॥স্টাফ রিপোর্টার॥ প্রতিষ্ঠার ৩৫বছরেও উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি রাজবাড়ী জেলার একমাত্র সরকারী হাঁস-মুরগীর খামারে। সংস্কারের অভাবে খামারটির অধিকাংশ স্থাপনা এখন ব্যবহার অযোগ্য হয়ে পড়েছে। অযতœ আর অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে কয়েক কোটি টাকার সরকারী সম্পদ। ব্যাহত হচ্ছে প্রাণি সম্পদের বিস্তার।
সরকারী এ খামারের বাস্তব অবস্থা দেখতে আজ ২৬শে সেপ্টেম্বর দুপুর সাড়ে ১২টায় সরকারী হাঁস-মুরগীর খামার পরিদর্শনে আসছেন জাতীয় সংসদের মৎস্য ও প্রাণি সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১নং সাব-কমিটির আহবায়ক সংসদ সদস্য কামাল আহমেদ মজুমদার(ঢাকা-১৫) এবং সদস্য সংসদ সদস্য ইফতিকার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু(নেত্রকোনা-৩) ও সংসদ সদস্য খন্দকার আজিজুল হক আরজু(পাবনা-২)।
তারা সরকারী হাঁস-মুরগীর খামারের সদ্য সমাপ্ত ও চলমান প্রকল্পসহ প্রতিষ্ঠানের সার্বিক কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন। ১নং সাব-কমিটির পরিদর্শন কাজে সহায়তা করার জন্য সাথে থাকবেন কমিটির সচিব জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের উপ-সচিব(এজিএনআরসি) মোঃ মফিজুল ইসলাম, কমিটি শাখা-১৩ এর সহকারী সচিব মোঃ আব্দুল হামিদ ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ আতিকুর রহমান।
তাদের পরিদর্শনের বিষয়টি জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের কমিটি শাখা-১৩ এর ১৮/৯/২০১৭ইং তারিখের ১১.০০.০০০০.৭১৩.৩৭.০০৬.১৬.(সাব-০১)/১০৫ নং স্মারকের জারিকৃত এক অফিস আদেশে জানানো হয়েছে।
সরকারী এ সফরে কমিটির সদস্যবৃন্দ সকাল সাড়ে ৯টায় প্রথমে মানিকগঞ্জ মোরগ-মুরগী পালন কেন্দ্র পরিদর্শন করবেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় রাজবাড়ী সরকারী হাঁস-মুরগীর খামার পরিদর্শন শেষে বিকেল ৪টায় ফরিদপুর সরকারী হাঁস-মুরগীর খামার পরিদর্শনের উদ্দেশ্যে রাজবাড়ী ত্যাগ করবেন।
রাজবাড়ী সরকারী হাঁস-মুরগী খামারের বিদ্যমান সমস্যাসমূহ ঃ (১) বায়োসিকিউরিটি ঃ অফিস হতে মুরগীর শেডে যাওয়ার পথে কোনরকম প্রাচীর নাই। অফিস ও মুরগীর শেডের মাঝে ফুটবাথ নির্মাণসহ একটি লোহার গেট এবং খামারের প্রবেশ দরজায় ফুটবাথসহ শেডের সাথে ফুটবাথমেরামত করা প্রয়োজন। খামারের বায়েসিকিউরিটি বাউন্ডারী ওয়াল মাত্র ৫ ফুট উঁচু এবং বার্বিট ওয়ার সংযোজন করা নেই। বায়োসিকিউরিটি ব্যবস্থা সুদৃঢ় করতে সমগ্র খামারটির চারপাশে দেয়াল উঁচুকরণসহ বার্বিট ওয়ার সংযোজন করা প্রয়োজন।
(২) বৈদ্যুতিক সমস্যা ঃ খামারটি তৈরীর পর হতে অদ্যাবধি বৈদ্যুতিক লাইনে উল্লেখযোগ্য কোন মেরামত হয়নি। ফলশ্র“তিতে বৈদ্যুতিক লাইনের মেইন পোলটি মরিচা ধরে কয়েক জায়গায় ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে এবং মেইন সুইচ বোর্ড জরাজীর্ণ থাকায় যে কোন মূহুর্তে বড় ধরণের দুর্ঘটনার আশংকা রয়েছে।
