॥রবিউল খন্দকার মজনু॥ স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হলেও জীবন যুদ্ধের পরাজিত সৈনিক বীরযোদ্ধা সাধন কুমার চক্রবর্তী। অযত্ন-অবহেলা আর বিনা চিকিৎসায় ছোট্ট ঝুপরি ঘরে মৃত্যুর প্রহর গুণছেন তিনি।
১৯৭১ সালে দেশকে পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ভারতের কল্যাণী ক্যাম্পে ট্রেনিং শেষে দেশে এসে যুদ্ধ অংশ গ্রহণ করে শত্রুদের পরাজিত করেন। আর আজ এই মুক্তিযোদ্ধার স্থান হয়েছে রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ ইউনিয়নের বেলগাছী পুরাতন বাজার এলাকার ২শত বছরের পুরনো মন্দিরের পিছনের একটি ঝুপরি ছাপড়া ঘরে। যার মধ্যেই তার জীবন সীমাবদ্ধ। সেই ঘরে কোন আলো-বাতাস ঢোকার ব্যবস্থা। নেই থাকার জন্য কোন ভালো বিছানা। উপরে টিন আর নীচে মাটি। এই মাটিই তার বিছানা। ঝড়-বৃষ্টি হলেই কাঁদা হয়ে যায় তার এই মাটির বিছানা। তার শরীর শুকিয়ে জীর্ণশীর্ণ। ভাঙ্গাচোড়া ঝুপরি ঘরের মেঝেতে এভাবেই বেঁচে আছেন মৃত্যুপথযাত্রী দেশের এই সূর্য সন্তান। মরণেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়, কবর আর চিতাতেই শেষ আশ্রয়। হয়তো একদিন এই মানুষটি মৃত্যুবরণ করে পড়ে থাকবে, কেউ জানতেও পারবে না। হয়তো মৃত্যুর কয়েকদিন পর লাশ পঁচে দুর্গন্ধ বের হলে তবেই জানা যাতে তার মৃত্যুর খবর। এখন এই মৃত্যুই যেন তার জীবনের সকল সমস্যার সমাধান।
তবে সাধন কুমার চক্রবর্তীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কোন সনদ নেই। স্থানীয় এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, সুস্থ থাকা অবস্থায় তিনি রাজবাড়ীর মুক্তিযোদ্ধা কমন্ডার থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় পর্যন্ত গিয়ে শত চেষ্টা করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ সংগ্রহ করতে পারেননি। তার শৈশবও ছিল কষ্টে ভরা।
বর্তমান কালুখালী উপজেলার রতনদিয়া ইউনিয়নের মহেন্দ্রপুর গ্রামে ভৈরব কুমার লাহিরীর বাড়ীতে বড় হন তিনি। ১৯৭৬ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। তিনি চিরকুমার। মামার পরিবার অন্যত্র চলে যাওয়ায় আশ্রয়হীন হয়ে পড়েন তিনি। তার ব্যক্তিগত কোন জমি-জমা বা আশ্রয় ছিল না। যার জন্য তিনি দীর্ঘ প্রায় ৩০/৩৫ বছর বিভিন্ন পরিবারে লজিং মাস্টার হিসেবে থাকতেন। সকলেই তাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো। বছর তিনেক আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। ওই সময় তিনি থাকতেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রঞ্জু চৌধুরীর কাচারী ঘরে।
বেলগাছীর আরশিনগর বাউল সংঘের প্রতিষ্ঠাতা আশরাফুল আলম আক্কাস বলেন, এই মুক্তিযোদ্ধার বিষয়ে প্রতিবাদ করায় হিন্দু সম্প্রদায়ের বাবুদের টনক নড়েছিল। সাধন চক্রবতী উচ্চ বর্ণের হিন্দু হওয়ায় তাকে স্থান দেওয়া হয় শ্রী শ্রী গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর মন্দিরের আশ্রমে। স্থানীয় গণ্যমান্য হিন্দুদের তত্ত্বাবধানে তাকে দেখভাল ও সেবা-সুশ্রুষা করার কথা ছিল। কিন্তু আজ শুনছি তার কোন খোঁজই রাখেন না কেউ-ভাবতে অবাক লাগে।
ডাঃ অপূর্ব কান্তি সাহা বলেন, সাধন চক্রবর্তী একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু তিনি কোনদিনই নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিতে চাননি। ঘর-সংসারও করেননি। জীবন-সংসার কী জিনিস তা কখনো বুঝতে চাননি। তার কোন লোভ-লালসা ছিল না। তিনি সেনা বাহিনীতে চাকুরী পেয়েছিলেন। কয়েক বছর পরে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে চলে আসেন। পরে আবার বিদ্যুৎ অফিসেও চাকুরী করেছেন। সেটাও ছেড়ে দেন। সত্যি বলতে কি তার জীবনের প্রতি কোন মায়া ছিল না। তিনি তার ইচ্ছেমতো চলতেন। জ্জ বছর আগে তাকে বেলগাছী রেল স্টেশনে পড়ে থাকতে দেখে আমরা কয়েকজন মিলে তাকে মন্দিরে রাখার ব্যবস্থা করে দেই। গত বছর তিনি আরো বেশী অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিছানাতেই প্র¯্রাব-পায়খানা করে দিতে থাকেন। সেগুলো পরিষ্কার করার মতো কাউকে পাওয়া যায়নি। তাছাড়া মন্দিরতো পরিষ্কার রাখতে হবে। মন্দিরের পবিত্রতা বিষয়ে বিবেচনা করে সকলের সাথে আলোচনা করে তার থাকার জন্য মন্দিরের পিছনে একটি ছাপড়া ঘর করে দেওয়া হয়। বর্তমানে তিনি সেখানেই আছেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অবঃ) অলীক গুপ্ত বীর প্রতীক বলেন, সাধন কুমার চক্রবর্তী একজন মুক্তিযোদ্ধা। ওর কাছে একটি সনদও আছে। ১৯৭২ সালে ফেব্রুয়ারী অথবা মার্চ মাসে সেটি দেওয়া হয়েছিল। আমি তখন ফরিদপুর জেলার মিলিশিয়া ক্যাম্পের ইনচার্জ ছিলাম। যে কারণেই হোক সে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। সর্বশেষ ২০১৬-২০১৭ সালে যখন ফরম দেয়া হলো সে তখন অনলাইনে রেজিস্ট্রেশন করেছিল। কিন্তু যেদিন কালুখালীতে যাচাই-বাছাই হয়, সেদিন যারা সেখানে ছিল তারা ওর সাথের মুক্তিযোদ্ধা ঢাকায় থাকার কারণে ওকে কেউ চিনতে পারেনি। তাই হয়তো সেখান থেকে ওর নাম বাদ পড়েছে। আমি রাজবাড়ী-২ আসনের এমপি মোঃ জিল্লুল হাকিমের সাথেও কথা বলেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, দাদা আমিও সাধনকে চিনি। আপনি আমার সাথে সাধনকে দেখা করতে বলেন। আমি সাধনকে পরে এমপির সাথে দেখা করতে বলি। কিন্তু এমপি ঢাকায় থাকার থাকার কারণে তার সাথে দেখা করতে পারেনি। যাচাই-বাছাই’র বোর্ডে উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবং রাজবাড়ী জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ছিলেন। তাদেরকেও আমি বলেছিলাম। কিন্তু তারাও সাধনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক।