॥স্টাফ রিপোর্টার॥ এক সময়ের খরস্রোতা চন্দনা নদীতে এখন আর পানি নেই। মাছের পরিবর্তে এখন সেখানে হচ্ছে ধানের চাষ।
রাজবাড়ী জেলার পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালী উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ঐতিহ্যবাহী এই চন্দনা নদীর প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকা জুড়েই ধান চাষ করছে কৃষকরা। নদীতে পানি না থাকায় অনেকেই সেচের ব্যবস্থা করে এই চাষ শুরু করেছে। কোন কোন স্থানে কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করতেও দেখা যাচ্ছে। লাগামহীন দখলের ফলে নদীর গভীরতা কমে যাওয়ায় ভরা মৌসুমেও চন্দনায় পানি থাকে না। যে নদীতে এক সময় বড় বড় লঞ্চ, ইস্টিমার, পাল তোলা পানসি নৌকা চলতো সেই নদীতে এখন ডিঙ্গী নৌকা চলার মতো পানিও থাকে না।
চন্দনা নদী রাজবাড়ীসহ ২টি জেলার ৬/৭টি উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে গোপালগঞ্জ জেলার কুমার নদীর সাথে সংযোগ স্থাপন করেছে।
এই নদীর পানির উপর নির্ভর করে এক সময়ে প্রায় দেড় লাখ একর জমিতে সেচের আওতায় উচ্চ ফলনশীল ধান, গম, আখ, পাটসহ নানা রকমের সবজি উৎপাদন করা হতো। জেলার বালিয়াকান্দি, পাংশা ও কালুখালী উপজেলার মধ্যে দিয়ে চন্দনা নদী দিয়ে এক সময় ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল অঞ্চলের কৃষকরা ব্যবসা করতো। এই নদীতে এলাকার মৎসজীবীরা প্রচুর পরিমাণে মাছ আহরন করে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু নদীতে এখন পানি না থাকায় নদীর মধ্যেই ধানসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের চাষ শুরু হয়েছে।
বালিয়াকান্দি উপজেলার রামদিয়া, গোবিন্দপুর, নারায়ণপুর, নবাবপুর পদমদী, বারাদীসহ বিভিন্ন স্থানে নদীর মধ্যে ইরি ধান চাষ করতে দেখা যাচ্ছে। নদীর জমি পলি মাটির হওয়ায় ফলনও বেশী পাচ্ছে কৃষকরা।
বালিয়াকান্দি উপজেলার বারাদী গ্রামের সেলিম শেখ, ছমির উদ্দিন, সোনাই মন্ডল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ জানান, চন্দনাতো এখন মরা খাল। বর্ষার সময় একটু পানি থাকে, আর অন্য সময়ে এই নদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। যাদের বাড়ী চন্দনার পাড়ে তারা ধানসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করে।
কালুখালী উপজেলার চাঁদপুর গ্রামের গনি মিয়া বলেন, এক সময় এই চন্দনায় বড় বড় নৌকা চলতো। ব্যবসায়ীরা নদীর বুক দিয়ে দেশ-বিদেশে যেত। কিন্তু চন্দনা নদীর যৌবন আজ আর নেই। বিভিন্ন এলাকায় দখলদাররা নদীর পাড়ে দখল করে কেউ পুকুর, কেউ বাড়ী, আবার কেউ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নদীর স্রোত বাধাগ্রস্থ ও সরু খালে পরিণত করেছে। নদীতে যার কারণে ধান চাষ করা হচ্ছে।
স্থানীয় দু’একজন মুরুব্বীর মুখ থেকে শোনা যায়, চন্দনা নদীটি পাংশা উপজেলার গতমপুরের পদ্মার মুখ থেকে উৎপত্তি হয়ে চন্দনা নাম ধারণ করেছে। এই নদীটি এক সময় প্রবল খরস্রোতা নদী ছিল। তখন এই নদী দিয়ে বড় বড় পানসি ও পাল তোলা নৌকা চলতো। বাঙালী জাতির ঐতিহ্য জারী, সারী, ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া গানের তালে তালে নদীতে মাঝিরা নৌকা চালিয়ে বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করতো। আজ সেই নদীটির বুক শুকিয়ে হাহাকার করছে।
এই চন্দনা নদী নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চন্দনা-বারাশিয়া সেচ প্রকল্প নামে একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। যে প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নদী পাড়ের কৃষকরা সারা বছর পানি পাবে, আর সেই পানি দিয়ে নদী পাড়ের জমি চাষাবাদ হবে। বিভিন্ন প্রতিকূলতার কারণে বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি। আজ সরকারে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি ইচ্ছা করলে তার পিতার প্রস্তাবিত চন্দনা-বারাশিয়া সেচ প্রকল্পটি চালু করে চন্দনা নদী পাড়ের কৃষকদের কৃষি উৎপাদনে সহায়তা করতে পারেন।
চন্দনা নদী পাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, নদীর বিভিন্ন অংশ মানুষ দখল করে রেখেছে। যার কারণে চন্দনা নদী দিয়ে আর আগের মত পানি প্রবাহিত হয় না। এটি এখন মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। নদীতে পানি না থাকার কারণে নদীর বিভিন্ন স্থানে ধানসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি চাষ করা হচ্ছে। চন্দনা নদীর প্রস্থ একসময় ছিল প্রায় ২০০ ফুট। বর্তমানে মাত্র ৪০-৫০ ফুট। তাদের দাবী, নদীটিকে বাঁচাতে হলে পুনরায় খনন করতে হবে।
বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোঃ মাসুম রেজা জানান, চন্দনা নদীর বিভিন্ন অংশ প্রভাবশালীরা দখল করেছে এবং এখনও করছে। ইতিমধ্যে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চন্দনা নদীর ম্যাপ, জমির সীমানা নির্ধারণের কাজ শুরু করা হয়েছে। খনন করে পুনরায় নদীটিকে আগের অবস্থানে ফিরিয়ে আনা এবং শীঘ্রই দখলমুক্ত করার কার্যক্রম শুরু হবে।