॥আসহাবুল ইয়ামিন রয়েন॥ রাজবাড়ী জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা গতকাল ১২ই সেপ্টেম্বর সকালে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।
জেলা প্রশাসক ও কমিটির সভাপতি দিলসাদ বেগমের সভাপতিত্বে সভায় কমিটির উপদেষ্টা রাজবাড়ী-১ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী, উপদেষ্টা রাজবাড়ী-২ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম, পুলিশ সুপারের পক্ষে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(প্রশাসন ও অপরাধ) মোঃ সালাহ উদ্দিন, সিভিল সার্জন ডাঃ ইব্রাহিম মোহাম্মদ টিটন, রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়র মোঃ আলমগীর শেখ তিতু, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডঃ ইমদাদুল হক বিশ্বাস, পাংশা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ফরিদ হাসান ওদুদ, গোয়ালন্দ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোস্তফা মুন্সী, কালুখালী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলীউজ্জামান চৌধুরী টিটো, গোয়ালন্দ পৌরসভার মেয়র নজরুল ইসলাম মন্ডল, এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী গোপাল চন্দ্র দাশ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার(সদর সার্কেল) মঈন উদ্দিন চৌধুরী, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক তানভীর হোসেন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হেদায়েত আলী সোহরাব, রাজবাড়ী চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পরিচালক জাকির হোসেন ও রাজবাড়ী ব্যাপিস্ট চার্চের যাজক জেমস হালদার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
সভায় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী তার বক্তব্যে বলেন, করোনা মহামারীর কারণে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর আজ থেকে আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যাতে সব ধরনের স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা হয় সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের তদারকি করতে হবে। এলজিইডি গ্রামীণ এলাকার রাস্তাঘাটগুলোর যে কাজ সম্পন্ন করেছে, তদারকির অভাবে সেগুলোর কাজের মান সঠিক না হওয়ায় কিছু দিনের মধ্যেই অনেক রাস্তা যান চলাচলের অনুযায়ী হয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। রাজবাড়ী পৌরসভা এলাকার ময়লা-আবর্জনা শ্রীপুর বাস টার্মিনাল এলাকায় মহাসড়কের পাশে ফেলার কারণে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, দৃষ্টিকটু লাগছে। পৌর কর্তৃপক্ষকে বলবো ময়লা-আবর্জনাগুলো ভেকু মেশিন দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়াসহ লোকচক্ষুর আড়াল করার জন্য টিনের বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে।
তিনি বলেন, বর্তমানে ডেঙ্গুর অবস্থা খুব খারাপ পর্যায়ে রয়েছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ডাঃ আবুল হোসেন কলেজের একজন শিক্ষক মারা গেছেন। পৌর মেয়রকে বলবো ডেঙ্গু প্রতিরোধে রাজবাড়ী পৌরসভা এলাকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে মশার ওষুধ ছিটাতে। রাজবাড়ীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সার্বিকভাবে ভালো থাকলেও মাদক ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জেলার আনাচে-কানাচের সব জায়গাতেই মাদকের অবাধ কেনাবেচা ও সেবন চলছে। এ ক্ষেত্রে জেলার প্রত্যেক উপজেলার একটি করে ইউনিয়নকে নির্বাচন করে পর্যায়ক্রমে মাদকমুক্ত করলে ফলপ্রসূ হবে। রাজবাড়ী সদর উপজেলায় প্রথমে আমরা পাঁচুরিয়া ইউনিয়নকে মাদকমুক্ত করতে জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তাসহ সবাই মিলে কাজ করবো।
সংসদ সদস্য আলহাজ্ব কাজী কেরামত আলী আরো বলেন, বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি দৌলতদিয়া পতিতাপল্লীর বিতর্কিত এক বাড়ীওয়ালী বিয়ার বিক্রিসহ বিভিন্ন অপকর্ম করছে। গোয়ালন্দ ঘাট থানার ওসি জানা সত্বেও তার ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না। জেলা পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি।
রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের বড়পুল মোড় থেকে মুরগীর ফার্ম পর্যন্ত এবং বাগমারা-ধাওয়াপাড়া আঞ্চলিক সড়কের কাজ দীর্ঘদিন ধরে ফেলে রাখা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগ বলেছিল, সাব-স্টেশন নির্মাণ হয়ে গেলে রাজবাড়ীতে আর লোডশেডিং হবে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমানতালে বিদ্যুৎ আসা-যাওয়া করছে। যাতে আর বিদ্যুৎ না যায় সে ব্যাপারে বিদ্যুৎ বিভাগকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে যানজট ও ভোগান্তি এড়াতে গোয়ালন্দে স্থাপিত বিআইডব্লিউটিসির ওজন স্কেল অন্যত্র স্থানান্তর, রাজবাড়ী সদর হাসপাতালের মর্গের পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট দ্রুত সময়ে প্রদানসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মোঃ জিল্লুল হাকিম বলেন, আমরা একটি সময় অতিক্রম করেছি যখন জেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা সন্ত্রাসপ্রবণ ছিল। কিন্তু বর্তমানে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রশংসনীয় তৎপরতায় ওই সকল এলাকায় সন্ত্রাসীদের আনাগোনাসহ চুরি, ডাকাতি সব কিছুই কমে গেছে। যার ফলে ওই সকল এলাকার সাধারণ মানুষ শান্তিতে জীবনযাপন করতে পারছে। তবে আরো প্রচেষ্টা চালাতে হবে যাতে ওইসব এলাকায় আর অস্ত্রধারীরা প্রবেশ করতে না পারে। বর্তমানে জেলায় মাদক পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সর্বত্র মাদকে সয়লাব হয়ে গেছে। যা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ কারো একার পক্ষেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না। সুতরাং সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জেলাকে মাদকমুক্ত করতে কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মচারীরা মাদক সেবন করে বলে অভিযোগ রয়েছে। যারা এ ধরনের কাজ করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে চাকরী থেকে অব্যাহতি দেয়ার জন্য সিভিল সার্জনকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানাচ্ছি। জেলার হাসপাতালগুলোতে রোগীদের কাছ থেকে নানা অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। যারা এ কাজগুলো করছে তাদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। রাজবাড়ী সদর হাসপাতালে সিরিয়াস রোগীরা গেলে কোন চিকিৎসা না দিয়ে রেফার করে দেয়া হয়। এর ফলে অনেক সিরিয়াস রোগী পথেই মারা যায়, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। গুরুতর রোগীদের তাৎক্ষণিক রেফার না করে আগে হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এমপি মোঃ জিল্লুল হাকিম বলেন, জেলা আইন-শৃঙ্খলা মিটিংয়ে জেলার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকে। কমিটির সভাপতি জেলা প্রশাসককে অনুরোধ করবো আমরা যেসব বিষয়ে আলোচনা করি পরবর্তীতে সেগুলোর অগ্রগতি ও ফলোআপ অবহিত করতে।
এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে যে কাজ বাকী রয়েছে সেগুলো সম্পন্ন করা, ঘন ঘন বিদ্যুৎ না যাওয়া, এলজিইডির বিভিন্ন রাস্তার কাজ সাব-ঠিকাদার না দিয়ে করানো, ঠিকমতো তদারকি করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, বর্তমানে জেলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পূর্বের যে কোন সময়ের তুলনায় ভালো রয়েছে। করোনা পরিস্থিতির কারণে অনেক দিন পর আমরা সশরীরে উপস্থিত হয়ে আজকের এই মিটিং করলাম, যা অনেক প্রাণবন্ত হয়েছে। দীর্ঘদিন পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলেছে। সেগুলোতে ঠিকমতো স্বাস্থ্যবিধি মানা হয় কি না সে ব্যাপারে সরকারী কর্মকর্তাদের তদারকির পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদেরও খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, রাজবাড়ী-১ আসনের এমপি মহোদয়ের প্রস্তাব অনুযায়ী প্রতিটি উপজেলার একটি করে ইউনিয়নকে ধরে সম্মিলিতভাবে মাদকমুক্ত করার ব্যাপারে একমত হয়ে কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবে। গোয়ালন্দের ওজন স্কেলটি অপসারণের ব্যাপারে আমি নিজে তদারকি করবো। রাজবাড়ী পৌরসভার মেয়রকে শ্রীপুরের মহাসড়কের পাশে ফেলা ময়লা-আবর্জনা অপসারণের ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়াও তিনি তার বক্তব্যে অবৈধ বালুর চাতাল অপসারণ, বেপরোয়াভাবে মোটর সাইকেল চালানোর ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ, এলজিইডি কর্তৃক সঠিকভাবে রাস্তার কাজ করা, সদর হাসপাতাল মর্গের পোস্ট মর্টেমের রিপোর্ট দ্রুত প্রদান, সড়ক বিভাগ ও এলজিইডির ফেলে রাখা কাজ দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ, ঘন ঘন বিদ্যুৎ যাতে না যায় সে ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ প্রতিরোধসহ বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরেন।
সভার শুরুতে বিগত সভার কার্যবিবরণী পাঠ করেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সূবর্ণা রাণী সাহা। জেলা আইন-শৃঙ্খলা কমিটির সদস্যগণসহ সংশ্লিষ্টরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।