(৩) পানি সরবরাহ ঃ পানির পাম্প দীর্ঘদিন যাবৎ নষ্ট। ফলে টিউবওয়েল চেপে মুরগীর শেড ও অফিসে পানি সরবরাহ করতে হয়। এছাড়া পাম্প হাউজ ও পানির ট্যাংক দীর্ঘদিনের পুরাতন ও জরাজীর্ণ। এগুলো জরুরী ভিত্তিতে মেরামত করা না হলে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। পানির সমস্যা সমাধানে জরুরী ভিত্তিতে একটি সাবমার্সিবল গভীর নলকূপ স্থাপনসহ ট্যাংক ও পাম্প হাউজ মেরামত অত্যাবশ্যক।
(৪) মুরগীর শেড ঃ সকল গ্রোয়ার শেড দীর্ঘদিনের পুরাতন, যা মুরগী পালনের প্রায় অযোগ্য। শেডগুলো জরুরী ভিত্তিতে মেরামত করা প্রয়োজন।
(৫) অফিস/বাসভবনসমূহ ঃ প্রশাসনিক ভবনের ছাদ হতে মাঝে মাঝে সিমেন্টের পলেস্তারা খসে পড়ছে। এছাড়া সকল বাসভবন বসবাসের অনুপযোগী ও পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। এগুলো মেরামত করা প্রয়োজন।
(৬) জনবল সংকট ঃ এ খামারে মোট ১৪টি অনুমোদিত পদের বিপরীতে বর্তমানে ৬জন কর্মরত আছেন। ৫জন অন্যত্র প্রেষণে কর্মরত এবং ৩টি পদ দীর্ঘদিন যাবৎ শূন্য রয়েছে।
ব্যবস্থাপক মোঃ মোশাররফ হোসেন বর্তমানে প্রেষণে ওটিআই সাভারে, পোল্ট্রি টেকনিশিয়ান ময়নাল হক মানিকগঞ্জ সরকারী মোরগ-মুরগী পালন কেন্দ্রে, ড্রাইভার আবদুস সোবহান প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে, পোল্ট্রি অ্যাটেনডেন্ট আলফাজ উদ্দিন পাবনা সদর উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসে এবং হ্যাচারী এ্যাটেনডেন্ট আলমগীর আকন পিরোজপুরের কাউখালী উপজেলা প্রাণি সম্পদ অফিসে প্রেষণে কর্মরত আছেন। এছাড়া অফিস সহকারী, ইলেক্ট্রিশিয়ান ও অফিস সহায়কের পদ দীর্ঘদিন যাবৎ শূন্য রয়েছে।
(৭) মাটি ভরাট ঃ খামারের পার্শ্ববর্তী রাস্তা ও এলাকা খামার থেকে প্রায় ৩/৪ ফুট উঁচু। ফলে বৃষ্টির পানিসহ অন্যান্য বর্জ্য গড়িয়ে খামারের মধ্যে চলে আসে। খামারটি উঁচু করতে ১০ হাজার ঘনফুট মাটি প্রয়োজন।
সম্ভাবনা ও অর্জনসমূহ ঃ (১) খামারটি হাঁস-মুরগীর খামার হলেও এখানে মূলতঃ মুরগীর বাচ্চা পালন করা হয়ে থাকে। এখানে বছরের বিভিন্ন সময়ে ফরিদপুর সরকারী হাঁস-মুরগীর খামার এবং কেন্দ্রীয় হাঁস-মুরগীর খামার, মীরপুর, ঢাকা হতে ১দিন বয়সের বাচ্চার চাহিদা দিয়ে প্রাপ্তি সাপেক্ষে পালন করা হয়। তবে সরকারী হাঁস-মুরগীর খামার, ফরিদপুর হতে লক্ষ্যমাত্রার সকল বাচ্চা নেয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। মুরগীর বাচ্চা পালনের জন্য ফেব্র“য়ারী, মার্চ, এপ্রিল ও মে মাস সবচেয়ে আবহাওয়া উপযোগী হওয়ায় উক্ত সময়ে বাচ্চা সংগ্রহের ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
