॥মাইদুল ইসলাম প্রধান॥ আলোচিত করোনা ভাইরাস বিশ্বের- ১২৭টি দেশের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশেও বিরাজ করছে। দেশের সন্দেহভাজন ১২০জনের পরীক্ষা শেষে ৩জন মানুষের শরীরে এই ভাইরাসের জীবানু ধরা পড়েছে। ৩জনের মধ্যে ২ জন ইতোমধ্যে চিকিৎসা শেষে বাড়ি চলে গেছেন। বাকী ১জনের চিকিৎসা চলছে। তারপরও দেশের মানুষ এক কথায় আতংকগ্রস্ত। হু হু করে দোকানগুলোতে মাস্কসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদির মূল্য ও বিক্রি বেড়ে গেছে। চড়াদামে মানুষ কিনছে এসব পণ্য। প্রশ্ন হচ্ছে, আতংকগ্রস্ত মানুষদের এমন অবস্থায় সরকার কি হাত গুটিয়ে বসে আছে? কোনভাবেই না। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও এই করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সরকার সর্বোচ্চ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে।
গত ২১শে জানুয়ারী, ২০২০ থেকেই সরকার এই ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সকল বন্দরে থার্মাল স্ক্যানার মেশিন বসানো হয়েছে এবং বিদেশ ফেরৎ যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৬ লাখ বিদেশ ফেরৎ যাত্রীদের দেশের বিভিন্ন প্রবেশদ্বারে স্ক্রিনিং করা হয়েছে। ২১শে জানুয়ারী থেকে ৭ই ফেব্রুয়ারী ২০২০ পর্যন্ত শুধু চীন ফেরৎ যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হলেও ৮ই ফেব্রুয়ারী থেকে এখন বিদেশ ফেরৎ সকল যাত্রীদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে। সরাসরি ফোন করার জন্য ৪টি হটলাইন ফোন ছিল। এছাড়াও নতুন আরো ৯টি হটলাইন চালু করা হয়েছে। করোনা ভাইরাস নিয়ে হটলাইনগুলোতে এ পর্যন্ত ৬হাজারের মতো ফোন এসেছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে দেশে ৩জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মাধ্যমে অন্যান্য মানুষের দেহে ছড়িয়ে যাবার আগেই কিংবা দেশে করোনা ভাইরাস আরো বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে গেলে স্বাস্থ্যখাতের প্রস্তুতি কেমন হবে। করোনা ভাইরাস ইস্যুটি নিয়ে কেবল কর্মকর্তা বা স্বাস্থ্যখাতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজে এই ভাইরাস প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিচ্ছেন। সুতরাং স্বাস্থ্যখাতের প্রস্তুতি নিঃসন্দেহে অনেক ভালোভাবেই সম্পন্ন হবে এটিই স্বাভাবিক। বাস্তবেও ঠিক তাই হচ্ছে।
দেশের সকল জেলা সদর হাসপাতালে ১০০ বেড, উপজেলা পর্যায়ে ৪০ থেকে ৬০ বেড, মেডিকেল কলেজগুলোতে ৩০০ বেড এবং রাজধানী ঢাকার কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রমক ব্যাধি হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালে ৫০০ থেকে ১০০০ বেড করোনা ভাইরাসের জন্য আইসোলেটেড রাখা হয়েছে।
উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি এবং ওসিসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি, জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, সিভিল সার্জনসহ ১১ সদস্যের আর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সভাপতি করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্যসচিব, অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সিনিয়র সচিব, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বাংলাদেশ প্রতিনিধি, ADB, UNICEF, USAID, World Bank-এর প্রতিনিধিসহ ৩১ সদস্যের একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিগুলো যখন যেখানে যে যে উদ্যোগ প্রয়োজন তা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে।
চীনের পাঠানো ট্রিটমেন্ট প্রটোকল ও দেশের ট্রিটমেন্ট প্রটোকল অনুযায়ী দেশের সংশ্লিষ্ট সরকারি হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদেশ ফেরত যাত্রীদের গৃহ কোয়ারেন্টিন করা হয়েছে। কার্যক্রমটি সমন্বয় করছেন আইইডিসিআর, জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তার কার্যালয়। সকল হাসপাতালে পিপিই (ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী) সহ অন্যান্য সকল চিকিৎসাসংক্রান্ত সামগ্রী সরবরাহ ব্যবস্থা হালনাগাদ করা হচ্ছে। WHO Ges US-CDC এর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে চিকিৎসা ও ল্যাবরেটরি সনাক্তকরণে সহায়তা নেয়া হচ্ছে।
