তাদের হুঁশিয়ার করতে চাই-দলের মধ্যে বিভেদ তৈরী
করবেন না —সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী
॥সুশীল দাস/চঞ্চল সরদার॥ রাজবাড়ী সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন গতকাল ৮ই ডিসেম্বর দুপুরে জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয় চত্বরে অনুষ্ঠিত হয়।
বেলা ১২টার দিকে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের সাথে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন এবং শান্তির প্রতীক কবুতর অবমুক্ত করার মধ্য দিয়ে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়।
সম্মেলনের প্রথম পর্বের আলোচনায় প্রধান অতিথি হিসেবে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম বক্তব্য রাখেন এবং প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী।
সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোঃ রমজান আলী খানের সভাপতিত্বে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক শেখ মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান ওহিদ।
জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অসীম কুমার পালের সঞ্চালনায় অন্যান্যের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মোঃ আব্দুস সাত্তার মিয়া, শেখ আব্দুস সোবহান, এডঃ গণেশ নারায়ণ চৌধুরী, যুগ্ম-সাধারণ সাধারণ সম্পাদক এডঃ শফিকুল আজম মামুন, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এডঃ সফিকুল হোসেন সফিক, রাজবাড়ী পৌর আওয়মী লীগের সভাপতি এডঃ মোঃ উজির আলী শেখ, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক রাজু ও শহীদওহাবপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদ প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম বলেন, আমি মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেনের সাথে রাজনীতি করেছি। যখন রাজবাড়ী সরকারী কলেজে পড়তাম তখন বাড়ীতে গিয়ে তার সাথে দেখা করতাম। তিনি আমাদেরকে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করতেন। সংগঠন চালানোর জন্য টাকা-পয়সা দিতেন। তার স্ত্রী আমাদেরকে সন্তানের মতো ¯েœহ করতেন। তখন রাজবাড়ীতে এসএসসি পরীক্ষার একমাত্র কেন্দ্র ছিল বলে পাংশা, বালিয়াকান্দি ও কালুখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পরীক্ষার্থীরা তার বাড়ীতে থেকে পরীক্ষা দিত। এমন কাউকে পাওয়া যাবে না যার পেটে তার হাতের রান্না খাবার যায়নি। এরই ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ধরে কেরামত ও ইরাদতের সাথে রাজনীতি করে আসছি।
তিনি বলেন, পঁচাত্তর পরবর্তী দুঃসময়ে কাজী ইরাদতই আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিল। ওয়াজেদ আলী চৌধুরী মারা যাওয়ার পর সেই নমিনেশন পাওয়ার দাবীদার ছিল। কিন্তু মায়ের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানিয়ে সে তার বড় ভাই কাজী কেরামত আলীকে ছেড়ে দেয়। কেরামত কখনো আওয়ামী লীগ করতো না। সে করতো ছাত্র ইউনিয়ন। নমিনেশন পাওয়ার পর থেকে সে আওয়ামী লীগ করা শুরু করে। কাজী ইরাদত আলী না চাইলে, সহযোগিতা না করলে সে ৫বার এমপি হতে পারতো না। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতে পারতো না। আজকে যারা কেরামতের চারপাশে রয়েছে তারা সবসময়ই কেরামতের নমিনেশন পাওয়ার, সেক্রেটারী হওয়ার বিরোধিতা করেছে। এখন তারা হয়েছে পিরিতের কান্ডারী। তাদের সাথে আমার(জিল্লুল হাকিমের) জমিজমা, টাকা-পয়সা বা অন্য কিছু নিয়ে বিরোধ নেই। শুধুমাত্র কেরামতের পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তাদের সাথে আমার সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। আমি কেরামতকে বলেছি, যারা আগে তোমাকে সবসময় বাঁশ দেয়ার চেষ্টা করতো-সামনে তারাই সময়মতো তোমাকে বাঁশ দেবে। কয়েকদিন আগে ডিসির রুমে এসপি আমাকে বললেন, স্যার আপনি দুই ভাইয়ের মিল করে দেন। তখন তাকে বললাম আমি ৩বার বসেছি তাদেরকে নিয়ে। কিন্তু যে সিদ্ধান্ত হয়েছে কেরামত তাতে অটল থাকতে পারে নাই। বাড়ীতে যাওয়ার পরই সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে গেছে। তার বোধোদয় না হলে কোনভাবেই মিল করা সম্ভব না।
