॥আসহাবুল ইয়ামিন রয়েন॥ রাজবাড়ী জেলা প্রশাসনের আয়োজনে গতকাল ১৭ই জানুয়ারী বিকাল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও রাজবাড়ীর কৃতি সন্তান এম.বজলুল করিম চৌধুরীর সাথে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি ও জেলা পর্যায়ের সকল দপ্তরের প্রধানদের মতবিনিময় সভা জেলা কালেক্টরেটের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে দিক-নির্দেশনামূলক বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম.বজলুল করিম চৌধুরী।
জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলীর সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফকীর আব্দুল জব্বার এবং উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পক্ষে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডঃ এম.এ খলেক বক্তব্য রাখেন।
সভায় জেলা প্রশাসন ও অন্যান্য দপ্তরের বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপন করেন জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী। এ সময় পুলিশ সুপার সালমা বেগম পিপিএম-সেবা, সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ রহিম বক্স, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা(ভারপ্রাপ্ত) মোঃ রফিকুল ইসলাম, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক ড. একেএম আজাদুর রহমান, সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডাঃ মোঃ মেজবাউল হক, রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানগণ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(সার্বিক) রেবেকা খান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক(রাজস্ব) মোঃ আব্দুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মোঃ সাদেকুর রহমান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী খান এ শামীম, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ জহিরুল হক, গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ হাফিজুল ইসলাম, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার(ক্রাইম) মোঃ আছাদুজ্জামান, জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনারগণ, বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের উপ-পরিচালক ও দপ্তর প্রধানগণ ও তাদের প্রতিনিধিগণসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম. বজলুল করিম চৌধুরী তার জন্মস্থান রাজবাড়ী জেলার স্মৃতিচারণ করে বলেন, আমি গত ২৭শে আগস্ট ঢাকা বিভাগের কমিশনার হিসেবে যোগদান করি। রাজবাড়ী জেলা আমার পূর্ব পরিচিত। কারণ এই জেলাতেই আমার বেড়ে উঠা। রাজবাড়ী জেলা ছোট হলেও পূর্ব থেকেই বিভিন্ন কারণে এই জেলার ঐতিহ্য রয়েছে। দেশের সাংস্কৃতিক বিকাশের দিক দিয়ে এই জেলা একটি ঐতিহ্যবাহী জেলা। আমার নিজ জেলা হওয়ায় আমি এই জেলার মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার দিক দিয়েও জেলাটি দেশের মধ্যে অন্যতম একটি জেলা। আজ থেকে ৪৬বছর আগে স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাধীন হয়েছিল। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধু মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের মানুষকে অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত দেশ হিসেবে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানী পরাজিত বাহিনীর ষড়যন্ত্রে এ দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী স্বাধীনতা বিরোধী কিছু মানুষ তাকে স্বপরিবারে হত্যার মাধ্যমে তার সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। এর পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে বর্তমান সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্ন বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির মাধ্যমে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের জন্য রূপকল্প-২০২১ ঘোষণার মাধ্যমে সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ শুরু করেন। মাত্র নয় বছরেই আমরা সেই লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে সফলতা দেখতে পাচ্ছি। আমরা ইতিমধ্যে জাতিসংঘের এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের মাধ্যমে মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। এমডিজি বাস্তবায়নের পর আমরা রূপকল্প-২০২১ কে সামনে রেখে এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে উচ্চ মধ্যম আয়ের উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছি। যার মাধ্যমে দেশে টেকসই উন্নয়নসহ দারিদ্র বিমোচন, মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশুমৃত্যুর হার, গড় আয়ু বৃদ্ধি, খাদ্য নিরাপত্তা, অবকাঠামো উন্নয়ন, অর্থনৈতিক মুক্তিসহ সকল ক্ষেত্রে দেশের সাধারণ মানুষের উন্নয়ন সাধিত হবে। সেই লক্ষ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশের প্রতিটি ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে আমরা সকলে সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। যাতে আমরা আমাদের পূর্বসুরীরা যে দেশ উপহার দিয়ে গেছেন তার সার্বিক উন্নয়ন ঘটিয়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুখী-সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ রেখে যেতে পারি। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত উন্নত মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে বিশ্বের বুকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত সোনার বাংলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সকলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তিনি দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সংশ্লিষ্ট কাজের কোয়ালিটি নিশ্চিত করা, অবকাঠামোসহ সকল সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত মানসম্মত শিক্ষা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্যসেবাসহ সরকারী সকল সুবিধা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া, স্থানীয় সরকার বিভাগকে আরো শক্তিশালী করা, উন্নয়নমূলক কাজে জনপ্রতিনিধি ও জনগণকে সমৃক্ত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