আইইডিসিআর-এ কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু আছে। সার্বক্ষণিক সার্বিক পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। দৈনিক সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরার জন্য সাংবাদিক সম্মেলন ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস ও বাংলাদেশে বিদেশি দূতাবাসমূহের কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের এবং বিদেশে বাংলাদেশের যেসব নাগরিক কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়েছেন ও কোয়ারেন্টিনে পর্যবেক্ষণে আছেন তাঁদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখা হচ্ছে।
বেসরকারী হাসপাতালে আইসোলেশন ইউনিট খোলার জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। জনসাধারণের বিভিন্ন জিজ্ঞাসার জবাবের চাহিদা মেটাতে ও গুজব নিরসনে আইইডিসিআর-এর ওয়েবসাইটে প্রশ্ন ও উত্তর আপলোড করা হয়েছে। জনসাধারণের জিজ্ঞাসার জবাব ও গুজব নিরসনের জন্য ফেসবুক গ্রুপ ‘প্লাটফর্ম’ এর সহযোগিতায় জনস্বাস্থ্য বার্তা প্রচারিত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএস সিডিসি, ইউএসএইড প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
বিদেশ থেকে আসা বিদেশি নাগরিকদের করণীয় সম্পর্কে অবহিত করার জন্য সকল বিদেশি দূতাবাসসমূহে পত্র প্রেরণ করা হয়েছে। তাঁরা নিয়মিতভাবে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণ কক্ষে কোয়ারেন্টিনকৃত চীনা নাগরিকদের তথ্য প্রেরণ করছেন। বাংলাদেশ থেকে কেউ বিদেশে অত্যাবশ্যকীয় ভ্রমণে গেলে অনুসরণীয় স্বাস্থ্যবিধি প্রস্তুত করা হয়েছে।
বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি ১ থেকে ৩ এ উন্নীত হওয়ায় হটলাইনের সংখ্যা ৪টি থেকে বাড়িয়ে ১২টি করা হয়েছে। হটলাইনের নম্বর: ০১৪০১১৮৪৫৫১, ০১৪০১১৮৪৫৫৪, ০১৪০১১৮৪৫৫৫, ০১৪০১১৮৪৫৫৬, ০১৪০১১৮৪৫৫৯, ০১৪০১১৮৪৫৬০, ০১৪০১১৮৪৫৬৩, ০১৪০১১৮৪৫৬৮, ০১৯২৭৭১১৭৮৪, ০১৯২৭৭১১৭৮৫, ০১৯৩৭০০০০১১ এবং ০১৯৩৭১১০০১১ থেকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করা হবে।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে নিয়মিত সাবান ও পানি দিয়ে দুই হাত ধোয়া (অন্তত ২০ সেকেন্ড যাবৎ); অপরিষ্কার হাতে চোখ, নাক ও মুখ স্পর্শ না করা; ইতোমধ্যে আক্রান্ত এমন ব্যক্তিদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা; কাশি শিষ্টাচার মেনে চলা(হাঁচি/কাশির সময় বাহু/ টিস্যু/ কাপড় দিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখা); অসুস্থ পশু/পাখির সংস্পর্শ পরিহার করা; মাছ-মাংস-ডিম ভালোভাবে রান্না করে খাওয়া; অসুস্থ হলে ঘরে থাকা, বাইরে যাওয়া অত্যাবশ্যক হলে নাক-মুখ ঢাকার জন্য মাস্ক ব্যবহার করা; কারো সাথে হাত না মেলানো(হ্যান্ড শেক না করা), কোলাকুলি থেকে বিরত থাকা; জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত বিদেশ ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকা এবং এ সময়ে অন্য দেশ থেকে প্রয়োজন ব্যতীত বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করা; অত্যাবশ্যকীয় ভ্রমণে সাবধানতা অবলম্বন করা।
করোনা ভাইরাসের এর বিষয়ে কারণে দেশে হঠাৎ করে কিছু অসাধু মানুষ মাস্কের মূল্য বৃদ্ধিসহ এর কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণের বেশি মূল্যে এই মাস্ক বিক্রি করা হচ্ছে। এটি অনৈতিক কাজ। দেশের সংকটকালে মাস্কের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে মনিটরিং করাসহ অপরাধ প্রমাণিত হলে অসাধু ব্যবসায়ীদের ড্রাগ লাইসেন্স বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
করোনা ভাইরাস স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সীমাবদ্ধতা যে নেই তা নয়। দেশের হাসপাতালগুলো রোগী দিয়ে প্রতিদিনই পূর্ণ থাকে। নতুন সাড়ে ৫ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হলেও আরো অনেক সংখ্যক চিকিৎসক প্রয়োজন। ১৫ হাজার নার্স নিয়োগের কাজ সবেমাত্র সচল হয়েছে। কাজেই করোনা ভাইরাস ব্যাপক হারে ছড়িয়ে গেলে এটিকে প্রতিরোধ করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হবে বলেই বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। এক্ষেত্রে ব্যক্তি সচেতনতার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে সরকার সর্বাধিক প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের স্বাস্থ্যখাত যেভাবে গত বছর এক লাখ ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে এবং ইবোলা, সার্স প্রতিরোধে কাজ করেছে এবারো করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সেভাবেই সফল হবে বলেই বিশ্বাস রাখা যায় -পিআইডি ফিচার।