তিনি আরো বলেন, কেরামত অভিযোগ করেছে যে, তার কাছ থেকে নাকি জোর করে সাধারণ সম্পাদকের পদ লিখে নেয়া হয়েছে-এটা সম্পূর্ণ অসত্য কথা। কেরামত বলেছিল আমি এমপিগিরি করবো, আর ইরাদত দলের বিষয়গুলো দেখবে। সে জন্য এই আওয়ামী লীগ অফিসে বসেই সে স্বেচ্ছায় আমাদের সামনে ইরাদতকে লিখিতভাবে সাধারণ সম্পাদকের পদ লিখে দিয়েছে। এখন সেটা সহ্য হচ্ছে না বলে মিথ্যাচার করছে। এখন নাকি আবার তার সভাপতি হওয়ার খায়েশ হয়েছে। তাদের ধারণা সামনে ওহি নাজিল হবে এবং সে সভাপতির পদ পেয়ে যাবে। ভোটাভুটিতে গেলে তো সে যে পারবে না তা ভালোভাবেই জানে। এ জন্যই সে ওহি নাজিলের মাধ্যমে সভাপতি হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু তার সে আশা কখনো পূরণ হবে না। যে একবার পদ ছেড়ে দিয়েছে, জননেত্রী শেখ হাসিনা নিশ্চয়ই আবার তাকে পদ দিবেন না।
এমপি মোঃ জিল্লুল হাকিম আরও বলেন, দৌলতদিয়ার নূরু মন্ডলের পতন হয়েছে- তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। আমার ঘাটের টাকার প্রতি, পতিতাপল্লীর টাকার প্রতি কোন লোভ নাই। আল্লাহ্ আমাকে যা দিয়েছে, সৎভাবে আমি যা আয় করি তা দিয়ে পরিবার নিয়ে ভালোই আছি। ৬বার জেলার সেরা করদাতা হয়েছি। বর্তমান এসপি আসার পর থেকে ঘাটে নূরু মন্ডলের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। আয় বন্ধ হওয়ার কারণে নূরু মন্ডলের যারা পৃষ্ঠপোষক তাদেরও আয় বন্ধ হয়ে গেছে। টাকা বন্ধ হওয়ায় মাথা নষ্ট হয়ে উল্টাপাল্টা করছে। গত শনিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে তারা বলেছে আমি নাকি পাংশা, কালুখালী, বালিয়াকান্দিতে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে আমার ইচ্ছামতো কাউন্সিল করেছি. একদিনে নাকি ২/৩টি কাউন্সিলও করেছি। আমি আমার এলাকায় এমন কোন কাজ করি না যাতে আমার প্রতি নেতাকর্মীদের আস্থার হানী ঘটতে পারে। আমার এলাকায় আমি নিয়মতান্ত্রিকভাবেই কাউন্সিল করেছি, সেখানে কোন অনিয়ম হয়নি। সাংবাদিক সম্মেলনে ধার করা, কাউন্সিলে হেরে যাওয়া কয়েকজনকে হাজির করা হয়েছিল। সেখানে আজকের এই সম্মেলনে না আসার জন্য নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছিল, কিন্তু কেউ তাতে সাড়া দেয়নি।
তিনি বলেন, গত পৌর নির্বাচনে ইরাদত সহযোগিতা না করলে মহম্মদ আলী চৌধুরী মেয়র হতে পারতো না। নির্বাচনের আগে কতো হাত-পা ধরাধরি, অথচ যখন জিতলো তখনই বলে বসলো নিজের জোরেই সে জিতেছে। ওবায়দুল কাদের সম্মেলন স্থগিত করার পর আমরা গিয়ে বললাম, যাদের পিছনে কর্মী নাই, কোমরে জোর নাই তারা বলছে আর আপনি বন্ধ করে দিলেন-আমাদের কাছে জানারও প্রয়োজন মনে করলেন না। আমরা যারা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক তারা কী ঘাস কাটি নাকি। তখন তিনি মৃদু হেসে বললেন, আমি সম্মেলন বন্ধ করার জন্য কোন চিঠি দিছি নাকি যে তোমরা সম্মেলন বন্ধ করছো-যাও তোমাদের কাজ কর গিয়ে।
এমপি জিল্লুল হাকিম বলেন, গত ২দিন আগে আমি নেত্রীর সাথেও দেখা করে তাকে সবকিছু বলেছি। বিগত ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচনে নমিনেশন নিতে প্রার্থীদের কতো হাদিয়া দেওয়া লাগছে তা অনেকেই জানে। আমার এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখেন কোন চেয়ারম্যান প্রার্থীর কাছ থেকে একটি টাকাও নেয়া হয়নি। বরং যেসব প্রার্থী দুর্বল ছিল তাদেরকে টাকা দিয়ে পাস করিয়েছি। তারা বলছে ইরাদত সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর থেকে দলকে বিভক্ত করে ফেলছে। আকামের বিরুদ্ধে কথা বললেই কী দলকে বিভক্ত করা হয়। আসুন আমরা একসাথে কাজ করে দলকে শক্তিশালী করি। আমি কোনদিন চাকরী দেয়ার বিনিময়ে বা চাকরী দেয়ার লোভ দেখিয়ে কারো কাছ থেকে টাকা নেই নাই। এজন্য রাজবাড়ী থেকেই অনেকে আমার কাছে কাগজপত্রে সুপারিশ করানোর জন্য যায়।
