॥আশিকুর রহমান॥ রাজবাড়ী সদর উপজেলার আলীপুর ইউনিয়নের আলাদীপুরে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (পিটিআই)-এর পরিক্ষণ বিদ্যালয়ে ডেপুটেশন প্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক ও বাংলাদেশ সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জেলা শাখার সভাপতি হাবিবুর রহমান মোল্লা ওরফে হবি’র বিরুদ্ধে ওই বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগে শাস্তির দাবীতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় বইছে।
রাজবাড়ী সদর উপজেলার কাজীবাঁধা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শম্পা মন্ডল(Shampa Moni) গত ১০ই জুন বিষয়টি নিয়ে তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
স্ট্যাটাসে ওই সহকারী শিক্ষক হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে হয়রানীর অভিযোগ তুলে এ ঘটনার বিচারের দাবি জানিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘সভ্যতার মুখোশে ঢাকা কাপুরুষের নাজেহাল অবস্থা। রাজবাড়ী পরীক্ষণ বিদ্যালয়ের ডেপুটেশন প্রাপ্ত সহকারী শিক্ষক হাবিবুর রহমান উক্ত বিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর সাথে অনৈতিক কাজের চেষ্টার অপরাধে মহিলা শিক্ষকরা তাকে নাজেহাল করেছে। আর তখন তিনি নীরব থেকে এ ঘটনার দায় স্বীকার করে সেই স্থান থেকে পালিয়েছে। তবে এধরনের ঘটনা তার জন্য নতুন নয়। তিনি সূর্যনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক থাকাকালীনও এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে। আমরা কি এবারও চুপ করে বসে থাকব? একবার ভাবুনতো আজ যদি ঐ মেয়ের জায়গায় আমাদের নিজের সন্তান বা কোনো বোন হত আমরা কি চুপ করে থাকতাম। আমার সাথে আপনারাও আসুন এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। আমরা সকলে এর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আবেদন জানাই। যাতে আর কোনদিন শিক্ষক নামধারী কোন পশু এই ধরনের কাজ করার সাহস না পায়।
শিক্ষিকা সম্পা মন্ডলের এ ফেসবুক স্ট্যাটাসের পর হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছেন শিক্ষক সমাজ। এ স্ট্যাটাসের নিচে অর্ধশত কমেন্টস ও বহু শেয়ার করে হাবিবুর রহমানের বিচার দাবি করেছেন অনেকেই।
** কল্যানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষিকা আঞ্জুমান আরা বেগম লিখেছেন- আমরা সাধারণ জনগণ ও শিক্ষক সমাজ এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও এই শিক্ষক নামক বিকৃত মানুষিকতা সম্পন্ন শিক্ষকের যথাযথ বিচার চাই।
** টাউন মক্তব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা তাহমিনা পারভীন লিখেছেন- ‘আজকের শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে আমরা তার তরে একটি সাজানো বাগান চাই’। হোক ছেলে হোক মেয়ে, সুস্থ ধারার পরিবেশ তার বেড়ে ওঠার প্রথম ধাপ। সেক্ষেত্রে পরিবার তারপরই প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয় একটি শিশুর প্রথম বিকাশ সাধন এবং নিরাপদ আশ্রয়স্থল। সেক্ষেত্রে আমরা কতটা নিরাপত্তা দিতে পারছি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোমলমতি মেয়ে শিশুদের। যে শিক্ষক মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে যখন একটি ছোট্ট মেয়েকে বিভিন্নভাবে প্রলোভিত করে। পরীক্ষায় বেশি নম্বর দেয়ার আশ্বাস দিয়ে তার সাথে অশোভন কৃতকর্মে লিপ্ত হয়ে দিনের পর দিন শিশু নির্যাতন করতে থাকে। কতবার তাকে ক্ষমা করা যায়? প্রশ্ন প্রতিটি বিবেক সম্পূর্ণ মানুষের কাছে, প্রতিটি শিক্ষক পরিবারের কাছে। যে শিশুটি আমাদের কারো মেয়ে, কারো বোন, কারো মা। কি করে তাকে এভাবে লাঞ্ছিত করা যায়? যে এমন কাজ করতে পারে সে তো পশুরই নামান্তর। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এমন হওয়া উচিত যাতে আর কোনো মেয়েকে মাথা নিচু করে বাঁচতে না হয়। আর শিক্ষক নামধারী ওই নরপশু যেন সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।
** শ্রীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষিকা গুলশান আরা মিতা লিখেছেন- অবশ্যই আমরা এর উপযুক্ত বিচার চাই।
** ভবানীপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রিজিয়া খান লিখেছেন- ওই শিক্ষককে সবার সামনে জুতাপেটা করে বের করে দেওয়া উচিত।
** টাউন মক্তব সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা সেলিনা শাপলা লিখেছেন- বিচার হওয়া উচিত।
** সূর্যনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা রিনা পারভীন লিখেছেন- ধন্যবাদ আপা সাহসী পোষ্ট দেওয়ার জন্য। গতবারের ঘটনায় যারা তাকে ধোঁয়া তুলসী পাতা ভেবে আমাদের বলেছিল এসব প্রধান শিক্ষক আর সহকারীদের চক্রান্ত, তারা আজ কোথায়? অনেকের রক্ত চোখ দেখেছিলাম। রাত ১২টা পর্যন্ত থানায় ছিলাম। কিছুই করার ছিল না। অন্যায় করার পরেও তারই জয় হয়েছিল। পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে ডেপুটেশন। এবার ঢাকায় পাঠান।
** সূর্যনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাফিজুর রশিদ লিখেছেন- সূর্যনগরের ঘটনায় সূর্যনগরের প্রধান শিক্ষকই নাকি ঘটনা ঘটিয়ে ওই শিক্ষককে দায়ী করেছিল। আজ আবার কে এই ঘটনা ঘটালো? অনেক শিক্ষিকা সেদিনের ঘটনা বিশ্বাস করেন নাই। আজ কেন এমন হলো? ধন্যবাদ শিক্ষিকা সম্পাকে সত্য ঘটনা তুলে ধরার জন্য।
** বেলগাছী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আনোয়ার চৌধুরী লিখেছেন- সাহসী লেখনীর জন্য ধন্যবাদ।
** প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা নুরজাহান পারভীন লিখেছেন- নোংরা মানসিকতা। শাস্তি প্রাপ্য হয়ে গেছে ওর। লেখনির জন্য ধন্যবাদ।
** শিক্ষক আহমেদ সুমন লিখেছেন- ওর গরমটাকে কেটে হিজড়া বানিয়ে দেয়া হোক। প্রমাণিত হলে চাকরীচ্যুত করা হোক।
** মনিরুল ইসলাম তুজাম লিখেছেন- অবশ্যই বিচার চাই।
** কোলা সদর উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালের শিক্ষক কৃষ্ণ সরকার লিখেছেন- শিক্ষক সমাজ এমন হলে সবাই তার জন্য দায়ী হতে পারে না। তাকে অব্যহতি দেয়া হোক।
** অ্যাডভোকেট নাজমা সুলতানা লিখেছেন- সভ্যতার মুখোশে ঢাকা চরিত্রহীন শিক্ষককে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
** সাংবাদিক রবিউল ইসলাম মজনু লিখেছেন- যতদূর জানি তিনি বিয়ে করেননি। আর এর আগে সূর্য়নগর স্কুলে এমন ঘটনা ঘটিয়েছিল। তখন অমি নিউজ করেছিলাম।
** কলামিষ্ট বাবলা চৌধুরী লিখেছেন – ওর গরমটাকে কেটে হিতার নামে থানায় মামলা করা উচিৎ এবং বিভাগীয় ব্যাবস্থা গ্রহণ করে শাস্তি নিশ্চিত করতে সকলকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন। হিজড়া বানিয়ে দেয়া হোক। অভিযোগ প্রমাণিত হলে চাকুরীচ্যুত করা হোক।
এদিকে শিক্ষিকা শম্পার স্ট্যাটাসের সুত্র ধরে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে জানাযায়, গত ৩০ শে এপ্রিল পরিক্ষণ বিদ্যালয়ে প্রথম সাময়িক পরীক্ষার ধর্ম বিষয়ের পরীক্ষা চলছিলো। পরীক্ষা শেষে শিক্ষক হাবিবুর রহমান ওই ছাত্রীর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে হাত দিয়ে যৌন হয়রানী করেন। এ সময় ওই ছাত্রী বাঁধা দিলে হাবিবুর রহমান বলেন- ‘এরকম করতে না দিলে তোকে পরীক্ষায় নম্বর কম দেওয়া হবে’। পরে ওই ছাত্রী বাড়ি গিয়ে তার মায়ের কাছে ঘটনা খুলে বলে। এক পর্যায়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের মধ্যস্ততায় ওই ছাত্রীর পরিবারকে টাকা-পয়সা দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন শিক্ষক হাবিবুর রহমান হবি।
