বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১০ অপরাহ্ন
Logo
সংবাদ শিরোনাম ::
বিশ্বব্যাপী ওমিক্রন সংক্রমণ বৃদ্ধিতে আইসোলেশন মেয়াদ অর্ধেক করার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ওমিক্রন ভেরিয়েন্ট ডেল্টা ও বিটার তুলনায় তিন গুণের বেশী পুনঃ সংক্রমন ঘটাতে পারে : গবেষণা প্রতিবেদন জাতিসংঘ ভবনের বাইরে এক বন্দুকধারী গ্রেফতার শান্তি চুক্তির পঞ্চম বার্ষিকী উপলক্ষে কলম্বিয়া সফর জাতিসংঘ মহাসচিব সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে তিন বাহিনীর প্রধানগণের সাক্ষাৎ করোনা ভাইরাসের সংক্রমন বেড়ে যাওয়ায় অস্ট্রিয়ায় লকডাউন করোনা সংক্রমণ বাড়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ ভারতে নতুন করে ১০ হাজার ৩০২ জন করোনায় আক্রান্ত নভেম্বর মাসজুড়ে করাঞ্চলে কর মেলার সেবা পাবেন করদাতারা ঔপনিবেশিক আমলের ফৌজদারী কার্যবিধি যুগোপযোগী হচ্ছে

সাড়ে চার ঘন্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম ভ্রমণ

  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ৫ মার্চ, ২০২০

॥আবু নাছের টিপু॥ কয়েক বছর পর দেশে ফিরেছেন সাজ্জাদ সাহেব। পরিবার-পরিজন থাকে চট্টগ্রামে। শেষবার যখন দেশে এসেছিলেন, তখন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার যে ভোগান্তি তা এখনও তাকে পীড়া দেয়। তাই আগে থেকেই তিনি বড় ছেলেকে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের টিকেট কেটে রাখতে বলেছিলেন। কিন্তু ছেলে তা করেনি। মনে শঙ্কা নিয়ে দুপুরের পর সড়ক পথেই তিনি চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন ঢাকা থেকে।
গাড়ী যতোই এগিয়ে যায় সাজ্জাদ সাহেব ততই বিস্মিত হন। এর আগে যাত্রাবাড়ী থেকে কাঁচপুর সেতু পার হতে আড়াই ঘন্টা সময় লেগেছিলো। কিন্তু আজ ভিন্ন দৃশ্যপট, ভিন্ন অভিজ্ঞতা। ছেলের ওপর মনের ভেতর যে রাগ ছিলো তা কাটতে শুরু করেছে। পাঁচ মিনিটে পেরিয়ে গেলেন মেয়র হানিফ উড়াল সেতু। সাজ্জাদ সাহেবের মনে পড়ে বিদেশ যাবার আগে ভিসার কাজে একবার ঢাকা এসেছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে ভালোয় ভালোয় ঢাকায় আসেন, কিন্তু শনির আখড়ার পর গাড়ী আর এগোয় না। পাক্কা দু’ঘন্টা বসে থেকে শহরে ঢুকলো। কী কষ্ট! অথচ আজ পাঁচ মিনিটেই পেরিয়ে গেল যাত্রাবাড়ী। অপার বিস্ময় তার চোখে-মুখে। শুধু তাই নয়, কাঁচপুরে কোন যানজট নেই। চার লেনের নুতন সেতু। পাশে পুরনোটি, দেখতে নতুনের মতোই। সেতু হতে নামতে গিয়ে দেখলেন দৃষ্টিনন্দন ওভারপাস। যার উপর দিয়ে চট্টগ্রামমুখী বাস আর নীচ দিয়ে সিলেটমুখী। দারুণ ব্যবস্থাপনা।
গাড়ী গিয়ে পৌঁছাল মেঘনা সেতুর টোল প্লাজায়। নেই সেই পুরনো দৃশ্যপট। ডানপাশের ফাস্ট ট্রাক লেনে গাড়ী ঢুকে পড়লো অনায়াসে। টোল বুথের বাঁধাটি আপনা-আপনি সরে গেল। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে আদায় হলো টোল। গাড়ী থামাতে হলো না। ছেলের মোবাইলে সাথে সাথে এসএমএস এলো, তার একাউন্ট থেকে টোলের সমপরিমাণ টাকা কর্তন করা হয়েছে। ছেলে বাবাকে এসএমএস দেখায়। কয়েক বছর পর দেশে ফেরা বাবার চোখে-মুখে বিস্ময়। এভাবেইতো বিদেশে টোল আদায় করা হয়। সাজ্জাদ সাহেব এতক্ষণে বুঝতে শুরু করলেন বদলে যাওয়া বাংলাদেশের গল্প। শঙ্কা নিয়ে শুরু করা ভ্রমণ ধীরে ধীরে আনন্দে রূপ নিতে শুরু করেছে।
