॥রফিকুল ইসলাম॥ পল্লী বিদ্যুতের আগ্রাসনের প্রতিবাদে রাজবাড়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ ওজোপাডিকো লিঃ-এর আয়োজনে গতকাল ১৮ই জানুয়ারী বিকেল ৪টায় রাজবাড়ী ওজোপাডিকো কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলীর অফিস কক্ষে সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন রাজবাড়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ ওজোপাডিকো লিঃ-এর নির্বাহী প্রকৌশলী পরিতোষ চন্দ্র সরকার। এ সময় সহকারী প্রকৌশলী শেখ মোঃ সাহাবুদ্দিন, ওজোপাডিকো লিঃ শ্রমিক কর্মচারী লীগের রাজবাড়ী জেলা শাখার সভাপতি মোঃ লিয়াকত হোসেন, উচ্চমান সহকারী হিসাব রক্ষক মোঃ মিজানুর রহমান, সিবিএ নেতা অলোক কুমার, মোঃ আব্দুল গফুর এবং পিচরেট কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মোঃ নান্নু মোল্লাসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ উপস্থিত ছিলেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে রাজবাড়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ ওজোপাডিকো লিঃ-এর নির্বাহী প্রকৌশলী পরিতোষ চন্দ্র সরকার বলেন, মানব হৃৎপিন্ড যেমন শিরা-উপশিরার মাধ্যমে শরীরে রক্ত সঞ্চালন করে মানুষকে সুস্থ সবল করে বাঁচিয়ে রাখে তেমনি সুষ্ঠু বিদ্যুৎ সঞ্চালন/বিতরণ ব্যবস্থা জাতির অর্থনৈতিক চালিকাশক্তিতে গতি সঞ্চার করে। সুপরিকল্পিত বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং জাতীয় জীবনে এর যথাযথ ব্যবহারের মাত্রা অর্থনৈতিক অবস্থানের সূচক রুপেও আজ গণ্য হয়ে থাকে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালে জাতির জনক দেশের সকল জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় বিদ্যুৎ পৌঁছানোর লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড গড়ে তোলেন। কিন্তু মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান একটি অদূরদর্শী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দাতাগোষ্ঠীর অযৌক্তিক সংস্কার কর্মসূচী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ১৯৭৮ সালে প্রথমে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড গঠন করেন। যার মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মাঝে সহজে ও সুলভে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া। তবে লক্ষণীয় যে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড দীর্ঘ ৩৯ বছরে মাত্র ২২% গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে অবশিষ্ট ৭৮% গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছাতে তাদের কতো বছর লাগবে ? উল্লেখ্য, বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের আওতায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে ভেঙ্গে পশ্চিমাঞ্চল বিতরণ ব্যবস্থাকে ওজোপাডিকোতে রুপান্তরকালীন (ডিসেম্বর/২০০৭ সালে) সিস্টেম লস ছিল ১৯.৫০%। অত্রাঞ্চলে কর্মরত সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অক্লান্ত ও নিরলস পরিশ্রমে সিস্টেম লস এখন সিঙ্গেল ডিজিটে (৯.৯০%) নেমে এসেছে যা রীতিমত এক ঈর্ষনীয় সাফল্য। গ্রাহক সেবার দিক দিয়ে ওজোপাডিকো ইতিমধ্যে অন্যান্য বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। ২০১৫ সালে মন্ত্রণালয় নিয়োজিত নিরপেক্ষ বেসরকারী সংস্থা মাইডাস কর্তৃক গ্রাহকসেবা সংক্রান্ত এক সমীক্ষা চালানো হয়-তাতে গ্রাহকসেবা সংক্রান্ত সকল সূচকে পল্লী বিদ্যুৎ থেকে ওজোপাডিকো অনেক এগিয়ে রয়েছে। অথচ গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতায়িত করার প্রত্যয় নিয়ে গঠিত পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি তাদের ব্যর্থতার ষোলকলা পূর্ণ করে সৃষ্টিকালীন মূল উদ্দেশ্য থেকে সরে গিয়ে তাদের কার্যক্রম এখন শহরকেন্দ্রিক, যা কোন দর্শনেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছানো যাচ্ছে না সেখানে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন ২১ জেলায় নিয়ন্ত্রিত ওজোপাডিকো অঞ্চলের পৌরসভা, শহর অঞ্চলের লাইন গ্রাস করার জন্য তারা তৎপর। তাই শুধুমাত্র পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের উপর নির্ভর না করে ২১ জেলার সমগ্র এলাকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিকট বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ওজোপাডিকোর উপর অর্পন করার জোর দাবী জানাচ্ছি। যাতে বর্তমান সরকারের তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুত রুপকল্প ২০২১ যথাসময়ে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রুপকল্প ২০২১ বেশী দূরে নয়। এখনও পল্লী এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ বিদ্যুৎবিহীন মানবেতর জীবনযাপন করছে। তারা পাচ্ছে না ডিজিটাল বাংলাদেশের আধুনিক সেবা। পিছিয়ে আছে শিক্ষা, চিকিৎসা ও অর্থনৈতিক সুবিধা। সে সকল মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এনে যত দ্রুত সম্ভব উন্নয়নের মূল ¯্রােতধারায় সংযুক্ত করা প্রয়োজন। বাংলাদেশের বর্তমান অবিদ্যুতায়িত এলাকা অধিকাংশই পল্লী বিদ্যুতের আওতায়। পল্লী বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ সেই সকল এলাকায় বিদ্যুতায়ন না করে তাদের ভৌগলিক এলাকায় জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুৎ সরবরাহ থেকে বঞ্চিত করছে। একই সাথে যেসকল জনগণ ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে এবং উন্নতমানের বিদ্যুৎসেবা তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিপিডিবি এবং ওজোপাডিকো হতে ভোগ করছে-সেই সকল গ্রাহককে তাদের প্রতিষ্ঠানে অন্তর্ভুক্ত করার দুরভিসন্ধি চালাচ্ছে। এই দুরভিসন্ধি অত্যন্ত ন্যাক্কারজনক এবং বাংলাদেশের গ্রামীণ পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর সাথে প্রতারণার শামিল। কোন গোঁজামিল নয়, স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির কোন পূর্ব পরিকল্পনা নয়-সরকারের ঘোষিত ২০২১ সাল নাগাদ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কর্মসূচী সফল করার জন্য বাংলাদেশের সকল বিদ্যুৎ বিতরণকারী সংস্থাকে একযোগে কাজ করা প্রয়োজন। পল্লী এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের জন্য আরইবি এর আওতায় ৭৯টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মাধ্যমে বিদ্যুৎ বিতরণ করে আসছে-যার মাত্র ৭(সাত)টি লাভজনক, বাকিগুলো লাভজনক নয়। দীর্ঘ ৩৯ বছর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিসমূহ গ্রামীণ এলাকার মধ্যে সন্তোষজনক বিদ্যুৎসেবা প্রদানে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের দুর্নীতি এবং গ্রাহক হয়রানী সর্বজন স্বীকৃত। বিদ্যুতের মতো উচ্চ প্রযুক্তির সেবা প্রদানের কারিগরী সক্ষমতা পল্লী বিদ্যুৎ এখনো অর্জন করতে পেরেছে বলে এ বিষয়ের বিশেষজ্ঞগণ সন্দেহ পোষণ করেন। গ্রাহকদের উপর বিভিন্নভাবে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে ওজোপাডিকোর কোন গ্রাহক পল্লী বিদ্যুতে যেতে রাজী নয়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন জায়গায় তারা বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হয়েছেন। ওজোপাডিকোর বিভিন্ন লাভজনক বিদ্যুৎ সরবরাহ পল্লী বিদ্যুতে হস্তান্তরিত হলে ওজোপাডিকোতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র হ্রাস পাবে এবং সকলেই গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হবে। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি যেমন ক্ষুন্ন হবে-তদ্রুপ আগামী জাতীয় নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে। এ পরিস্থিতিতে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কাছে অন্য সংস্থার লাইন/গ্রাহক হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কর্তৃক ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর পরিকল্পনায় সম্পূর্ণ নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে এবং বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে এবং বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হবে। যারা এই ধরণের অপতৎপরতা চালাচ্ছে-আসলে তারা বিদ্যুৎ খাত তথা দেশের উন্নয়ন চায় না। তারা বিশৃঙ্খলা তৈরী করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে চায়, বিদ্যুৎ খাতে সরকারের উন্নয়নের অর্জিত সাফল্য ম্লান করতে চায়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যাশিত ও জাতির প্রতি প্রতিশ্রুত রুপকল্প বাস্তবায়নে বাধাগ্রস্থ ও জিম্মি করার হীন মানসিকতা সম্পন্ন গুটি কয়েক স্বার্থান্বেষী মহল সদাশয় সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করার প্রচেষ্টাকারীদের বিচার প্রার্থনা করছি। ওজোপাডিকোর ভৌগলিক এলাকাভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্প সমৃদ্ধ বাণিজ্যিক জোন যেমন ঃ মোংলা ইপিজেড, যশোর নোয়াপাড়া শিল্পাঞ্চল, আলমডাঙ্গা, মাগুরা, কুষ্টিয়া, নড়াইল (আংশিক), ভোলা, রাজবাড়ী, মধুখালী, শরীয়তপুর, কালীগঞ্জ, নাভারন ঝিকরগাছা, বেনাপোল, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ হাইওয়ে রোড, সাতক্ষীরা (আংশিক), ঝালকাঠি ও পিরোজপুর (আংশিক), নলছিটি, কাঠালিয়া, ভান্ডারিয়া, গৌরনদী, খুলনা সিটি কর্পোরেশন (অনুপ্রবেশকৃত অংশ), বরগুনা (আংশিক)সহ সংশ্লিষ্ট সমুদয় এলাকা/পৌরসভা সমূহের ৩(তিন) মেগাওয়াটের অধিক চাহিদাকৃত শতশত মেগাওয়াট ব্যবহৃত এলাকা মন্ত্রণালয়ের পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওজোপাডিকোর বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে থাকা উচিত। তাই ওজোপাডিকোকে একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে উন্নীতকরণের লক্ষ্যে অচিরেই উক্ত এলাকাসমূহ ওজোপাডিকোর নিকট হস্তান্তরের জন্য জোর দাবী জানাচ্ছি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য, ওজোপাডিকো স্বতন্ত্র কোম্পানী হিসেবে নিজস্ব আয়ের উৎসের উপর ভিত্তি করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি পরিশোধ করে এবং বিদ্যমান বিতরণ লাইন মেরামত, সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন করে থাকে। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আমাদের বক্তব্যের আলোকে ‘পল্লী বিদ্যুৎ-পল্লীতে কাজ করবে, শহরমুখী নয়’ এই ধারণাটি সরকার ও দেশবাসীর দৃষ্টি আকর্ষন করছি।