এদিকে ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর জেরে গত ১০ই জুন বিকালে পিটিআই’র ক্যাম্পাসে একদল নারী শিক্ষকের রোষানলে পড়েন হাবিবুর রহমান হবি। এ সময় তিনি ঘটনা স্বীকার করায় নারী শিক্ষকদের কেউ কেউ তাকে লাঞ্ছিত করাকালে সুযোগ বুঝে মোটর সাইকেল নিয়ে দ্রুত পিটিআই ত্যাগ করেন।
ঘটনার বিষয়ে ওই ছাত্রীর বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি টাকা নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার এবং সাংবাদিকের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
এ ব্যাপারে অভিযুক্ত সহকারী শিক্ষক হাবিবুর রহমান বলেন, আমার বিরুদ্ধে ছাত্রীর যৌন হয়রানীর ‘অভিযোগটি মিথ্যা। আমি এ ধরণের কোনো অপকর্ম করিনি।’। এরপর তিনি এ প্রতিবেদককে কয়েকবার ফোন করে বিষয়টি নিয়ে প্রতিবেদন না করার অনুরোধ জানান।
এ বিষয়ে কথা বলতে রাজবাড়ী সদর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা নাসরিন আক্তারের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মাতৃত্বকালীন ছুটিতে আছি। ঘটনাটি জানি না।’
ভারপ্রাপ্ত উপজেলা শিক্ষা অফিসার নৃপেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, উল্লেখিত বিষয়ে কোন লিখিত অভিযোগ পাইনি। তবে কয়েকজন শিক্ষকের মুখে ঘটনা শুনেছি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা হোসনে ইয়াসমিন করিমীর নম্বরে কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
এ ব্যাপরে রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডঃ এম.এ খালেক বলেন, ঘটনাটি তিনি শুনেছেন। তবে কেউ প্রতিকার চেয়ে দরখাস্ত দেয়নি। আজ শিক্ষদের সাথে মতবিনিময় সভায় শিক্ষকরা হাবিবুর রহমান হবির ঘটনার শাস্তির দাবী জানিয়েছে।
একটি সুত্র জানায়, ঘটনার পর পিটিআই কর্তৃপক্ষ অভিযুক্ত হাবিবুর রহমানকে ডেপুটেশন বাতিল করার জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে পত্র দিয়েছে। আর পরিস্থিতি বেগতিক দেখে হাবিবুর রহমানকে চিকিৎসার অজুহাতে বিদেশে যাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, রাজবাড়ী উপজেলার সূর্য্যনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৪র্থ শ্রেণীর এক ছাত্রীকে যৌন হয়রানীর অভিযোগে বিগত ২০১৬ সালে ৯ই নভেম্বর দুপুরে এলাকার উত্তেজিত জনতার হাতে শারিরীকভাবে লাঞ্ছিত একই স্কুলের সহকারী শিক্ষক ও বাংলাদেশ সরকারী প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির জেলা শাখার সভাপতি হাবিবুর রহমান মোল্লা হবি(৪৫)। ঘটনার পর তিনি জনরোষ এড়াতে প্রায় এক ঘণ্টা বিদ্যালয়ের বাথরুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকেন। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসেন। ওইদিন রাত ৯টার দিকে থানায় বিশেষ তদবীরে মুচলেকা দিয়ে হাবিবুর রহমান মোল্লা হাবি মুক্তি পান।
ওই ঘটনার পর কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে বিশেষ তদবীবে সূর্য্যনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে ডেপুটেশন পিটিআই-এর পরিক্ষণ বিদ্যালয়ে পাঠায়। কিন্তু এখানে যোগদানের পরও সে একই ঘটনা ঘটানোর কারণে শিক্ষক সমাজ ফুসে উঠেছে।