সাজ্জাদ সাহেব হাতঘড়ি দেখলেন। মাত্র পঞ্চাশ মিনিটে পার হয়ে এলেন দাউদকান্দি সেতু, যা ছিলো একসময় স্বপ্নের মতো। চার লেনের মহাসড়ক ধরে গাড়ী এগিয়ে চলে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দিকে। এ মহাসড়ক দেশের অর্থনীতির লাইফ লাইন। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানী-রপ্তানী বাণিজ্যের সিংহভাগই এ পথে হয়। যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের নতুন মাত্রা যোগ করেছে চার লেনে উন্নীত এ মহাসড়ক।
সাজ্জাদ সাহেবের মনে প্রশ্ন জাগে, চার লেন হওয়ার পরও কেন তবে যানজট লেগেছিলো? ছেলে বাবাকে বুঝিয়ে দেয়; এতদিন মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত হলেও মেঘনা আর গোমতি সেতু ছিলো দুই লেনের। এর ফলে সেতুর প্রান্তে সৃষ্টি হতো যানজট। জট বাড়ার সাথে সাথে ভোগান্তি বাড়তো যাত্রীদের। এ বাস্তবতায় সরকার ৩টি নতুন সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ৩টি সেতুই চার লেনের। পাশাপাশি নেয় পুরনো সেতু সংস্কারের উদ্যোগ।
জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা(জাইকা) এগিয়ে আসে। প্রায় ৮ হাজার ৫শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করে প্রকল্প। গেল বছর ঈদ-উল-ফিতরের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী নতুন সেতু ৩টি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। এ বছর ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহে পুরাতন সেতু ৩টি সংস্কার শেষে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী।
সাধারণত প্রকল্প বাস্তবায়নে কোন কোন ক্ষেত্রে দেখা দেয় ধীর গতি। এক্ষেত্রে ৩টি সেতু নির্মাণ এবং পুরাতন ৩টি সেতু সংস্কারে বাস্তবায়িত প্রকল্পটি দেশে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে। ৮হাজার ৫শ’ কোটি টাকার প্রকল্প থেকে সাশ্রয় হয়েছে ১হাজার ৩৮৮ কোটি টাকা। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে এটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। এছাড়া নতুন ৩টি সেতুর নির্মাণ কাজ নির্দিষ্ট সময়ের ৬ মাস আগে এবং বিদ্যমান ৩টি সেতুর সংস্কার কাজও সময়ের আগেই শেষ হয়েছে।
গাড়ী এগিয়ে চলে। ধীরে ধীরে মন ভালো হতে থাকে সাজ্জাদ সাহেবের। প্রশস্ত সড়কের দু’পাশে বিস্তৃত সবুজ। মাঘের সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। চারদিকে গোধূলির আভা। সড়ক বিভাজনে লাগানো ফুল গাছে ফুটেছে নানান রঙের ফুল। কোথাও রক্ত করবি, কোথাও রাধা চূড়া। প্রস্ফুটিত ফুল ভ্রমণ আনন্দ বাড়িয়ে দিয়েছে বহু গুণ। কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম আন্ডারপাস। সেনানিবাসের দু’পাশের বসতিকে যুক্ত করেছে পাতাল সংযোগ।
মহাসড়ক দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচল করছে যাত্রীবাহী এবং পণ্যবাহী পরিবহন। দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে এ মহাসড়কে যানবাহন চলাচলের চাপ দিন দিন বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্যবাহী যানবাহন আগে শহরের ভিতর দিয়ে মহাসড়কে আসতো। ফৌজদারহাট থেকে বন্দর পর্যন্ত নির্মিত বাইপাস এবং বন্দর সংযোগ উড়াল সেতু নির্মাণের ফলে পণ্যবাহী যানবাহনের শহরকে বাইপাস করে সরাসরি মহাসড়ক হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত সহজতর হয়েছে।
মহাসড়কের স্থায়িত্ব সুরক্ষায় সরকার যানবাহনের অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে প্রণয়ন করেছে এক্সেল লোড কন্ট্রোল নীতিমালা। মেঘনা সেতুর টোল প্লাজা ছাড়াও সীতাকুন্ডে স্থাপন করা হয়েছে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। এর ফলে মহাসড়কে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনা উন্নত হয়েছে। কমে এসেছে যানজট। চার লেনের ফলে যানবাহনের মুখোমুখি সংঘর্ষের যে দুর্ঘটনা ঘটতো তা বন্ধ হয়েছে। সময় অর্ধেকে নেমে আসায় ব্যবসায়ীরা লাভবান হচ্ছে।