(২) ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে এ খামারে মুরগীর বাচ্চা পালনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০ হাজার। বাচ্চা পালন করা হয়েছে ২০ হাজার ৪ শত, যা লক্ষ্যমাত্রার ১০২% অর্জিত হয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে ২০ হাজার বাচ্চা পালনের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আগস্ট, ২০১৭ মাস পর্যন্ত বাচ্চা পালন করা হয়েছে ৩ হাজার ৭২৫ টি, যাতে লক্ষ্যমাত্রার ১৮.৬৩% অর্জিত হয়েছে।
(৩) ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে মুরগীর বাচ্চা পালনে খাদ্য বাবদ খরচ হয়েছে ১১ লক্ষ ৬১ হাজার ৪৬৪ টাকা। মুরগীর বাচ্চা বিক্রয় বাবদ আয় হয়েছে ৯ লক্ষ ৫৬ হাজার ৯৪ টাকা। ঐ সময়ে ৩ হাজার ৫১৫টি মুরগীর বাচ্চা পালন চলমান ছিল এবং অবশিষ্ট টাকার খাদ্য গোডাউনে মজুদ ছিল। এ সময়ে ৯০৬টি মুরগীর বাচ্চার মৃত্যু হয়েছে, যার শতকরা হার ৪.৪৪%।
(৪) ২০১৭-২০১৮ অর্থ বছরে আগস্ট, ২০১৭ পর্যন্ত মুরগীর বাচ্চা পালনে খাদ্য বাবদ খরচ হয়েছে ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৬২২ টাকা। এ সময়ে মুরগীর বাচ্চা বিক্রয় হতে আয় হয়েছে ২ লক্ষ ৫৪ হাজার ৫১৮ টাকা। বর্তমানে ৩ হাজার ৪০৬টি বাচ্চা পালন চলমান আছে। বর্তমান অর্থ বছরে আগস্ট ২০১৭ পর্যন্ত ১১৯টি মুরগীর বাচ্চার মৃত্যু হয়েছে, যার শতকরা হার ৩.১৯%।
(৫) এই খামারটিকে হ্যাচারী খামারে উন্নীত করা হলে লোকসান কমিয়ে ব্যাপক লাভবান খামারে পরিণত করা সম্ভব। প্রয়োজন মোতাবেক বাচ্চা ফুটিয়ে বিক্রি করা ও বাচ্চা পালন করা হলে ব্যয়ের তুলনায় দ্বিগুণ লাভ করা সম্ভব হবে।
রাজবাড়ী শহরে ১৯৮২-১৯৮৩ সালে শহরের ভবানীপুরে প্রায় ৩একর জমির উপর নির্মিত এ খামারটির ধরণ হচ্ছে রিয়ারিং। এতে ৩টি গ্রোয়ার শেড এবং ১টি ব্র“ডার শেড রয়েছে। গ্রোয়ার শেডের প্রতিটি ২ হাজার বর্গফুটের এবং ব্র“ডার শেডটি ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের। খামারের অভ্যন্তরে কর্মকর্তাদের জন্য ৯৫০ বর্গফুট এবং কর্মচারীদের জন্য ৩ হাজার ৩০০ বর্গফুটের বাসভবন আছে। এর অফিস ভবন ৭ শত ৬০ বর্গফুট, বিক্রয় কেন্দ্র ২৫০ বর্গফুট এবং বিশ্রামাগার ৩৫০ বর্গফুটের।
সরকারী এই হাঁস-মুরগীর খামারটির অবকাঠামো উন্নয়ন ও মেরামত করে খামারটিকে বাচ্চা উৎপাদনের হ্যাচারীতে রূপান্তর করে জেলায় প্রাণি সম্পদ উন্নয়নে বিপ্লব ঘটবে বলে আশা জেলাবাসীর।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১নং সাব-কমিটির সদস্যবৃন্দ পরিদর্শন করে এর বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে সরকারের নিকট সুপারিশমালা পেশ করে এ খামারকে একটি লাভজনক খামারে উন্নীত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবেন বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করেন।