বিভাগীয় কমিশনার এম.বজলুল করিম চৌধুরীর সকল সরকারী বিভাগের কর্মকর্তাদের স্মরণ করিয়ে দিয়ে আরো বলেন, দেশের জনগণ হলো সকল ক্ষমতার মালিক। কারণ তাদের ট্যাক্সের টাকা দিয়েই আমাদের বেতন হয়। সুতরাং আমাদের উচিত বর্তমান সরকারের নীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক জনগণের দোরগোড়ায় সকল সরকারী সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। আমি আশা করব, রাজবাড়ী জেলার সকল কর্মকর্তা জনগণের সেবা প্রদানে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করবেন।
তিনি রাজবাড়ী জেলার সকল উন্নয়ন কর্মকান্ড সম্পর্কে অবহিত হন এবং তার নিজ জেলা হিসেবে রাজবাড়ী জেলার উন্নয়নে তার যদি কিছু করণীয় থাকে তা করবেন বলে সকলকে আশ্বস্ত করেন। তিনি রাজবাড়ী জেলার বাল্য বিবাহের হার কমিয়ে আনার উপরও বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেন।
সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী রাজবাড়ী জেলার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরে বলেন, রাজবাড়ী জেলা একটি ছোট জেলা হলেও শিক্ষা-সংস্কৃতি ছাড়াও বিভিন্ন দিকে এই জেলার ঐতিহ্য রয়েছে। দেশের সার্বিক উন্নয়নের সাথে এই জেলার অনেক উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়িত হচ্ছে। যা বাস্তবায়নে জেলার প্রতিটি বিভাগ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত জেলা পুলিশ থেকে শুরু করে জেলার প্রতিটি সরকারী বিভাগ অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতির মাধ্যমে জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে অত্যন্ত সুন্দর পরিবেশে সকল উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন করছে। এই জেলার জনপ্রতিনিধিসহ জনসাধারণ সরকারের যে কোন কাজে প্রশাসনকে সহযোগিতা করায় সরকারী কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি রাজবাড়ী জেলার বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নদী ভাঙ্গন প্রতিরোধে স্থায়ী শহর রক্ষা প্রকল্প, রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মাহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, বিদ্যুৎ গ্রীড স্টেশন নির্মাণ প্রকল্প, এলজিইডির পল্লী অবকাঠামো উন্নয়ন ও মেরামত প্রকল্পসহ সরকারের বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
এ ছাড়াও তিনি শীতার্ত মানুষের মাঝে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের কম্বল বিতরণ, গত বন্যায় ও নদী ভাঙ্গনে ত্রাণ বিতরণসহ, কৃষি ক্ষেত্রে এ জেলার সাফল্যের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন। তিনি প্রধান অতিথিকে তার নিজ জেলায় তার অধীনে কাজ করার সুযোগ করে দেওয়া জন্য সরকারকে এবং রাজবাড়ী জেলা সফরের জন্য তাকে জেলা প্রশাসনসহ সকল বিভাগের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান। তিনি জেলার সকল কর্মকর্তার পক্ষ থেকে প্রধান অতিথিকে ফুলেল শুভেচ্ছাসহ ক্রেস্ট প্রদান করেন।
এদিকে দুই দিনের সফরে গতকাল ১৭ই জানুয়ারী রাজবাড়ীতে এসে প্রথম দিন পূর্ব নির্ধারিত বিভিন্ন কর্মসূচীর মধ্যে দিয়ে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেছেন ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার এম. বজলুল করিম চৌধুরী।
সড়ক পথে ঢাকা থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় তিনি দৌলতদিয়া ঘাটে এসে পৌঁছালে জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী তাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এরপর বেলা ১২টায় তিনি রাজবাড়ী সার্কিট হাউজে এসে পৌঁছালে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক মোঃ শওকত আলী ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার শাখার উপ-পরিচালক, জেলা প্রশাসনের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকগণ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাগণ, সহকারী কমিশনার (ভূমি)গণ ও সহকারী কমিশনারগণসহ কর্মকর্তাগণ তাকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। শুভেচ্ছা জানানোর পর জেলা পুলিশের একটি দল তাকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন।
গার্ড অব অনার প্রদান শেষে রাজবাড়ী পৌরসভার পক্ষ থেকে মেয়র মহম্মদ আলী চৌধুরী, সদর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডঃ এম.এ খালেক ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে সংস্থার সভাপতি জেলা প্রশাসকসহ অন্যান্য সদস্যগণ ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান। এরপর তিনি জেলা প্রশাসনে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের(উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সহকারী কমিশনার-ভূমিসহ) কর্মকর্তাদের সাথে সার্কিট হাউজে মতবিনিময় সভায় মিলিত হন।
এছাড়াও সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় জেলা শিল্পকলা একডেমীর আয়োজনে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে তার রাজবাড়ী সফরের প্রথম দিনের কর্মসূচী সমাপ্ত হয়।
আজ ১৮ই জানুয়ারী সকাল সাড়ে ৯টায় তিনি রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয় ও সকাল ১০টায় সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার(ভূমি)’র কার্যালয় পরিদর্শনের পর বেলা ১১টায় কালেক্টরেট কোয়ালিটি স্কুলের উদ্বোধন করবেন। এরপর সাড়ে ১১টায় রাজবাড়ী সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে বিভিন্ন সরকারী দপ্তরের কর্মকর্তা, সুধীবৃন্দ ও শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময়ের পর দুপুর ২টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে রাজবাড়ী ত্যাগ করবেন।