এরই মাঝে সরকার দেশের প্রধান প্রধান মহাসড়ক পর্যায়ক্রমে চার লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক-এডিবি’র অর্থায়নে ইতিমধ্যে ১ হাজার ৭৫২ কিলোমিটার মহাসড়কের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ, পাচ্চর-ভাঙ্গা পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। এডিবি’র অর্থায়নে গাজীপুর-এলেঙ্গা মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ শেষ হতে চলেছে। শুরু হয়েছে এলেঙ্গা-রংপুর চার লেনের কাজ। ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের কাজ মার্চ মাসে শেষ হতে যাচ্ছে। এটি দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে। চার লেন ছাড়াও এ মহাসড়কের দু’পাশে ধীরগতির যানবাহনের জন্য থাকছে দু’টি আলাদা লেন। এছাড়া ঢাকা বাইপাস সড়ক, ময়নামতি-বেগমগঞ্জ-সোনাপুর, ফেনী-চৌমোহনী, কক্সবাজারের মাতারবাড়ী সংযোগ সড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ কাজ শুরু হয়েছে।
পথিমধ্যে হাইওয়ে সংলগ্ন রেস্টুরেন্টে সংক্ষিপ্ত চা বিরতি শেষে আবার চলতে শুরু করেন সাজ্জাদ সাহেব। কুমিল্লার পদুয়ার বাজার আর ফতেপুর রেলওয়ে ওভারপাস পেরিয়ে গাড়ী এগিয়ে চলে। আগে এ দু’টি স্থানে ট্রেন আসা-যাওয়ার জন্য অনেক সময় বসে থাকতে হতো। এখন আর সে ঝামেলা নেই। ফেনীর মহিপালে ছয় লেনের ফ্লাইওভারে জ্বলে ওঠেছে উজ্জ্বল আলো। এ আলোর বন্যায় এক নূতন বাংলাদেশ দেখতে পান তিনি। তার মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। গাড়ীর জানালার কাঁচ নামিয়ে দেন। ছুটে চলা গাড়ীতে বসে প্রিয় জন্মভূমির স্নিগ্ধ বাতাস শরীরে মাখেন। প্রিয় সন্তানের কাছে শুনতে থাকেন সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের কথা। চট্টগ্রামকে ঘিরে সরকারের নানা পরিকল্পনার কথা। এর মধ্যে কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের প্রায় অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে বলে জানতে পারেন তিনি। এ টানেলের প্রায় ১৩শ’ মিটার খনন কাজ সম্পন্ন হয়েছে। নির্মাণ কাজ শেষ হলে বদলে যাবে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের দৃশ্যপট। নদীর ওপাড়ে গড়ে উঠবে আরেক শহর। সম্প্রসারিত হবে ব্যবসা-বাণিজ্য। এ উন্নয়ন যজ্ঞের সাথে মিল রেখে চট্টগ্রাম হতে দেশের পর্যটন নগরী কক্সবাজার পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। ওদিকে পর্যটকদের মন কেড়েছে নয়ন মনোহর কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ।
সাজ্জাদ সাহেবের গাড়ী সিটি গেট হয়ে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেছে। ঘড়ি দেখে অবাক তিনি। মাত্র সাড়ে চার ঘন্টায় রাজধানী শহর থেকে বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। নেই কোন ভ্রমণ ক্লান্তি। এতদিন প্রবাসে দেশের কতো নেতিবাচক গল্প শুনেছেন। আজ নিজ চোখে দেখে বিস্মিত হলেন। দেখলেন অদম্য গতিতে এগিয়ে যাওয়া এক নতুন বাংলাদেশ। অন্যান্য খাতের সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যব্যস্থার উন্নয়নে তিনি মুগ্ধ। মুগ্ধতার রূপালী পরশ শরীর আর মন ছুঁয়ে যায়। আনন্দময় ভ্রমণের রেশ ধরে রেখেই দীর্ঘদিন পর দেশে ফেরা সাজ্জাদ সাহেব প্রবেশ করেন জাকির হোসেন সড়কে নিজ বাড়ীর আঙ্গিনায়। -পিআইডি ফিচার।

নিউজটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরো খবর
error: আপনি নিউজ চুরি করছেন, চুরি করতে পারবেন না !!!!!!