তিনি আরো বলেন, আজকে ইরাদত নিঃস্বার্থভাবে দলের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। তার বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। কিন্তু আপনারা সবই জানেন কে সঠিকভাবে কাজ করছে, কে অন্যায় করছে। দিন আসছে, আপনাদেরকেই সাদা-কালো বেছে নিতে হবে।
প্রধান বক্তার বক্তব্যে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলী বলেন, আমরা কেন্দ্রের নির্দেশনা মোতাবেক সংগঠনকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কাউন্সিল করছি। দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে যারা বিতর্কিত ব্যক্তি তাদেরকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বিরত রেখেছি। সফলভাবে কাউন্সিলগুলো সম্পন্ন করেছি। যারা পালকি রেস্টুরেন্টে সাংবাদিক সম্মেলন করেছে তাদেরকে বলবো এখানে এসে দেখে যান। আপনারা নেতাকর্মীদের এই সম্মেলন বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন কিন্তু তারা তা করে নাই। তারা বলেছে সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে যে সম্মেলন হয়েছে সেটা গঠনতান্ত্রিকভাবে হয় নাই। তার মানে ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং ওয়ার্ডে যারা ভোটের মাধ্যমে হয়েছেন আপনারা অবৈধ। নতুন কাউন্সিলের মাধ্যমে ইউনিয়নে ইউনিয়নে গিয়ে কমিটি করবে। আপনারা তাদের এই স্বেচ্ছাচারীতার জবাব দিবেন। আমি কোন ইউনিয়নের কাউন্সিল নিয়ে হস্তক্ষেপ করি নাই। আমার পছন্দমতো কমিটি চাপিয়ে দেই নাই। অনেক কাউন্সিলে এমপিও ছিলেন। আপনারা ৫বার তাকে এমপি বানানোর জন্য কষ্ট করেছেন, ভোটে জয়ী করিয়েছেন। ৪বার তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন। সেখানে কী আমার-আপনাদের কোন ভূমিকা নেই।
কাজী ইরাদত আলী আরো বলেন, তিনি(এমপি কাজী কেরামত আলী) যাদের নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন করছেন তারা সবসময় চাইতো তিনি যেন এমপি হতে না পারেন, সেক্রেটারী হতে না পারেন। আজকে তাকে ভুল বুঝিয়ে এটা করানো হচ্ছে। আমি আমার বড় ভাইয়ের প্রতি অনুরোধ জানাচ্ছি, ওদের খপ্পড় থেকে বের হয়ে জনগণের মধ্যে আসুন। নূরু মন্ডল কে, তার কর্মকান্ড-সবকিছু সম্পর্কেই আপনারা জানেন। সে গোয়ালন্দের সম্মেলনের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রদীপ্ত চক্রবর্তী কান্তর উপর ন্যাক্কার জনকভাবে হামলা করিয়েছিল। ওই ঘটনায় দলীয়ভাবে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির তদন্তে নূরু মন্ডলের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। আজকে সেই বিতর্কিত নূরু মন্ডলকে রক্ষায় তারা উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক কাজ করছি, কারো ব্যক্তি স্বার্থের জন্য নয়। আপনি যাদের ভোটে সংসদ সদস্য, আজ দল আছে বলেই আপনি মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান তারাই বলেন কমিটি বিতর্কিত। অথচ তাদের পরিশ্রমেই আপনার আজকে গদির সুবিধা ভোগ করছেন। কোন কাউন্সিলে আপনারা উপস্থিত হন না। আমি হুঁশিয়ার করতে চাই, দলের মধ্যে বিভেদ তৈরী করবেন না। আমরা আওয়ামী লীগ পরিবার একই পরিবার। আসুন আমরা সবাই কাঁধ কাঁধ মিলিয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করি।
দ্বিতীয় পর্বে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিমের সভাপতিত্বে এবং ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক কাজী ইরাদত আলীর পরিচালনায় কাউন্সিল অধিবেশনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুনরায় রমজান আলী খানকে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং শেখ মোঃ ওয়াহিদুজ্জামান ওহিদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।