ৪/৫জন দুর্বৃত্ত কাটা রাইফেল দিয়ে তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। কিন্তু প্রথম গুলিটি লক্ষ্য ভেদ করে কাজী হেদায়েত হোসেনে বুকে না লেগে পাশে বসে থাকা বাদশা মিয়ার বুক ভেদ করে রিক্সার বডি ছিদ্র হয়ে গুলিটি বের হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে বাদশা মিয়া রিক্সা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে যান। পরক্ষণেই ঘাতকেরা সামনে এগিয়ে এসে তাকে লক্ষ্য করে বুকে ও পেটে পর পর চারটি গুলি করে দুর্বৃত্তরা রেল লাইন ধরে পালিয়ে যায়। কাজী হেদায়েত হোসেনের সাদা পাঞ্জাবী রক্তে ভিজে লাল হয়ে যায়। তাঁর বিশাল দেহটি রিক্সার উপরেই হেলিয়ে পড়ে। আর মুখে ইয়া আল্লাহু, ইয়া আল্লাহু, মওলা পাক, মওলা পাক বলতে থাকেন। চারিদিকের লোকজন ছুটাছুটি করতে থাকে। ইটভাটা থেকে লোকজন ছুটে আসে। তারপর তারা রক্ত মাখা দেহটি রিক্সার উপরে রেখে রিক্সাটি স্থানীয় লোকজন টানতে টানতে রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে নিয়ে আসে। আর বাদশা মিয়ার শরীরটা নিথর নিরব হয়ে রাস্তার উপর পরে থাকে এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
আমি প্রথমে এক রিক্সাওয়ালার কাছে খবর পাই, কাজী সাহেবকে কলেজের পিছনে রিক্সার উপরে গুলি করেছে। এই কথা শুনে আমি বাড়ি থেকে দ্রুত বের হয়ে কাজী সাহেবের বাড়িতে যাই। যেয়ে দেখি তার মেঝ ছেলে কাজী ইরাদত আলী খুব বিচলিত। পরিবারের অন্যান্য সদস্য সবাই ঢাকার বাসায়। শুধু কাজী ইরাদত আলী বাড়ীতে রয়েছে। আমরা তখন দু’জনেই দৌড়ে হাসপাতালের দিকে যেতে থাকি, হাসপাতালে গিয়ে দেখি বুকে চারটা বুলেট বিদ্ধ, তিনটি বুলেট বুকের মধ্যেই ছিল, একটি বুলেট বুকের নিজ থেকে ঢুকে পেটের বাঁ পাশ দিয়ে বড় ছিদ্র হয়ে বের হয়ে গেছে। কাজী সাহেব তখনও জীবিত। ঘন ঘন নিঃশ্বাস টানছে আর আল্লাহ আল্লাহ বলছে। ডাক্তার সাহেবরা ছুটাছুটি করছে, কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। হাসপাতালে নেবার আধা ঘণ্টা পর তিনি নিথর-নিরব হয়ে যান, ঘুমিয়ে পড়েন চির নিদ্রায়।
প্রয়াত জননেতা কাজী হেদায়েত হোসেনের আজ ৪৪তম শাহাদত বার্ষিকীতে গভীর ভাবে শ্রদ্ধা জানাই। মহান আল্লাহ্ তাকে জান্নাতবাসী করুন, আমীন। লেখক ঃ মোহাম্মদ গোলাম আলী চিত্রশিল্পী।

নিউজটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
error: আপনি নিউজ চুরি করছেন, চুরি করতে পারবেন না !!!!!!